একটা গ্রাম আর গাজনের রাত
“ সরিয়ে অকেজো ভিড় …নিরুদ্দেশই দরকারি কাজ …
দিকশূন্যপুর থেকে হঠাত হঠাত ডাক আসে
বাড়ি তে বসে থাকতে নেই ; ভেতরে আচমকা কিছু হলে ”
কবি
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু, ওর কবিতা মনে প্রভাব ফেলবে এটা স্বাভাবিক আসলে কবির সঙ্গ দোষ আর কি।
আর এই বেড়ু বেড়ু মন কে প্রশয় দেওয়ার মানুষ ও জুটে যায়। আমার আধা মফস্বল আর আধা
শহরের মিক্সচার জীবন বড়ই ক্লান্তি কর। বার বার তাই বেরিয়ে পরা, না সামর্থ্য কম তাই কাছে পিঠেই। আর ওই
যে বললাম প্রশয় দেওয়ার মানুষ, এবার
সেই দায়িত্ব নিলো শুভঙ্কর। গত ফ্রেব্রুয়ারি মাস থেকে ও সোজা কথায় লোভ দেখাচ্ছে।
কখনো ছবি পাঠিয়ে কখনো গল্প শুনিয়ে। ওদের গ্রামের গাজন উত্সব। আর ও সেই গল্প যেন
বশীকরণ বাঁশির মত বস করল আমায় । আসলে বেড়িয়ে পড়ার অজুহাত আর কি। একটা ঝটিকা সফর।
একটা
গোটা দিন রাত মিলে জমজমাট ঘোরাঘুরি।
কাটোয়া
,ঝামটপুর বহরান , দক্ষিনখন্ড , জঙ্গলেশ্বর , সোনারুন্দি , শিরপাড়া , উদ্ধারনপুর, শাখাই। একটা দিনের পক্ষে এতগুলো নাম
যথেষ্ট মনে হয়। এর সাথে যোগ হওয়া রাত ভোরের উৎসব
।
তাহলে
ভূমিকা ছেড়ে আসি আসল কথায়। আগেই বলেছি শুভঙ্কর এর কথা। ওর আমন্ত্রণ এইবারের
বেরিয়ে পড়া। ১০ ই মে নিজের গণতান্ত্ৰিক অধিকার দান করে পর দিন একদম ভোর ভোর উঠে
পরা খাই খাই লোকালে। খাই খাই লোকাল কেন ? একটা ট্রেন যাত্রী বোঝাই,
ঘড়ি
র কাটা সকাল সাতটা ছুঁয়েছে,
ট্রেন কামরায় হাজির ফেরিওয়ালার দল। আর
তাদের সাথে, ঝালমুড়ি, সিঙ্গারা, ডালপুরি, ঘুগনী, মিষ্টি, ডিম, শশা ,ছোলা সিদ্ধ,
লস্যি হরেক রকম খাওয়ার। নানান মানুষ
নানান টেস্ট। খেতে খেতে এই সফর শেষ হয়ে যায়। খাদ্য প্রিয় মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কোন
এক অজানা কারণে মন কে বস করে মনোনিবেশ করলাম সংবাদ পত্রে যদিও পড়ার বিষয় "
বাঙালির খাদ্যের বিবর্তন " নামক একটি প্রবন্ধ। গন্তব্য প্রান্তিক স্টেশন
কাটোয়া। আসলে এই লাইন টা আমার প্রেমিকার মতো। এই লাইনের দূরত্ব, ভিড়, কোন কিছুই গায়ে লাগেনা। তিনজনের সিটে চার নম্বর ব্যক্তি হয়ে সফর করতে
আপত্তি নেই। প্রেমিকার সাথে সফর চলুক মন্দ কি। তবে সময় মেনে সফর শেষ। প্রিয়তমা
বিদায়। কাটোয়া পৌঁছালো কাটায়ো ওরফে খাইখাই
লোকাল। স্টেশন এ অপেক্ষমান শুভঙ্কর, আমাকে দেখামাত্র নির্দেশ সামনে ট্রেন দাড়িয়ে । রাজ রাজাদের আমলে যুদ্ধে আক্রমণ বললে পদাতিক সৈন্য যেমন লাফালাফি
জুড়ে দিত আমরাও তেমন অশরীরী নির্দেশে লাফিয়ে উঠলাম পরের ট্রেনে। emu লোকাল নয় সেটি আর ট্রেনে বাসে কম ওঠা
আমি ধাতস্থ হতে হতে গন্তব্য হাজির। ঝামাটপুর বাহরন , যেখানে কাটবে আগামী একটা দিন।
২
নং প্লাটফর্ম এ নেমে স্টেশন টাকে ভালো করে চোখ বোলাচ্ছি। চেয়ে দেখি এই সারা স্টেশন
