হোয়েড়া র নিয়োগী দের রথ আর কাঠালের মেলা
ক্যালেন্ডারে
আষাঢ় মাস মানেই বর্ষা। আর বর্ষা মানেই জিলিপি, পাপড় ভাজা, রথ আর রথের মেলার গল্প । তবে আজ একটু
অন্য মেলার গল্প , শোনাবো। রথের গল্প অবশ্যই আর সাথে রথ
উপলক্ষে কাঁঠাল মেলার কাহিনী।
গল্প
যখন তখন গল্পের ছলেই শুরু হোক। সময় টা ২০১৯ এর মে মাস। বাঙলার জৈষ্ঠ্য মাস। এক
বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম আমাদের এই হুগলী জেলা তেই এক স্কুল আছে যা কিনা ঈশ্বর
চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এর প্রতিষ্ঠা করা। গ্রামের নাম হোয়েড়া । পান্ডুয়া ব্লকের অন্তর্গত ছোট্ট একটা গ্রাম আর জি টি রোডের ধারে ই
সেই স্কুল। জৈষ্ঠ্য এর রোদ মাথায় যখন সেই স্কুলে পৌঁছলাম স্কুল বন্ধ , হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই এমন ঘটনা
আকচার ঘটে আমার সাথে। তবে চোখ আটকালো স্কুল টার পাশে। টিনের আবরণে ঢাকা একটা রথ।
মাহেশ বা গুপ্তিপাড়ার মতো বিশাল না হলেও খুব ছোট নয়। তখনি স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলা
শুরু এবং কথা বলে জানতে পারা এই রথ স্থানীয় নিয়োগী পরিবারে র । নিয়োগী পরিবার
শুনতেই কেমন যেন ফেলুদার গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। গ্রামের অলিগলি ঘুরে কিছুটা
গিয়েই খুঁজে পেলাম একটা রাসমঞ্চের আর তার পাশেই নিয়োগী দের বাড়ি। একটু হতাশ হলাম
আশা ছিল হয়ত কোন জমিদার বাড়ি হবে কিন্তু না নিয়োগী বাড়ি একেবারেই হাল আমলের। গেট
পেরিয়ে ঢুকতে ই আলাপ হল অরূপ নিয়োগী ও তার স্ত্রীর সাথে ,
পরিচয় সেরে রথের কথা জানতে চাইতেই উনি
আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। একটা কথা বলতেই হয়। হোড়েয়ার নিয়োগী পরিবারের
আপ্যায়ন সত্যি অতুলনীয়। সে কথাও বিস্তারে বলছি খানিক পড়ে।
বাড়ির
ভিতরে ঢুকেই চমক। রথের চূড়া, রথের
দড়ি, কাঠের ঘোড়া, ঘরের তাক জুড়ে রথের পুতুল।
কথায়
কথায় গল্প জমে উঠলো। অরূপ বাবু জানালেন এই রথের ইতিহাস। প্রায় ২০০ বছরের পুরানো
এই রথ। আর এই পুতুল, ঘোড়া সব ই সেই সময়ের। তবে এই রথে প্রভু
জগন্নাথ সাওয়াড় হন না। এই রথ নিয়োগী পরিবারের কূল দেবতা শ্রীধর জীঊ এর।
রথের
দিন নিয়োগী দের নিজ গৃহে পূজা অর্চনার পর
জাকজমক করে শ্রীধর জীঊ এর প্রতিকৃতি শালগ্রাম শীলা রথে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর শুরু
হয় রথ টান। রথ টান দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও শ্রীধর জীঊ সারাদিন রথে অবস্থান
