“দোলে দুর্গোৎসব”
বৈষ্ণব শাক্ত মিলে মিশে জমজমাট উৎসব
সুমন্ত বড়াল
দোল উতসব এর কথা এলেই প্রথমেই মনে আসে শান্তিনিকেতন কিনবা নবদ্বীপ মায়াপুরের কথা, তবে এই দুই যায়গা তে দোল উৎসব এর ধরণ টা কিছুটা আলাদা। এই দুই যায়গার দোল নিয়ে নানান চর্চা মানুষ করে থাকেন, তাই আজ অন্য এক শহরের দোল উত্সব এর কথা বলি। যদিও এই শহর টাকে মানুষ রথের শহর হিসাবে চেনে। হ্যাঁ আমি হুগলির শ্রীরামপুর শহর এর কথা বলছি, আমি আমার জন্মভূমি র কথা বলছি।
শ্রীরামপুর
এর দল উৎসব অভিনবত্ত্ব এ ভরপুর। এই শহরের দোলে ই বোধহয় একমাত্র শাক্ত আর বৈষ্ণব ধারা মিলমিশে এক
হয়ে যায়। এককথায় এই
পশ্চিমবঙ্গে হুগলী জেলার শ্রীরামপুর বোধহয় একমাত্র শহর যেখানে দোল আর
দুর্গোৎসব একই দিনে একই সাথে অনুষ্ঠিত হয়। তাও বহু শতাব্দী ধরে।
শ্রীরামপুর
এর পশ্চিম প্রান্তে ,চাতরা অঞ্চলে রয়েছে গৌরাঙ্গ মন্দির কাশীশ্বর পীঠ। স্থানীয় দের কাছে যা দোল তলা
মন্দির নামেই খ্যাত। এই দোল তলার সাথে জড়িয়ে রয়েছে মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের নাম। এই
গৌরাঙ্গ মন্দির অনেক গুলি কারণে বৈশিষ্ট্য পূর্ণ। পঞ্চদশ শতকে বাসুদেব
ভট্টাচার্য্য এখানে শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র
মহাপ্রভুর অন্যতম পরিকর কাশীশ্বর পন্ডিত সেই শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ এর পাশে শ্রী
গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন, যে মূর্তি তিনি পুরী ধাম থেকে
এনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৫৪৪ খ্রীষ্টাব্দে কাশীশ্বরের আহ্বানে মহাপ্রভু এই
মন্দিরে এসে শ্রীকৃষ্ণ এর পাশে তার মূর্তি দেখে অপরাধ বোধ করেন এবং নিজের মূর্তি
গঙ্গায় বিসর্জন দেন , কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর মূর্তি টি
রয়ে যার। মহাপ্রভুর তিরোধানের পর কাশীশ্বর পন্ডিত এর পৌত্র পুনরায় একটি গৌরাঙ্গ
মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। যে বিগ্রহ আজও পূজিত হয়ে চলেছে। আবার এই মন্দিরের
প্রাচীন শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি টি বাঁকুড়ার রাজা
বীর হাম্বীর চাতরা থেকে লুঠ করে তাঁর রাজধানী তে প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীকালে বীর হাম্বীর র পৌত্র গোপাল
সিংহ সেই শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি কর্জের জরিমানা স্বরুপ কুমারটুলির গোকুল মিত্রের কাছে
বন্দক রাখেন। কিন্তু কর্জ পরিশোধ না হলে সেই বিগ্রহ আজও কুমার টুলি তে পূজিত হচ্ছে।
এইভাবে আশি বছর মন্দির বিগ্রহ শূন্য অবস্থায় নিত্য পুজীত হত, এরপর কাশীশবর পন্ডিতের বংশধর রা আবার