জুড়ে কত মানুষ যারা এতক্ষণ আমার সহযাত্রী ছিল, সবাই আমরা এই গ্রামের উদ্দেশ্যে। এত মানুষ এই গ্রাম্য স্টেশন এ? শুভঙ্কর গলায় গর্বের ঝাঝ মিশিয়ে বলল
গাজন গাজন।
তবে
চমক টা দিলো প্লাটফর্ম থেকে নেমে সামনের
গুমটি দোকান টা। ঠিকানা তে জেলার নাম মুর্শিদাবাদ। বন্ধু কে প্রশ্ন করলাম তুমি যে
বললে পূর্ব বর্ধমান। বলল হ্যাঁ তাই তো , রেল লাইনটা পার হও। মানে যেটা দাড়াল ঝামাটপুর বাহারান এ যদি আপনি
আসেন হাওড়া থেকে তাহলে আপনি নামবেন মুর্শিদাবাদ এ কিন্তু গন্তব্য পূর্ব বর্ধমান, আরও স্পষ্ট করে বললে পূর্ব বর্ধমান এর
একটা যায়গা থেকে ট্রেন ধরবেন কিন্তু টিকিট কাউন্টার মুর্শিদাবাদ এ।
শুরুতেই
এমন গুলিয়া দেওয়া চমক বলে দিচ্ছিল সারাদিন কি আছে। মর্নিং শোজ দ্যা ডে বলে না ।
বেলা
বাড়ছে খিদে পাচ্ছে, সব আয়োজন হাজির সিংহ ভিলায় । বন্ধু
শুভঙ্কর এর বাড়ির উষ্ণ অভ্যর্থনা, ( যেটার
উষ্ণতা সারাদিনে বেড়েই গেছে) , কাকু
কাকিমার আপ্যায়ন এ গায়ের ঘাম আর ক্লান্তি দুই এর লেস মাত্র নেই। ওদিকে বাঘা ( এই
সিংহ ভিলার সিংহ মানে কুকুর) ক্রমাগত আমায়
মেপে নিচ্ছে, ও বুঝে গেছে এই প্রানী টি চাইলেও ক্ষতি
করতে পারবেনা তাই সেও চুপ। তবে ওই যে মর্নিং শোজ দা ডে,
এবার
বেড়িয়ে পড়া, আমাদের বাহন একটি বাইক। বাইক টা ভীষণ
গুরুত্ব পূর্ণ এই ভ্রমণ বেতান্তে। সাল হিসাবে ওর বয়স বেশি না হলেও অভিজ্ঞতা তে সে নুয়ে পড়েছে ,সঙ্গত এর হেলমেট জানিয়ে দিচ্ছে মাথা
যার দায়িত্ব তার, পুলিশের দিক টা উনি দেখবেন।
গাড়িতে কিক দিতেই সে জানান দিলো সে কোথাও
যেতে নারাজ ,এবার যেতে চাইলে চলো। অর্থাৎ অভিমানী
বাহনের মানভঞ্জন সাওয়ারির দায়িত্ব। আবার এ জেলা টপকে ও জেলা ।প্রসঙ্গত বলি এই
রাস্তা উন্নয়ন দ্বারা অতটা অনুপ্রাণিত হয়নি। সে যেমন ই হোক নাছোড়বান্দা মন, চলেছে। হঠাৎ শুভঙ্কর বলে ওঠে ওদিকে না
এদিকে চলো। একটা সরু রাস্তা।
(
আচ্ছা এখানে বলি ওর ডাক নাম বিচ্চু। এবার থেকে ওই নাম চলবে )
![]() |
জঙ্গলেশ্বর শিব মন্দির |
যাইহোক বিচ্চুর নির্দেশ মত পৌঁছালাম প্রথম
গন্তব্য, জঙ্গলেশ্বর শিব মন্দির। নাম মাহাত্ম্য
অনুযায়ী বিস্তৃত র্ন ধান খেতের পাশে গাছ গাছালি ঘেরা বাবা জঙ্গলেশ্বর । প্রাচীন মন্দির, মন্দিরের দালানে ভক্ত সমাগম, তবে যেটা বিশেষত্ব এই শিব মন্দিরে বলি
প্রথার চল রয়েছে। টাটকা বলির রক্ত ও চোখে পড়ল। জঙ্গলেশ্বর কে টাটা করে রওনা হওয়া
পরের গন্তব্যে। আসলে প্ল্যান টা সারাদিনের, আর গাজন তো রাতে তাই দিন নষ্ট করা যাবেনা। পৌঁছে গেলাম সোনারুন্দী ।
মুর্শিদাবাদ
এর কান্দি মহকুমার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ছোট্ট গঞ্জ সোনারুন্দী। আর এই সোনারুন্দীর
প্রধান আকর্ষণ তার ২১৩ বছরের পুরানো রাজবাড়ি। মহারাজা নিত্যানন্দ দালাল
প্রতিষ্ঠিত এই রাজবাড়ি। মোঘল সম্রাট শাহ আলমের মুন্সী নিত্যানন্দ এর প্রতিষ্ঠিত
এই রাজবাড়ি রাজবাড়ি চত্বরের মন্দির এবং চারটি তরণ। নিত্যানন্দ যার নাম দেন
