সাজি বাড়ির ঠাকুর দালানে শক্তির আরাধনা
পুজো পরিক্রমা ব্যাপার টা বেশ মজার, তবে এ পরিক্রমা প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখা নয়। এই পরিক্রমায় প্যান্ডেলের বদলে বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালান। এক একটা ঠাকুর দালান যেন এক একটা উপন্যাস। কত চরিত্র, কত কাহিনী আর সবার মধ্যমণি দূগ্গা ঠাকুর আরও কত রূপ বৈচিত্র্য, আর মানুষজন। আসলে পরিক্রমা তো অজুহাত মাত্র। পূজোর ছুতোয় আলাপ পরিচয় আর নিজেকে সমৃদ্ধ করে নেওয়া। পুজো আসছে মানেই যেমন কুমোর পাড়ায় নিত্য যাতায়াত তেমনি খোঁজ নেওয়া আশেপাশের বনেদি বাড়ি গুলির। চেনা বাড়ির ভিড়ে অচেনা অজানার খোঁজ ঠিক মিলে যায়। কিংবা পথ চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় কোন সিংহদুয়ার পেরিয়ে ঠাকুরদালান। নতুন নতুন গন্তব্য আর নতুন নতুন কাহিনী , এবারের শারদ উৎসব ব্যতিক্রমী হলেও এই বনেদি বাড়ি পরিক্রমায় ভাটা পড়েনি একইভাবে ভাটা পড়েনি বাড়ির মানুষের আদর আপ্যায়নে। তবে ওই যে বলছিলাম হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া। এই বছর ও সেই রকমই ঘটলো। আসি তাহলে সেই গল্পে।
এবছর সপ্তমীর দুপুর পেটে খিদে খিদে ভাব তখন জানান দিচ্ছে বেলা বেশ খানিকটা হলো। আসলে আবহাওয়া মেঘলা থাকলে বোঝা যায় না। সঙ্গীর অনুরোধে নির্দিষ্ট রাস্তাটা বদলে অন্য রাস্তা দিয়ে ফেরার পালা। বলতে বাঁধা নেই রাস্তা পরিবর্তন না করলে এই হঠাৎ প্রাপ্তিটা ঘটতো না। সারা দিনের ঘোরাঘুরি ক্লান্তি নিয়ে চলছি আমরা। হঠাৎই রাস্তার ধারে চোখ আটকালো একটা বড় দরজার দিকে। দরজা ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা গলি পথ জুড়ে আলপনা আর গলি পথের দু’ধারে পুরনো ইট খসা দেওয়াল। গলি পথটা মিশেছে একটা থামওয়ালা ঠাকুরদালানে যে দালান আলো করে রয়েছে দুর্গা মূর্তি। পুরো পরিবেশটা দূর থেকে দেখেই চমক লাগলো। খিদে, তেষ্টা , ক্লান্তি উধাও ভিতরে যেতেই হবে। আর ছবি তোলার শখ যখন এমন ছবি কি মিস করা যায়। দরজা পেরিয়ে বলা ভালো সিংহদুয়ার পেরিয়ে ঠাকুরদালান, লম্বা থামের মাঝে তখন দেবী মূর্তি ঢাকের আওয়াজ আর মন্ত্রোচ্চারণে মাতোয়ারা ঠাকুরদালান চত্বর। চমকালাম আবার, এই বাড়ির দেবীমূর্তি অন্যরকম এখানে মহিষাসুরমর্দিনী দেবী মা সপরিবারের রূপে নয়। অর্থাৎ দেবীর সাথে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক নেই। কিন্তু কাদের বাড়ি এইটা, কি বা এর ইতিহাস। কিছুই জানি না আমরা শুধু জানি আমরা রয়েছি হুগলির বাঁশবেড়িয়ার একটি প্রাচীন বাড়ির ঠাকুরদালানে ।
