প্রাচীনতা যেখানে বনেদীয়ানায়
ঝলমলিয়ে ওঠে
( শ্রীরামপুরের
দে বাড়ি)
বনেদী বাড়ির পুজো বলতেই প্রথমেই যে ছবি গুলো
মাথায় আসে,একটা বিশাল ঠাকুর দালান তাতে ঝলমলে সাজে অনেক মানুষ। তাদের কথার তালে
সুরে মুখরিত চত্বর, ঝাড়বাতি, ঢাকের বাদ্যি,
আর পুরো চত্বর আলো করে থাকা একটি সুসজ্জিত প্রতিমা। আর ধুনোর ধোঁয়ায়
ভরে যাওয়া ঠাকুর দালান।
এই পুরো ছবিটা হুবহু মিলে যাবে আপনি যদি পুজোর
মধ্যে চলে আসেন শহর শ্রীরামপুরের দে বাড়িতে।
শহর টাকে যখন আপাদমস্তক মুড়ে ফেলছে আধুনিকতা সেই সময় দাড়িয়ে দে বাড়ি তাদের
ঐতিহ্য কে নিখুঁত ভাবে বজায় রেখে দিয়েছে।
এ বাড়ির পুরানো থেকে আধুনিক প্রজন্ম সকলেই
সামিল হন এই পুজোয়। পুজোর পাঁচটা দিন দে
বাড়ির ঠাকুর দালান যেন সব পেয়েছি র আসর।
এই দে বাড়ির সাথে আমার যোগাযোগ বহু বছরের। আমি
নিজেও এই শহরের লোক। দে বাড়ির নতুন প্রজন্মের মানুষ সৌম্যদীপ
দে(টুকাই) । এই লেখার বিষয়ে বলতেই কি আগ্রহ
তার। অবলীলায় সে বলতে শুরু করলো তাদের পুজোর ইতিহাস। আসলে শ্রীরামপুর এর দে বাড়ির
এটাই নিউক্লিয়াস। পুরানো হোক বা নতুন সব প্রজন্মই তাদের শিকড় টা ভোলেনি।
এই দে বাড়ি জুড়ে রয়েছে প্রায় তিনশো বছরের
ইতিহাস। পুরানো শ্রীরামপুর এর সাক্ষ্য বহন করে চলছে এই দে বাড়ি।
রাম চন্দ্র দে র আমল থেকে এই দে বাড়ির
প্রতিপত্তির শুরু। পেশায় ব্যবসায়ী রামচন্দ্র ছিলেন নুনের ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়
তিনি প্রতিপত্তি অর্জন ।
তিনি যে
সেই সময় ব্যবসায়ী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।রামচন্দ্র
দে মহাশয় সেই সময় শহরের একজন ধার্মিক মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন । বাংলার ১২৩০ সনে
তিনি পরলোকগমণ করলে তাঁর স্ত্রী তাঁর সাথে সহমরণে যান , শহর শ্রীরামপুরে এটি ছিল
শেষ সতীপ্রথা ।
রামচন্দ্র দের তৈরি ঠাকুর দালান কিংবা দে বাড়ি
প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর সাক্ষ্য বহন করে চলে।
বাড়িটি কালের নিয়মে ভগ্নপ্রায় তবে ঠাকুর দালান এখনও একই রকম। বাড়ির কিছুটা
অংশে এখন একটি স্কুল ও রয়েছে। এই দে পরিবারের নিজস্ব একটি গঙ্গার ঘাট ও রয়েছে।
জনশ্রুতি এও রয়েছে অতীতে নাকি দে বাড়ি ভিতর দিয়ে ঘাট পর্যন্ত একটি রাস্তা ছিল,
বাড়ির মহিলাদের গঙ্গা স্নানে যাওয়ার জন্য ছিল এই ব্যবস্থা।
লোকশ্রুতি ,ইতিহাস, গল্প
এসব অতীত কিন্তু আজও দে বাড়ির বৈভবের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের ঠাকুর দালান আর,