বনওয়ারি বাদ। কুলদেবতা বনওয়ারি লালের নাম থেকে।
আপ্রাসঙ্গিক
হয়ে যাচ্ছে বোধহয় কারণ আজ শুধুই ভ্রমণ বেতান্ত। তবে এই রাজমহল যেকোন ভ্রমণ এর মূল
আকর্ষণ হতেই পারে। যখন এই রাজবাড়ি চত্বরে পৌছালাম তখন চোখে পড়ল তিনটে জিনিস এক
রোদ যা অনেক ক্ষনের সঙ্গী,
দুই বয়সের ভারে নুইয়ে পরা রাজমহিমা, যে কিনা পুরানো রিতি মেনে অতিথি কে
আপ্যায়ন তো করতে চায় কিন্তু বয়েসের ভারে সে চল শক্তি হারিয়ে অস্তমিত। আর শেষ
আমার ই মত একদল দর্শক তবে চোখে পড়ার কারণ তাদের বেশিরভাগই মহিলা বলেই হয়ত।অবশ্যই
রোদে তাদের সাজ বেস ঝলমলাচ্ছে।
বিচ্চু
স্থানীয় ছেলে তাই প্রবেশ নিষেধ লেখা যায়গা তে ও সুন্দর করে প্রবেশ করে যাচ্ছে, আর আমায় নিয়ে গিয়ে ফেলছে ভালো লাগার
চরম সীমায়। এই রাজবাড়ি র ঠাকুর দালানে এইভাবেই পৌঁছে স্তম্ভিত হলাম। রাজা, মন্ত্রী, পাইক, বরকন্দাজ ,লোক লস্কর কেউ নেই। আছে চত্বর জুড়ে
নিস্তব্ধতা, যেন এক রোগসজ্জায় থাকা মানুষ, চরাচর কে আপনমনে দেখছে সে চলে গেলে
একটা যুগের অবসান হবে।
![]() |
সোনারুন্দী রাজবাড়ি ঠাকুর দালান |
ঠাকুর
দালান থেকে বেরিয়ে সাপের ভয়ে আর ভিতর দিকে যাওয়া হলনা বটে কিন্তু বাইরে বেড়তে ই
চমকে দিয়ে কে যেন ডেকে উঠল। ডাকের মধ্যে অদ্ভুত এক আবদার আর প্রশয়।সেই ঝলমলে যুবতী
দের একজন। হাতে ক্যামেরা দেখে; না বিচ্চু কিছু বলেছিল সেই কারণে,
সরাসরি
এসে আবদার ছবি গুলো দেবেন? আমাকে হোয়াটস app করে
দেবেন। এই মধ্য ত্রিশে এসে এমন আবদার না করা .... বিচ্চু পাসে দাড়িয়ে ঠোঁটে মুচকি
ঝলক। আমি কিভাবে জানি না করলাম। আর ভাগ্যিস না করলাম। মনে হল ভগবান পাপ দিলেন।
কারণ যুবতী দের আবদারে ওভাবে না করতে নেই। এগিয়ে গেলাম রাজবাড়ির পুকুরের দিকে
যেখানে পেল্লাই সাইজের মাছে দের সমারোহ। এ পুকুরে কে ছিপ ফেলে না এ মাছ ধরা যায়
না। কিন্তু ভগবান ঠিক করেছেন পাপ দেবেন না। সেই মেয়েটি আবার। এবারে আবদার আরও
জোরালো ,যেন কোন অধিকার বোধ। আপনার ফোন নাম্বার টা দিন আমি কল করছি আপনার
ছবিটা নিয়ে কাজ মিটে গেলেই না হয় দেবেন।
হুমায়ুন
স্যার ,শীর্ষেন্দু বাবু ,সুনীল বাবু ,
সমরেশ স্যার এনারা এখানে
থাকলে এখান থেকেই গল্প শুরু হত। কিন্তু আমার সাথে ছিল বিচ্চু। কানের গোড়ায়
এসে বলে দাদা ভালোই ভালোই এবার চলো মামার বাড়ি যাবো।
আজকের
দুপুরের ভোজন আয়োজন বন্ধু শুভঙ্কর এর মামার বাড়ি । রাস্তায় একটা প্রাচীন পাল সেন
যুগের একটি শিব মূর্তি র দিকে বিচ্চু ভাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করালেও , ডিজের সাউন্ড , চড়া রোদ আর ক্লান্তি আর কিছু ই সায় দিচ্ছিল না।
ধরে
প্রাণ ফেরার মত ক্লান্তি কাটল, জল, কোল্ড ড্রিংকস আর আদর আপ্যায়ন এ।
দুপুরের খাবার ও হাজির কিছু পরেই। মামার বাড়ির আবদার বলে কথা ।কাসারের থালায়
পঞ্চব্যাঞ্জন আর কচি পাঠা স্বাভাবিক ভাবেই শরীরে একটা আমেজ চলে আসবেই। কিন্তু , জিরিয়ে নেওয়ার উপায় কি?
