Monday, 13 April 2020


***এক অচেনা গন্তব্যে র দুটি মন্দির এর গল্প ***




জেলার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো র নেশা আমার বহুদিনের। আমার হুগলী জেলা আকারে আর বৈচিত্রে দুই দিক থেকেই সমৃদ্ধ। সুধীর মিত্রের হুগলী জেলা ও বঙ্গসমাজ কিংবা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের  হুগলী জেলার পুরাকীর্তি এই বই গুলো তে চোখ বলালেই খোঁজ পেয়ে যাই নতুন গন্তব্যের। আর সময় করে গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেই হল।
এমন ই এক বেড়িয়ে পড়ার গল্প বলবো আজ। আর যে গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে একটা ছোটখাটো গ্রাম আর দুটো প্রাচীন মন্দিরের কথা।
শীত তখন শেষের পথে ফ্রেব্রুয়ারির প্রথম দিক। দুপুর গুলো বেস মনোরম। বেড়িয়ে পরলাম গন্তব্যে খুব পরিচিত জনপদ আটপুর। শ্রীরামপুর থেকে সড়ক পথে দূরত্ব প্রায় ৩৬ কিলোমিটার। শিয়াখালা হয়ে অহল্যা বাই রোড ধরে গজারমোড় সেখান থেকে বা দিকে সোজা আঁটপুর।
দুপুরের মিঠে রোদ ,মেঠো গন্ধ, সবুজের সমারোহ, গ্রাম্য মানুষ আর হাইওয়ে। বেস মনোরম। গজার মোড়ে দাঁড়ালাম একটু। চা এ চুমুক ও রাস্তায় আসতে আসতে চোখে পড়ল বনমালী পুরের নবনির্মিত বিশাল দত্তাত্রেয় মন্দির আর শিয়াখালার শতাব্দী প্রাচীন উত্তর বাহিনী।




চা এ চুমুক দিয়ে আবার যাত্রা শুরু গজার মোড় থেকে বাঁদিকে ।কিছুটা গিয়েই হঠাৎ করে তাল কাটলো। দেখি ডানদিকে একটা লাল মোরামে মোড়া রাস্তা চলে গেছে আর রাস্তায় মোড়ে রাজ্য সরাসরি সাইন বোর্ড তাতে লেখা " রাজরাজেশ্বর মন্দির " ডান দিকে। গ্রামের নাম দ্বারহাটা। কোথায় শুনেছি নাম টা। মনে পড়লো সুধীর মিত্রের হুগলী জেলার দেবদেঊল বইতে পড়েছি দ্বারহাটার  দ্বারিকাচনডী র কথা।
আটপুর বাতিল ,গাড়ি ডান দিকে বাক নিল।
ঘড়ির কাটার তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল ছুই ছুঁই। লালা মোড়ামের রাস্তা,  ক্ষেত  খামার, কিছু ছোট খাটো বাড়ি আর একটা বড় পুকুর পেরতোই চোখে পড়ল একটা মন্দিরের চূড়া , কিন্তু অদ্ভুত বিষয় যাওয়ার রাস্তা নেই। উপায় এর সাথে সাথে নানা ভাবনা ভাবছি হঠাৎ হাতে কাটারি নিয়ে এক গ্রাম্য মাঝবয়সী লোক হাজির। আমাকে দেখে দাঁড়ালেন আমি রাস্তা জানতে চাইলে হাত উচুঁ করে দেখিয়ে সে এগিয়ে গেল।  মজার বিষয় উনি যে রাস্তা টা দেখালেন আমি সেটা কে এতক্ষণ একটা মেঠো বাড়ির উঠোন ভাবছিলাম। সেই মেঠো রাস্তা পুকুরে ধার ঘেষে সোজা চলে গেছে মন্দিরের কাছে। কিছুটা গিয়েই চোখে পড়ল গাছ গাছালি তে ঘেরা এক মন্দির। প্রাচীন আটচালা রীতির এক মন্দির। মন্দিরের সামনে অনেক ঘেরা অংশ নাটমন্দির নেই। মন্দিরের সামনে র গেটে ঝুলছে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের বোর্ড। যাতে লেখা রাজ রাজেশ্বর মন্দির যার রক্ষণাবেক্ষণ এর ভার  রাজ্য সরকারের।