নতুন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। যা বহু শতাব্দী ধরে আজও পূজিত হয়ে চলেছে।
এই বিগ্রহ গুলি কে কেন্দ্র করেই পালিত হয় গৌরাঙ্গ মন্দিরের শতাব্দী প্রাচীন দোল উৎসব। দোল উৎসব এর দিন ভোর থেকে শুরু হয়ে যায় নানাবিধ অনুষ্ঠান। দোল মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে দুটি দোলমঞ । দোলমঞ্চ দুটি উচুঁ ভিত্তির উপর স্থাপিত। দোলের দিন ভোর বেলা বিগ্রহ গুলিকে সিংহাসনে চাপিয়ে দোল মঞ্চে নিয়ে আসা হয়। শুরু হয় উৎসব । দোলের দিন ভক্ত আর ভগবান মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। স্থানীয় মানুষত বটেই দূর দূরান্ত থেকে মানুষ জন এই উৎসবে সামিল হতে আসেন। ভক্তরা নিজ হাতে শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি ও গৌরাঙ্গ মূর্তি কে আবীরে রাঙিয়ে দেয়। নবদ্বীপ ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ এর পাশে গৌরাঙ্গ মূর্তি দেখা যায়না। আর একসাথে এই দুই বিগ্রহের আবীর রাঙা রূপ সত্যিই বিরল। দোল উৎসব কে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে চাতরা অঞ্চল তথা গৌরাঙ্গ মন্দির দোল তলা। সারাদিন ভক্ত সমাগম, নাম সংকীর্তন চলে। বিকালের পর মন্দির সংলগ্ন মাঠে মেলা বসে আলো মালায় সেজে ওঠে মন্দির চত্বর। সব মিলিয়ে সাজো সাজো রর,দোল উৎসব জমজমাট। মহানায়ক উত্তম কুমার নাকি প্রত্যেক বছর এই দোল তলায় দোল উৎসবে এই গৌরাঙ্গ মন্দিরে আসতেন।
শহরের
পশ্চিম দিক যখন মেতে উঠেছে বৈষ্ণব পীঠের দোল উৎসবে। ঠিক তখনই পূর্ব প্রান্তে চলছে শাক্ত
আরাধনা। যদিও শহরের পূর্ব প্রান্তে প্রাচীন রাধাবল্লভ জিউ এর দোল যথেষ্ট বিখ্যাত
কিন্তু অভিনবত্ত্ব এই মন্দির থেকে একটু দূরে পঞ্চানন তলায়। সেখানে দোলের দিন
সাড়ম্বরে পালিত হয় মহিষমর্দিনী পুজো।
কথায়
আছে দোল দুর্গোৎসব । সুদীর্ঘ. ২১৬ বছর ধরে চলেছে এই প্রথা।
তবে
এই দূর্গাপুজা তে দেবী সিংহের উপর সারওয়ার হয়ে মহিষাসুর বধ করছেন বটে তবে এখানে
দেবী সপরিবারে আসেন না। আসেন জয়া বিজয়া কে সঙ্গে নিয়ে। আর দেবী পুজিত হন
মহিষমর্দিনী রূপে।
সাধারণত
দোল উৎসব মানেই শ্রীকৃষ্ণ এর পুজা বৈষ্ণব
সম্প্রদায় মানুষের এক বিশেষ দিন , শ্রী চৈতন্য দেবের জন্মতিথি ও বটে , কিন্তু শ্রীরামপুর এর পঞ্চানন তলায় এই দোল পূর্ণিমার দিন রীতি মেনেই
চলে শক্তির আরাধনা।
দোল
পূর্ণিমার দিন এমন মহিষমর্দিনী পুজা র উদাহরন হুগলী জেলায় সম্ভবত আর নেই। জৈষ্ঠ্য
মাসে চুঁচুড়া অঞ্চলে মহিষমর্দিনী পুজার চল আছে কিন্তু দোল পূর্ণিমা তে এই পূজো এই
একটিই। সেই দিক থেকে শ্রীরামপুর এর পঞ্চানন তলার মহিষমর্দিনী পুজো সতন্ত্র ও বটে।