কানে
ভেসে এলো ঢাকের শব্দ , সাথে সাথে শুভঙ্কর এর হুকুম চলো ।
কিন্তু শরীর এ ১৪০ কিলোমিটার এর ক্লান্তি। একটু পরে বলতেই বিচ্চু বাবু যেভাবে
তাকাল যেন মেরে ই দেবে। কাজেই ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পরা।
রোদের
কড়া ঝাঁঝ কে পাত্তা না দিয়ে দেখি একদল মানুষ অদ্ভুত পোশাক পরে ঢাকের তালে নাচছে, কেটে গেল ক্লান্তি, আমার এই সফর এর উদ্দেশ্য তো এটাই শিব
গাজন। শুভঙ্কর হেসে বলল কেমন, উত্তর
দেওয়ার আগেই সেই ভিড় আমাদের ছুঁয়ে ফেলল। মানুষ, পোশাক, ঢাকের বোল সবকিছু কে ছাপিয়ে চোখ গেল
এক অদ্ভুত জিনিস এ , নর কঙ্কাল মুন্ড। হ্যাঁ এই মুন্ড নিয়ে
চলবে নাচ গান। আসলে এই গাজন বোলান উত্সব, শিব কে কেন্দ্র করে হলেও এতে ফুটে ওঠে সমাজ জীবনের নানা ছবি।
কয়েকটি
দলে বিকক্ত হয়ে গ্রাম্য মানুষ এরা এই উত্সব এ মেতে ওঠে, কেউ যায় বোলানের দলে, কেউ বালা ভক্ত, আবার কেউ ভুত প্রেতের মত পোশাক পরে
শশ্মান ভক্ত।
ভিড়
আমাদের কাটিয়ে চলে যেতেই আমরা ও ফিরলাম, মামার বাড়ি র মানুষ জন কে বিদায় দিয়ে এই আদর আপ্যায়ন কে যত্ন করে
স্মৃতি তে রেখে বেরিয়ে পড়া পরের গন্তব্যে। শির পাড়া এও এক ছোট্ট গ্রাম যেখানে এই গাজনের
সং দের মুখ আকা হয়। মানুষের মুখে রঙ
তুলিতে আকা শিব, কালি, রাক্ষস ইত্যাদি। এক দারুণ শিল্প কর্ম। গাজনের প্রধান আকর্ষণ বলা যেতেই
পারে , কিন্তু তাল কাটল এই এখানেই কোথা থেকে
একরাশ বিরক্তি এসে জমা হল। আসলে বলতে বাধা নেই আমরা শহুরে মানুষরা বোধহয় গ্রামের
আবহাওয়া টাকে নষ্ট করছি। যাইহোক শির পাড়া তে তখন মুখ আকা চলছে আর ভিড় করে শহুরে
ক্যামেরা ম্যানের দল। যাদের হাভভাব গ্রামের মানুষ খুব খুশী হয়নি। তাই হয়ত তাদের
মুখ থেকে বেরিয়েছে " ধুর ছাড়ত ছবি তোলা " কিংবা অশীতিপর বৃদ্ধা কে জোর
করে ছবির মডেল বানাতে চাওয়া। বিশ্বাস করুন আমিও ছবি তুলি বটে কিন্তু এভাবে নয়। তাই
বিরক্তি না বাড়িয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। শুভঙ্কর ও যথেষ্ট বিরক্ত, প্রায় গালিগালাজ এর পর্যায় নেমে গেছে
। তাই বোধহয় একটা মিষ্টির দোকান দেখে দাঁড়াতে বলল। ভাবলাম এ কি রে এই ভরদুপুরে
মিষ্টি খাবে এই তো ভাত খেল ! কিন্তু কে জানত গল্প টা অন্য রকম। দোকানের ভিতর থেকে
একজন বেরিয়ে এলো বিচ্চু বলল এ লিটার দিন। ও তাহলে কোল্ড ড্রিংকস , ভাবছি লোকটি বলল দাদা ট্যাঙ্ক টা
খুলুন। মানে, হ্যাঁ গাড়িতে পেট্রোল ভরবে। মিষ্টির
দোকানে মিষ্টি ছাড়াও ঝালমুড়ি থেকে চাউমিন দেখেছি আমাদের শহরে মিষ্টির দোকানের সাথে
রেস্টুরেন্ট আছে তাবলে পেট্রোল। হাসব না অবাক হব, শুভঙ্কর বলল মুড ঠিক হল? চিন্তা নেই এখনো রাত ফুরাই নি সং ঢং সব