                           *** রাজরাজেশ্বর মন্দির ***

 মন্দির টি একটু উচুঁ ভিত্তির উপর স্থাপিত। সময়ের সাথে সাথে এই মন্দির ক্ষয়প্রাপ্ত। সরকারি রক্ষণাবেক্ষণ এই মন্দির এখনো টিকে আছে বটে কিন্তু নতুন করে রঙের প্রলেপ পড়ে কৌলীন্য হারিয়েছে। ভিতরে ঢুকে মন্দির টা ভালো করে দেখতে শুরু করলাম, বলা ভালো ছবি তুলতে শুরু করলাম। মন্দির টি একসময় টেরাকোটা র কাজে সমৃদ্ধ ছিল তার কিছু নিদর্শন এখনো রয়েছে। আলাপ হল এই গ্রামের স্থানীয় মানুষ প্রলয় ভট্টাচার্য এর সাথে , তিনি আমায় দেখে এগিয়ে এলেন। মন্দির সম্বন্ধে নানা কথা বলতে লাগলেন। তবে সে সবই  ইতিহাস। তার থেকেই জানা গেল এই রাজরাজেশ্বর মন্দির প্রায় ২৯২ বছরের পুরানো। স্থানীয় জমিদার অপূর্ব মোহন সিংহ রায় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি গল্পের ছলে বলে যান এই মন্দিরের টেরাকোটার কাজের কথা যার কিছু নিদর্শন রয়েছে।তৎকালীন সময়ে হুগলী জেলার সমাজ চিত্র টেরাকোটার মাধ্যমে এই মন্দিরের গায়ে খোদাই ছিল। মন্দির টি বেশ বড় আকারের আটচালা মন্দির , দৈর্ঘ্য প্রায় 24 ফুট আর প্রস্থ প্রায় ২১ ফুট। ত্রিখিলান যুক্ত প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতে হয় গর্ভগৃহে।



মন্দিরের সাথে প্রলয় বাবু জানালে এই গ্রামের ইতিহাস। প্রাচীন এই গ্রাম একসময় ছিল ডাচ ও ডেনীয় দের বাণিজ্য কুঠি। এই গ্রাম হুগলী জেলার মহুকুমা সদর ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ রা শ্রীরামপুর অধীগ্রহন করলে ১৮৪৫ সাল থেকে এই গ্রাম শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়কথায় কথায় জানতে চাইলাম দ্বারিকাচন্ডী  মন্দিরের কথা। প্রলয় বাবু উৎসাহী হয়ে বললেন হ্যাঁ অবশ্যই দ্বারিকাচন্ডী তো এই গ্রামের প্রাচীন দেবী ওই দেবীর নামেই তো এই গ্রামের নামকরণ। জানতে চাইলাম মন্দির এখান থেকে কতদূর। উনি জানালেন এই কাছেই। তবে আফশোসের সাথে বললেন সেই প্রাচীন মন্দির কালের নিয়মে ভেঙে পড়েছে, স্থানীয় গ্রামবাসী আর পঞ্চায়েত মিলে ভাঙা অংশের উপর নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রাচীন টেরাকোটার কাজ ভিতরে কিছু দেখতে পাওয়া যেতে পারে।




প্রলয় বাবু র সাথে গল্পে মশগুল দেখি বিকেল ও শেষের পথে। মাঠ মন্দির চত্বর কচিকাঁচা আর গ্রাম্য মানুষের দখলে। পাশের ঝোপ থেকে ঢেকে চলেছে বসন্তবৌরি। প্রলয় বাবু কে অনুরোধ করলাম সঙ্গ দেওয়ার জন্য। গাড়ি তে স্টার্ট দিয়ে ফিরে দেখলাম রাজরাজেশ্বর মন্দিরের দিকে শেষ বিকালের আলো মন্দির ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেন সে বলছে , ‘‘আমি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজ ও দাড়িয়ে আছি থাকবো কালের কাছে হার মেনে বিলীন হওয়া আমায় মানায় না।“
প্রলয় কাকু রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আসলে বাবু , আপনি আমার আসে না। তাই অল্প আলাপে সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলি। রাস্তায় যেতে গিয়ে ঝোপে ঢাকা ছোট্ট মন্দির চোখে পড়ল কাকু বললো বুড়ো শিব, তবে ইতিহাস জানা নেই।
কিছুটা রাস্তা যেতেই দ্বারিকাচন্ডীর মন্দিরে পৌঁছালাম আমরা। সময় তখন গোধূলি। এই মন্দিরের চারপাশে বেশ কিছু বড় বাড়ি রয়েছে। বেশ কয়েকজন এর সাথে পরিচয় হল প্রলয় কাকুর সুবাদে।