দ্বিশতাধিক বছর পুরানো এই পুজো ঘিরে রয়েছে নানা লোকশ্রুতি, কিন্তু সেসব কিছুর কোন প্রামাণ্য তথ্য নেই। পঞ্চানন তলা অঞ্চলের পরিচিত মুখ , এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত পেশায় শিক্ষক শ্রী তন্ময় ভট্টাচার্যয় মহাশয় জানালেন এই পুজো নিয়ে কিছু কথা । স্থানীয় দে বাড়ির পূর্বপুরুষ পুলীন বিহারী দে ও নগেন্দ্র নাথ দে , দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে দোল পূর্ণিমা তিথি তে এই পুজো শুরু করেন । পরবর্তী কালে সেই পুজো বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বারোয়ারীর অঙ্গনে মিশে গেছে ।
সার্বজনীন
এই পুজো পরিচালনা করার জন্য আগে মহিষমর্দিনী র পরিচালন কমিটি থাকলেও বর্তমানে
স্থানীয় টাউন ক্লাব এই পুজো পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছে।
প্রচারের
আড়ালে থাকা এবং ইতিহাস থেকে বিস্তৃত হুগলী জেলার এই প্রাচীন পুজো নিয়ে স্থানীয়
মানুষের উত্সাহের কোন অভাব নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই মহিষমর্দিনী পুজো
যেন দুর্গাপুজোর র মতই। আর হবেনা নাই বা কেন ঢাকের বোলে উৎসব এর সুরই ঘুরপাক খায়
এই অঞ্চলে এই পুজোর চারদিন।
সপ্তমী
তিথি তে দেবীর পায়ে আবীর ছুইয়ে শুরু হয় , অষ্টমী তিথি তে একশো আট প্রদীপ জ্বেলে দেবীর আরতি, নবমী তে ভোগ দান এবং দশমী তে বিসর্জন।
রীতি মেনে নিষ্ঠা ভরে পূজিত হন দেবী মহিষমর্দিনী। আগে এই পুজোয় বলি প্রথা প্রচলন
থাকলেও বর্তমানে পশুবলি আর হয়না , কিন্তু
পুজো উপলক্ষে বিরাট ভোগের আয়োজন হয় ধুমধাম করে। যাতে অংশ নেন বহু মানুষ।
পুজোর
শুরুর দিন টাউন ক্লাবের উদ্যোগে প্রভাত ফেরীর আয়োজন করা হয়। আবীর মেখে ঢাক এর তালে দোলের দিন দুর্গোৎসব এর আনন্দে মেতে উঠে মানুষ জন।
বর্তমানে
মহিষমর্দিনীর স্থায়ী একটি মন্দির রয়েছে। যেটি নতুন করে নির্মিত হয়েছে দেবী
মন্দিরের সামনের অংশ টিও আচ্ছাদিত করা হয়েছে । মন্দিরের সাথে রয়েছে ভোগের ঘর আর পুজো আয়োজন এর ঘর। প্রত্যেক বছর
দোলের দিন পাথর বাধানো দালানে মৃন্ময়ী
মূর্তি পুজিত হন। এই সময় আলোর মালায় সেজে ওঠে স্থানীয় অঞ্চল। সবমিলিয়ে দোলে
দুর্গোৎসব এর আমেজ নিয়ে শ্রীরামপুরে মহিষমর্দিনী পুজো জমজমাট।
বসন্তের উৎসব মুখর দিনে একই শহরের দুই প্রান্তে
দুই রকম উৎসবের ছবি । রীতি
র দিক থেকে দুই উৎসব কিন্ত ভিন্ন ধারার , কিন্তু এই দুই
ভিন্ন ধারার উৎসব এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে এ শহরের মানুষ । উৎসব এর প্রধান উপকরণ যে মানুষের
অংশ গ্রহণ তা প্রমাণ করে এই শহর । দোল
তো রঙের উৎসব , আর এই দুই প্রাচীন উৎসব কে কেন্দ্র করে শহর
শ্রীরামপুর যেন দোলের দিন একটু বেশী রঙিন হয়ে ওঠে ।