হবে। এখন একটু জোরে চালাও নয়ত ঝাঁপ শুরু হয়ে যাবে। যেমন আদেশ তেমন কাজ, বিদায় মুর্শিদাবাদ এবার এন্ট্রি পূর্ব
বর্ধমান । শুভঙ্কর এর নিজের গ্রাম বহরান। সবাই পরিচিত ওর, এবং ও বেশ বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক হিসাবে, গ্রামের বুড়ো শিব তলার মড়োপ এ পৌছাতে ই
মানুষ জন ওর কাছে ছবির আবদার করতে লাগল। বিখ্যাত দের গা ঘেঁষে থাকার একটা মজা হচ্ছে নিজেকেও বিখ্যাত লাগে। তখন দুপুর
গড়িয়ে পড়ছে বিকাল, বুড়ো শিবের থানে একটু একটু করে ভিড়
বাড়ছে ভক্ত দের। আর সাথে সন্ন্যাস ভক্তদের ও , হাতে লাঠি পরনে ধুতি আর গলায় নতুন গামছা , যেটা দেখে বেশ ভালো লাগল এই ভক্ত দের
দলে মহিলাদের অংশগ্রহণ। সেই দলে গ্রামের যুবতী থেকে গৃহ বধু সকলেই রয়েছেন। এর আগে
শহর অঞ্চলে যে গাজন চরক দেখেছি তাতে মহিলা দের অংশ গ্রহণ চোখে পরেনি। বিচ্চু কে
এটা বলতেই ও বলল এই গাজন গ্রামের আত্মার উৎসব
, বহু মানুষ আসেন ভক্ত হতে তারা গ্রামের
ই মানুষ কিন্তু পেশার কাজে গ্রামের বাইরে থাকেন
, তারা হয়ত বড় কোন চাকুরিজীবী কিন্তু এই
গাজনে এসে সবাই সব পরিচয় ভুলে শুধু শিবভক্ত।
বুড়ো শিবের মোড়প |
কিছু
ক্ষণের মধ্যেই মানুষে ভরে গেল বুড়ো শিবের মোড়প
। খড়ের চাল থেকে টিনের চাল হয়েছে বটে
কিন্তু বুড়ো শিবের মন্দির মাটির। তাও কম বেশি ফুট দশের উচুঁতে, সিঁড়ি ভেঙে উঠেতে হয়।
এই
গ্রাম এ পা দেওয়া থেকে আমার মন চাইছিল কালবৈশাখী, আর এই বিকালে চোখে পড়ল পশ্চিম আকাশে মেঘ। বেজে উঠল আর ভক্তদের বুড়ো
শিবের নামে জয়ধ্বনি। শুরু হল ঝাঁপ, মূল উৎসবের আগে গা ঘামিয়ে নেওয়া আরকি। ক্যামেরা তে চোখ রেখে সেসব স্মৃতি বন্দি করতে শেষ
হল ভক্তদের ঝাঁপ। এবার এরা যাবে গ্রাম পরিক্রমায়, আর আমরা ফিরব সিংহ ভিলায়, একটু বিশ্রাম প্রয়োজন ।
পশ্চিম
আকাশে তখন মেঘের ঘন ঘটা চায়ে চুমুক আর ঠান্ডা হাওয়া তে ভর করে সন্ধ্যে নামছে, পুরো গ্রাম ডিজে বক্স এর দখলে, সব কটার শব্দ মিশে যেন এক শব্দ ব্রম্ভ।
কানের জন্য সুখকর না হলেও,
উৎসবের আবহে সবই মানিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে
একটা মনোরম পরিবেশ। ঠিক এই সময় কারেন্ট অফ। এই অঞ্চলে এটা একটা সমস্যা। কিন্তু আজ
কোন এক অজানা জাদু বলে কোন খারাপ লাগা ছুঁতে পারবেনা আমায়। ঘর ছেড়ে উঠোনে আসতেই এক
মূহুর্তে অন্য জগতে। শেষ কবে এমন নিস্তব্ধ সন্ধ্যে কাটিয়েছি। শেষ কবে এমন হাওয়ার
শব্দ শুনেছি, গাঢ় অন্ধকার এর ও যে একটা আলাদা আলো
আছে তাই বা জানতাম কই এই গ্রামে না এলে। আমার শহরে আলো নেভে না, আর নিভে গেলে মনে হয় অশরীরী রা
দাপাদাপি করছে কিন্তু এই অধার যেন ভীষণ আপন। এ অন্ধকার যেন আমার সব গোপনীয়তার