চোখে কৌতূহল নিয়ে ঠাকুর দালানের এক কোনায় আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়া। আলাপ পরিচয় সারা হলে তিনি জানালেন তিনি এই বাড়িরই প্রবীণ সদস্যা। ওনার ব্যাস্ততার কারণে ওনার নাম জানা না হলেও এই টুকু আমরা জানতে পেরেছি , আমরা রয়েছি বাঁশবেড়িয়ার বিখ্যাত সাধু পরিবারের ঠাকুর দালানে। স্থানীয় মানুষের কাছে যে বাড়ি সাজিবাড়ি নামে পরিচিত।
বাঁশবেড়িয়ার সাজিবাড়ির এই দুর্গাপুজোর সাথে জড়িয়ে রয়েছে তিনশো বছরের ইতিহাস। তখন বাংলায় সপ্তগ্রাম বন্দরের নাম জগৎ বিখ্যাত। এক দিকে সরস্বতী নদী অন্য দিকে ভাগীরথী নদী কে কেন্দ্র করে পূর্ব ভারতের নদীপথে ব্যাবসা বাণিজ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু এই সপ্তগ্রাম বন্দর। এই সময় বিহারের মুঙ্গের থেকে ব্যাবসা বাণিজ্য করার জন্য বাংলায় এলেন রামময় সাধু। তিনি শুরু করলেন সাজি মাটির ব্যাবসা। তখনও সাধু পরিবার মুঙ্গেরেই বসবাস করে। পরবর্তীতে সপ্তগ্রাম বন্দর কৌলিন্য হারালেও রামময় সাধুর সাজি মাটির ব্যাবসা ততদিনে বিস্তার লাভ করেছে। ওপর দিকে তখন ইংরেজ সরকারের জমি বন্টন নীতি শুরু হয়েছে। ঠিক এই সময় রামময় সাধু তৎকালীন বাঁশবেড়িয়ার রাজ পরিবারের সিংহাসনে রয়েছে রাজা ধ্রুব দেবরায়। সরকারি জমি বন্টননামায় এই ধ্রুব দেবরায়ের থেকে জমি ইজারা নেন রামময় সাধু। তারপর থেকেই সাধু পরিবার বিহারের মুঙ্গের থেকে বাংলার বংশবাটি, এখনকার বাঁশবেড়িয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। এই সাধু পরিবারের প্রধান ব্যাবসা ছিল সাজিমাটির। সেই কারণে সাধু পরিবারের এই বাড়ি সাজিবাড়ি নামেই পরিচিত।
সাধু পরিবারের সদস্য অতনু সাধুর কাছে তাদের পরিবারের ইতিহাস জানতে জানতে চোখের সামনে যেন সেই সপ্তগ্রাম বন্দর, সেই পুরোনো আমলের ছবি ভেসে উঠছিল। সাধুদের ঠাকুর দালান তখন যেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপট। সম্বিৎ ফিরলো ঢাকের আওয়াজে, অতীত থেকে একেবারে বর্তমানে অতনু বাবু হাসিমুখে তখনও বলে চলেছেন তাদের পারিবারিক ইতিহাসের কথা। আগেই বলেছি সাধু পরিবারের এই দুর্গা মূর্তি অন্য রকম। আসলে এই শরৎকালে দুর্গাপূজা তো অকাল বোধন। সেই অকাল বোধনের শ্রীরামচন্দ্রের পূজিত দেবী মূর্তির রূপই এই সাধু পরিবারের ঠাকুর দালানে বিদ্যমান। এখানে মূলত শক্তির আরাধনাই হয়। তবে সাধু পরিবারে বলি প্রথার চল নেই। দেবীর মহিসমর্দিনী রূপ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। কথায় গল্পে ঢাকের বোলে আশেপাশের মানুষের হৈ হুল্লোড়ের সাথে সাথে দুপুর গড়িয়ে তখন বিকাল। আগে থেকে তৈরি তালিকা জানান দিচ্ছে এখনো কয়েকটা বাড়িতে যাওয়া বাকি। কাজেই বিদায় জানাতে হবে সাধু পরিবারকে। তবে রাস্তা ভুলে তিনশো বছরের ইতিহাসের মুখোমুখি হয়ে যে অনন্য অভিজ্ঞতা হলো তা নস্টালজিয়া হয়ে থেকে যাবে।
সুমন্ত বড়াল
No comments:
Post a Comment