দুর্গাপূজা।
প্রথা মেনে রথ থেকেই দে বাড়িতে উৎসবের মেজাজ।
রথে কাঠামো পুজোর মধ্যে দিয়ে পুজোর সূচনা । তবে এই পরিবারের কূল দেবতা শ্রীধর জিঊ।
সব পুজোর আগেই তার পুজো বাধ্যতামূলক। কাঠামো পুজার পর ঠাকুর দালানেই স্থানীয়
চাতরা অঞ্চলের মৃৎশিল্পী রা ঠাকুর গড়া
শুরু করেন। মহলয়া তিথিতে দেবীপক্ষের
সূচনায় হয়ে চক্ষুদান। এই চক্ষু দান
পর্বটি ও দেখার মত।
ষষ্ঠী তে দেবীর আনুষ্ঠানিক বোধন হয় ঠিকই তবে
পঞ্চমী থেকেই আলোর রোশনাই আর মানুষের সমাগম এ ভরে ওঠে দে বাড়ি।
এই বাড়ির পুজায় বলি দান প্রথার চল নেই। এই
বাড়িতে অন্নভোগের প্রথা ও নেই। বাড়ির প্রবীণা সদস্যা শ্রীমত্যা বিজয়া দে জানান,
যেহেতু এটা ব্রাহ্মণ বাড়ির পুজো নয় তাই অন্নভোগ হয়না।
শীতল ভোগ,
নানা পদের মিষ্টি, নাড়ু দিয়েই চলে ঘরের মেয়ে রসনা তৃপ্তি
। দে বাড়ির পুজোর কয়েক টি ব্যাপার সত্যি মন ছুঁয়ে যায় প্রথম, এই বাড়ির সন্ধি পুজোর প্রদীপ জ্বালানো
। প্রদীপের আলোয় ভরে যায় ঠাকুর দালান চত্বর । আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই বাড়ির
বিসর্জন পর্ব।
দশমীর দিন দুপুরে শুরু হয় ঘরের মেয়ে উমার বিদায়
পর্ব। মূর্তি কে মূল মঞ্চ থেকে নামিয়ে ঠাকুর দালানের মাঝখানে রাখা হয়। তারপর শুরু
হয় বরণ পর্ব। দে পরিবারের যতজন এয়ো স্ত্রী রয়েছেন সকলে সালংকারা বেশে দেবীকে
প্রদক্ষিণ করে বরণ শুরু
করেন। এরপর সিঁদুর খেলা আর ধুনুচী নাচ। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে
এই অনুষ্ঠান। এই কয়েক ঘণ্টা সত্যি মনোমুগ্ধকর। পরিবারের লোক, স্থানীয়
মানুষ ছাড়া দূরদুরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমান এই দিন। ফ্লাস বালব এর ঝলকানি ,
ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খ উলু সব মিলিয়ে অদ্ভুত ঘোর লেগে
যায়। আর এই রেশ মেখে দেবী চলেন বিসর্জনে। দে পরিবারের নিজস্ব নামাঙ্কিত ঘাটে
প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। তবে এই বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজা হয়না ওই দিন কুলদেবতা
শ্রীধর জিঊ র পুজো হয়।
সাবেকিয়ানায় মোড়া। সোনার অলংকার, রুপোর
মুকুট আর অস্ত্রে সজ্জিত দেবী মূর্তি। আর আলোক উজ্জ্বল বিশাল ঠাকুর দালান
সবমিলিয়ে আধুনিক সাজে প্রাচীন ইতিহাস এর রূপ দেখতে হলে অবশ্যই গন্তব্য হবে
শ্রীরামপুরের ২৭০ বছরের দে বাড়ির পুজো।
হুগলী দর্শন
খুব ভাল লাগল। সমৃদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ।
ReplyDelete