সাক্ষী। তাই হয়ত জোনাকির আলোয় মনে উকি দিচ্ছিলো কারো মুখ সে জোনাকি বড় ভালোবাসে।
যদিও ফোনে সে নট রিচেবেল। অন্ধকার এ মেঠো রাস্তা ধরে হাঁটছি , ভাবনা টাকে ঘোর বাস্তবে নিয়ে বৈদ্যুতিক
আলো ফিরল।
বিচ্চু
এক মুহূর্ত নষ্ট করতে রাজি নয়, শিরপাড়া
তে যেটা মিস হয়েছে সেই মুখ আকা দেখার পালা। গ্রামের গলি দিয়ে সে নিয়ে এলো এক
মহল্লায়। যেখানে ছোট্ট গণেশ মূর্তি র সামনে নানা বয়েসের নারী পুরুষ ছেলে মেয়ে দের
নাচ। গানের ভাষা বোঝা যাচ্ছেনা ঠিকই কিন্তু ওদের শরিরী
ভাষা বলছে উৎসবের এর সন্ধ্যে এখন।
আর
এই মন্ডপের পাশেই চলছে রঙ বেরং এর মুখ আকা, শিব দূর্গা,
রাক্ষস, খোক্কস। আসলে এটা উত্সব এর সাজ। সকলে সাজতে ব্যাস্ত আর চিত্র শিল্পী
তার হাতের কাজ দেখাতে ব্যাস্ত। চোখ গেল একটা ছোট্ট ছেলের দিকে ,বয়স দশ কি বারো। এতজন বড় র মধ্যে সেও
তার ছোট্ট হাতে নিপুণ দক্ষতায় মুখ একে চলেছে।
সাধারণত
শহুরে মানুষ এসে এদের সঙ্গে আলাপ জমায় নাম ধাম জানতে আমি এক্ষেত্রে উল্টো। তাই
ছেলেটির নাম জানা হয়নি। চাইলে জানা ই যায় বিচ্চু আছে। কিন্তু আমি ওই ছেলেটি কে মনে
রাখতে চাই শিল্পী হিসাবে। গাজনের মুখ আকতে যখনই দেখব, যেখানে দেখব ওর মুখ মনে পড়বে। মনে হবে সেই
ছেলেটার কথা। শিব গাজনে এই মুখ আকা বা সং সাজা সত্যি ভীষণ আকর্ষণীয় বিষয় তাই
বোধহয় শিরপাড়া তে ক্যামারের ভিড় ।আসলে সকলেই নতুন কিছু খুঁজছে, আমিও তো ব্যতিক্রম নই।
এই
শিল্পী দের শিল্প কর্ম স্মৃতি বন্দী করছি বিচ্চু বলল চলো দাদা, ডাকাতে কালী মন্দির টা ঘুরে আসি। আসলে
ও বোধহয় আচ করেছে আমার আলো আঁধারি গ্রাম টাকে ঘুরে দেখার ইচ্ছে।
গ্রামের
গলি ছেড়ে আমরা কাটোয়া কান্দি রোডে। অন্ধকারে চাদরে মোড়া রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে, ঝিঁঝি র ডাক কে সঙ্গে নিয়ে আমরা
পৌঁছালাম বহরান ডাকাতে কালী মন্দির চত্বরে।
ডাকাতে কালী |
একটা
মেটাল ল্যাম্পের সাদা আলো মন্দির ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পরেছে পিচ রাস্তা হয়ে ধানক্ষেতে। আর মন্দির চত্বর এর অশ্বথ গাছ আর পাশের পুকুর টাতে ছড়িয়ে দিয়েছে
গা ছম ছমে ভাব। অমাবস্যার রাত সাথে শুনশান মন্দির চত্বর। যেকোন অশরীরী গল্পের প্রক্ষাপট
হতেই পারে। কিন্তু এ গল্প যে
ভ্রমন এর গল্প। তাই ফিরে আসা। আবার
বেরিয়ে পড়া রাতের উতসবে সামিল হতে।
গ্রামের
রাস্তায় এই প্রথম দেখলাম মানুষের ভিড়। পথ চলতি মানুষ বিচ্চু কে দেখে বলে যাচ্ছে
দাদা ছবি তুলে দিও কিন্তু। অর্থাৎ আমার সঙ্গী এই গ্রামের ফটোগ্রাফার। গ্রামবাসী
দের সাথে পা এ পা মিলিয়ে আমরা পৌঁছালাম, বুড়ো শিবের মোড়পে।
বিকেলের
সেই থান আলো আধারি তে অন্যরকম। ভেপার ল্যাম্পের আলো রয়েছে তবে তা অপর্যাপ্ত। মাঝে