করেন। সন্ধ্যায় আরতি র পর আবার তিনি নিয়োগী বাড়িতে ফিরে আসেন। পুন রথের দিন আবার
একই রীতি। অরূপ বাবুর সাথে গল্প করতে করতে
দুপুর গড়িয়ে গেল, রথের দিন আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সম্মতি জানিয়ে সেদিন ফিরলাম।
আবার
হোয়েড়া রথের দিন। সকাল টা গুপ্তিপাড়া র রথে কাটিয়ে দুপুরে যখন হোয়েড়া পৌঁছলাম তখন
রথের টান হয়ে গেছে। আর যে হোড়েয়ার রথ তলা কে দেখে গিয়েছিলাম এখন সে রথ তলার ছবি
বদলে গেছে। রাস্তার দু ধারে সারি সারি দোকান নানা পসরা সাজিয়ে।
আর জি টি রোড দিয়ে
হোয়েড়া মোড়ে আসতেই চোখে পড়েছিল সারি সারি কাঁঠাল ।
এই
মেলা আর রথ কে রেখে পৌঁছে গেলাম নিয়োগী বাড়িতে। আগেই বলেছি নিয়োগী বাড়ির আপ্যায়ন
এর কথা। সেই দুপুরের রথ তলার মতো নিয়োগী
বাড়ি ও যেন বদলে গেছে। বাড়ি জুড়ে প্যান্ডেল আর লোকে লোকারণ্য। এগিয়ে এলেন অরূপ
বাবু ,অভ্যর্থনা র উষ্ণতা মুগ্ধ হলাম। আলাপ
করিয়ে দিলেন পরিবারের সকলের সাথে। নিয়োগী
বাড়িতে তখন দেদার আড্ডা। সামিল হলাম সেই আড্ডা য় । মনে হচ্ছিল আমি যেন ওই পরিবারের
ই কেউ অনেক দিনের পরিচিত। দুপুরের খাওয়া সেদিন নিয়োগী পরিবারের সাথেই। সেও এলাহী
আয়োজন। আর ওনাদের আপ্যায়ন এ আমি মুগ্ধ।
এদিকে
আকাশ সাজছে কালো মেঘে। নিয়োগী পরিবারের সকল কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের
সঙ্গ নিলেন দিলীপ কাকু। দিলীপ কুমার সোম। অসাধারণ মানুষ। রথ তলায় পৌঁছে প্রথমে রথ
দেখা। ছবি তোলা। যে পুতুল গুলো সেদিন দেখেছিলাম আজ রথে সেগুলো অন্য রূপ পেয়েছে।
দুপুর তখন বিকাল আর জিলিপি, বাদাম এর গন্ধে ভরপুর তখন ভরে গেছে মেলার মাঠ।
আমার
মাথায় তখন কাঠাল ঘুরছে। দিলীপ কাকু র কাছে জানতে চাইতে ই , উনি নিয়ে গেলেন সেই
কাঠাল বিক্রেতাদের কাছে। নানান ধরনের নানান সাইজের কাঠাল। এককথায় কাঁঠালের মেলা। কাঁঠাল নিয়ে এমন মেলা আগে কোথাও দেখেছি
বলে মনে হয়না। আর কাঁঠাল
যখন আছে তখন তার গন্ধ তো থাকবেই। কথায়
কথায় জানা গেল , হোয়েড়া ও তার আশপাশের প্রচুর কাঁঠালের
চাষ হয়। স্থানীয় মানুষ জন এই রথের মেলা উপলক্ষে সেই কাঠাল নিয়ে এসে বিক্রি করেন।
বেচাকেনা ও হয় ভালো তবে এই মেলা একবেলার রথের দিন দুপুর থেকে সন্ধ্যে।
মেলা,রথ,নিয়োগী পরিবার,অভিনব কাঠাল মেলা র স্মৃতি
নিয়ে সেদিন ফিরেছিলাম। আজ ২০২০ । এক অদ্ভুত সময়ে মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা , অতিমারি
পরিস্থিতি তে সব উত্সব স্থগিত। আজ তাই স্মৃতি রোমন্থন। এই আপদকালীন সময়ে মন কে
ভালো রাখতে
নষ্টালজিয়া।সুমন্ত বড়াল