                          *** দ্বারিকাচন্ডী মন্দির ***


মন্দিরের ভিতর থেকে তখন শাখ আর ঘণ্টার শব্দ। ভিতরে ঢুকলাম আমরা। বাগান ঘেরা মন্দির। আগেই বলেছি প্রাচীন মন্দির আর নেই। প্রাচীন মন্দিরের অংশ থেকেই এই নবনির্মিত মন্দির। কাজেই প্রাচীন কোন মন্দির শিল্প রীতির নিদর্শন এখানে পাওয়া যায়না। মন্দিরের গায়ে লেখা শকাব্দ ১৬৮৬ অর্থাৎ ১৭৬৪ সালমন্দির নতুন কর নির্মাণ করা হলেও পুরানো মন্দিরের অংশ রয়েছে বলে পুরানো সাল টিকে রাখা রয়েছে। বাগান ঘেরা মন্দিরের রাস্তা পেরিয়ে যখন ভিতরে ঢুকছি তখন মন্দির থেকে কাসর ঘন্টা র শব্দ ভেসে আসছে। সন্ধ্যা আরতি শুরু হয়েছে। মন্দিরের কাছে যেতেই একটা বাচ্চা ছেলে হাতে পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে এগিয়ে এলো। এক ভীষণ ভালো লাগার পরিবেশছেলেটির নাম মাণিক। ওর সাথে মন্দির টা ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ। এরমধ্যে পুজো শেষ হল। প্রলয় কাকু পুরোহিত মশাই এর সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন।
ওনার সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম এই দ্বারিকাচন্ডী মন্দিরের নানা গল্প।
এই মন্দির নিয়ে কিংবদন্তি রয়েছে। স্থানীয় সিংহ রায় বংশে জনৈক পূর্ব পুরুষ স্বপ্ন আদেশ পেয়ে দেবী কে পুকুর থেকে তোলেনদেবীর প্রতিষ্ঠা র জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করলেও দেবী প্রতিষ্ঠার আগে বেদীতে এক শিয়াল প্রস্রাব করে যায়। সেই মন্দিরে দেবী কে প্রতিষ্ঠা না করে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়। সেই মন্দিরের ভগ্নাংশের উপর এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত।এই মন্দিরার প্রাচীন দেবী মূর্তি ছিল দ্বিভূজা দূর্গা মুর্তি ।তবে বর্তমানে সেই মূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে ।  দশ বছর হলো নতুন করে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে , তবে এই মূরতি চতুর্ভুজা ।দেবী সপরিবারে বিরাজ করছেন। মূল পুজো হয় দূর্গাপুজোর সময়।
কথায় কথায় সময় কতটা পেরিয়ে গেল খেয়াল করিনি। হঠাৎ একটা  পেঁচার ডাকে তাল কাটলো।


                          *** দ্বারিকাচন্ডী মাতা ***

ঘড়ির কাটা সাতটার ঘরে। এবার তাহলে ফিরতে হবে। প্রলয় কাকু অনুরোধ করলেন তার বাড়ি যেতে। পরে হবে আশ্বাস দিয়ে ফোন নাম্বার আদান প্রদান করে তাকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম। বাইকের হেডলাইট টা যেন অন্ধকার টাকে গাড় করছিল। গজার মোড় পেড়িয়ে হাইওয়ে ধরে বাড়ি ফেরাসেদিনের ঝটিকা সফর অন্য গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া। সব কিছু যত্ন করে গোছানো রইল স্মৃতি তে। আর রাস্তা ধুলো গুলো বাড়ি ফিরে ধুয়ে ফেলেছিলাম বটে কিন্তু  দ্বার হাটা গ্রামের সেই ভালো লাগাটা শরীরে মিশে গেল যা মুছবেনা কোনদিন।


No comments:

Post a Comment

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...