দাড়িয়ে বুড়ো শিবের মন্দির টা সেই মূহুর্তে যেন সব আকর্ষণ এর কেন্দ্র। এই মন্দির কে
ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে সময় ঘড়ির কাটা। ফুলে মালায় সেজে ভক্তরাও হাজির। ছোট্ট গ্রাম
তখন উৎসবে এ মাতোয়ারা। বিশ্বের কোন চিন্তাই তখন আর চিন্তা নয়। যদিও আমাদের
মুখে n95. রাত বাড়ছে উত্সব এর রঙ ধরছে।
ভক্তের দল তো ছিলোই তারা সবাই নিজেদের লাটির আগায় বেধে নিয়েছে নির্মাল্য ( এটি একটা প্রতীক স্বরুপ) , আর মন্দিরের উপর জড় হয়ে বুড়ো শিবের
নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, নীচে তখন বেস কিছু ছেলের দল ভিড় করে, সবার হাতে বাশ কিনবা লাঠি। আরে মারা
মারা হবে নাকি। কিন্তু না ঢাক বেজে উঠল আর শুরু হল উদ্দাম নিত্য। নারী, পুরুষ, ছেলে, মেয়ে বুড়ো জোয়ান সবাই নাচচ্ছে। এ যেন
সেই গানের চাক্ষুষ দর্শন -
"
শিব নাচে পার্বতী নাচে রে আরও নাচে কুচে / বিরশে উন্মত্ত হইয়া পুচ্ছ তুইলা নাচে
"
নাচতে
নাচতে শুরু হল মাশাল হাতে গ্রাম পরিক্রমা। ,তারপর জোট বেধে বুড়ো শিবের পালা গান, সে গানে ফুটে উঠল করোনা থেকে মুক্তির জন্য বুড়ো শিবের কাছে
প্রার্থনা। বুড়ো শিবের মোড়পে যখন বালাভক্ত গান চলছে তখন গ্রামের অন্য প্রান্তে তখন
শুরু হয়েছে বোলান। দেবতার নাম গান, কিংবা সমসাময়িক নানান সামাজিক
সমস্যা নিয়ে পালা গান। কিছুটা গ্রাম্য যাত্রার মত। রাত বেড়ে চলেছে আমরা
সারা গ্রাম চষে বেড়াচ্ছি,
অদ্ভুত ভাবে কিছু মানুষ অন্ধকার এর
মধ্যেও বিচ্চু কে চিনে নিচ্ছে আর ছবি তোলার অবদার করছে। নিপুণ শৈল্পিক দক্ষতায়
বিচ্চু তাদের সামাল দিচ্ছে। রাত গভীর হলে গা ছম ছম ব্যাপার হয়, গল্প গাথায় বলে রাত বিরেতে অশরীরী
আনাগোনা। রাত গভীর হতেই বুড়ো শিবের থান দখল নিলো ভুত প্রেতের দল, গাছ থেকে ঝুলন্ত মুন্ড নামিয়ে শুরু হল
তাদের শকুন নাচ। তবে এরা সকলেই জ্যান্ত ভুত। রং বের্ং এর ভুতের সাজ আর মুখে আকা
নিয়ে সকলেই বহুরূপী সং। উত্সব তখন চরম মাত্রায় কিন্তু আমাদের শরীরের শক্তি তলানি
তে। ক্লান্তির কাছে আমরা বন্দী তাই ফিরে আসা ঘরে।ফেরার
রাস্তায় গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছিল আব্দুল করিমের সেই গান ।।
“ হরেক রকম পাগল নিয়ে মিলাইছো মেলা /
বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা ”।
কিন্তু এই রাতে আর সাহস হলনা তাই গুনগুনিয়ে বাড়ি
ফেরা ।।
সুনীল
গাঙ্গুলী অনেক বছর আগেই বলে গেছেন
"
কেউ কথা রাখেনি কেউ কথা রাখেনা "
শুভঙ্কর ও কথা রাখল না। যদিও এতে ওর দোষ নেই। রাষ্ট্রের কাজে ওকে যেতেই হবে।
না ও সেনাবাহিনী তে কাজ করেনা। তাহলে ছোট করে বলে দি। কথা ছিল গাজনের পরদিন শিব
চান, গ্রাম্য ভাষায় “ লবার বাবার জল সন্ন্যাস” , দেখে বিকালে বাড়ি ফেরার। কিন্তু নিরুপায় বিচ্চু। নির্বাচন কমিশন এর
হয়ে ছবি তোলার কাজ , আগেই বলেছি ও এই অঞ্চলে বিখ্যাত। যদিও আমার কাছে বিকল্প সুযোগ ছিলো কিন্তু থাক এ
যাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে। তাই পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া, বিদায় বহরান। গাজন উত্সব সে তো মনে
থাকবেই তবে সাথে থেকে যাবে এই গ্রাম টা এই মুখ গুলো। আর স্মৃতি কে মজুত রাখতে এই
সাদা কালো অক্ষর এর সাহায্য। ফেরার সময় কাকিমা এক বাটি দই নিয়ে হাজির, দই শুভ আর শুধু মুখে বেরনো যাবেনা।
আচ্ছা ভ্রমণ বেতান্ত এভাবে শেষ করব নাকি দই এর স্বাদ যতক্ষন লেগে থাকবে চলুক না হয়।
আবার সেই স্টেশন, ট্রেনের খোজ নিতে অন্য জেলায় গিয়ে জানতে পারলাম ট্রেনের টাইম ঠিক নেই, শুভঙ্কর এর তাড়া খুব সরকারি কাজ, তাই ও বেড়িয়ে পড়ল আবার দেখা হবে, ফোন করো অসুবিধা হলে । এই প্রথম একা লাগল খুব স্টেশন চত্বরে। ইচ্ছে করলো এখনি ভিড়ে মিশে যেতে তাই ট্রেনের টিকিট থাকা সত্ত্বেও ফোন করলাম বিচ্চু কে।দায়িত্ব নিয়ে ও বুঝিয়ে দিলো রাস্তা। নির্দেশ মতো প্লাটফর্ম ছেড়ে রাস্তায় এসে টোটো সারওয়ার, সহযাত্রী রা যায়গা করে দিলেন। সকলেই এই গ্রামের মানুষ চলেছেন শিব স্নানে উদ্ধারন পুর ঘাট। আমি পরিচয় ও উদ্দেশ্য র কথা বলতেই সকলেই বলে উঠলেন চলুন কোন অসুবিধা নেই আমরা চিনিয়ে দেব।এই ঝটিকা সফর টা এই ভাবে শেষ না হলে ভীষণ বেমানান হত। এ যেন চিত্রনাট্য লেখা। আমি যেভাবে শেষ টা চাইছিলাম সেভাবে হচ্ছে। সহযাত্রী দের সাথে গল্পে মেতে গেলাম, সবুজে ঘেরা মসৃণ রাস্তা বেস মনোরম। আমার সহযাত্রী সকলেই রাত জাগা কিন্তু সবার চোখে ঘুম না উৎসব লেগে আছে, ওদের আলোচনা তে গতরাতের বোলান পালা, কিভাবে মেয়েটা কে বিয়ে দিয়ে মেরে গ্রাম প্রধান কি ফালতু জিনিস রাজনীতি। আমি শুনছে মুগ্ধ হয়ে । উৎসব আসলে কি মানুষ কে নিয়েই তো । বোধহয় আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপন এর মধ্যেই থাকে বেচে থাকাটাই উৎসব ।তাই তো জীবন প্রতিফলিত হয় উৎসবে । আমার গন্তব্য হাজির, সহযাত্রীরা বিদায় জানিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে যেতে হবে, এগিয়ে গেলাম যেখানে আমার জন্য অপেক্ষায় নৌকা, আর দুটো নদী।
বলেছিলাম না এভাবেই শেষ
হতে হয়। হ্যাঁ আমার সফর শেষ এবার, যেখানে গঙ্গার সাথে অজয় মিশেছে আমি
সেখানে এই কাহিনীর ইতি টানব, কথা
দিয়েছিলাম দই এর স্বাদ যতক্ষণ লেগে থাকবে, দই এর স্বাদ
ফিকে হল, কারণ আমার জন্য অপেক্ষায় খাইখাই লোকাল, আর সেই রাস্তা বলেছি তো প্রেমিকার মত। কাজেই এবার বরং প্রেমিকার সাথে
একটু একান্তে সময় কাটুক।