৩০০ বছরের টেরাকোটা ও তিন মন্দির
হুগলী
জেলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা মন্দির। কাল নির্নয় করতে গেলে দেখা যায়
সেসব ই বহু শতাব্দী প্রাচীন, কোন
কোন মন্দির এর বয়স তো আবার পুরোটাই অনুমানিক , তবে এই মন্দির গুলোর প্রতি আকর্ষণ এর এক অন্য কারণ রয়েছে। যে টানে
জেলার আনাচে কানাচে এই মন্দির গুলোর খোঁজ চালিয়ে যাওয়া। এই প্রাচীন মন্দির
গুলোর মধ্যে বেশীরভাগ মন্দির ই পোড়ামাটির কাজে অলংকৃত। কালের নিয়মে
, কালের ভারে সেসব কাজ আজ প্রায়
বিলুপ্তির পথে , তা
সত্ত্বেও যে অলংকরণ এই মন্দির গুলি তে রয়েছে তাও কম আকর্ষণীয় নয় ; সাড়া জেলা জুড়ে ঠিক কতগুলি মন্দির রয়েছে
তা আজানা তাই এই নানান বৈচিত্র্যে ঠাসা এই মন্দিরময় জেলার মন্দির গুলি থেকে বেছে
নেওয়া কয়েকটি মন্দির। আজকের গন্তব্য তারকেশ্বর এর তিন গ্রামের তিন মন্দির ,জয়নগর, আকনাপুর , কুলতেঘরি।
এই
তিনটি মন্দিরের মধ্যে মিল একটাই টেরাকোটা । বাকি সবই অমিল। বলা ভালো জয়নগর বা
আকনাপুরের মন্দির দুটি যেখানে সম্পুর্ন পরিত্যক্ত সেই যায়গায় কুলতেঘরির লক্ষ্মী
জনার্দনের মন্দিরটি তাদের পারিবারিক আনুকূল্যে আজও স্বমহীমায় দাড়িয়ে রয়েছে।
বর্তমানে প্রাচীনতার গায়ে রঙের প্রলেপ পড়েছে বটে কিন্তু মন্দিরের অলংকরণ গুলি
আজও নিজেদের উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
(কুলতেঘরি লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির)
তারকেশ্বর থানার
অন্তর্গত দেউলপাড়ার দিকে 4 কিলোমিটার দূরে কুলতেঘরি গ্রাম। এই
গ্রামের নাম করন নিয়ে রয়েছে এক ছোট্ট গল্প । দামোদর নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এই ছোট্ট
গ্রাম। এই গ্রাম যখন গড়ে ওঠে তখন তিন টি ঘর বা পরিবার কে নিয়ে গড়ে ওঠে। নদী কুলের
সেই তিন ঘর নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রাম কুলতেঘরি। এই ছোট্ট গ্রামের গুপ্ত পাড়া। স্থানীয়
গুপ্ত বংশের পদবী অনুসারে এই পাড়ার নাম করণ বোঝাই যাচ্ছে এই গুপ্ত পরিবার ওই
অঞ্চলের এক বর্ধিষ্ণু পরিবার। এই গুপ্ত পরিবারের নিজস্ব লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির।
যে মন্দির এই গ্রাম তথা হুগলী র টেরাকোটা মন্দিরের মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৩০০ বছরের
প্রাচীন এই মন্দির আজও স্বমহীমায় উজ্জ্বল এর জন্য অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য গুপ্ত
পরিবারের মানুষ জনের।
মন্দির চত্বরে আলাপ হল গুপ্ত বাড়ির সদস্য দের সাথে, বাড়ির মহিলা সদস্য দের আপ্যায়ন এ মুগ্ধ হলাম। আলাপ হল গুপ্ত বাড়ির সদস্য দেবাশীষ, সুমিত ও দিলীপ গুপ্ত মহাশয় দের সাথে । ওনাদের থেকে জানা গেল এই মন্দিরের ইতিহাস। লক্ষ্মী জনার্দনের এই অটচালা মন্দির নির্মাণ করেন এনাদের পূর্ব পুরুষ রাম মোহন গুপ্ত। মন্দিরের গায়ে লেখা রয়েছে দুটি নির্মাণ সাল যথাক্রমে ১৭১৪ ইং ( ১১৯৯ বঙ্গাব্দ ) এবং ১৭৫৬ ইং (১২৪১ বঙ্গাব্দ) নির্মাণ সাল অনুযায়ী এই মন্দির প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন. উচুঁ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির।
![]() |
জটায়ু |
বানর সেনার সেতু বন্ধন |
![]() |
জয়নগরের শিব মন্দির |
প্রথমে
আসি তারকেশ্বর থানার অন্তর্ভুক্ত জয়নগর এর ভড় পরিবারের আটচালা শিব মন্দিরের কথায়।
স্থানীয় ভড় পরিবারের দুটি মন্দিরের মধ্যে একটি মন্দির পুরোটাই আগাছার জঙ্গলে ভরে
গেছে যার কাল বা কোন কিছুই নির্নয় করা সম্ভব নয়। তবে ১৭৯১ সালে নির্মিত মন্দির টি
পরিত্যক্ত হলেও এখন টিকে রয়েছে। এই মন্দির টি দেখলেই বোঝা যায় একসময় এই মন্দিরের
জৌলুস কোন অংশে কম ছিলনা। বর্তমানে মন্দির টি সম্পুর্ন পরিত্যক্ত। এই মন্দিরে বিগ্রহ , শীলা বা নিত্য পুজোর কোন
প্রশ্নই ওঠে না। মন্দির টির চূড়া গাছে ঢেকেছে, মাটি ক্ষয়ের ফলে মন্দিরের ভীত ক্ষয় প্রাপ্ত। তবে লক্ষনীয় বিষয় এই
ক্ষয় প্রাপ্ত মন্দিরে এখন কিছু টেরাকোটা চোখে পড়ে। যা বেশ সুন্দর। যার মধ্যে
হনুমানের শিব পুজো কিংবা দশাবতার উল্লেখযোগ্য। তবে এই মন্দির টি খোলা মাঠের মধ্যে
অবস্থিত এবং পরিত্যক্ত হওয়ার দরুন কোন রকম রক্ষনাবেক্ষন নেই , স্থানীয় মানুষের কথায় বাইরে থেকে
মানুষ এসে অবাধে এই মন্দিরের গায়ের টেরাকোটার কাজ ভেঙে নিয়ে গেছে। যা সত্যি
চিন্তার বিষয় , তবে শীঘ্রই এই মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষনের
দিকে নজর না করেলে ভর পরিবারের এই শতাব্দী প্রাচীন কালের গহ্বর এ হারিয়ে যাবে।
![]() |
আকনাপুরের মন্দিরের টেরাকোটা |
জয়নগর
এর খুব কাছেই তারকেশ্বর থানার অন্তর্গত আর এক গ্রাম আকনাপুর, কানা দামোদর এর তীরে অবস্থিত এই ছোট্ট
গ্রাম এই আকনাপুর। এই গ্রামে কয়েকটি আটচালা মন্দির রয়েছে তবে তার মধ্যে
উল্লেখযোগ্য স্থানীয় মল্লিক পরিবারের রঘুনাথ মন্দির। ১৭৬০ ইং ( ১১৬৬ বঙ্গাব্দ) ২৬০ বছরের প্রাচীন এই মন্দির সময়ের
ভারে যতটা না পরিত্যক্ত তার চেয়ে বেশী অবহেলা তে এই মন্দিরের ভগ্নপ্রায় দশা। আগাছা
সরিয়ে এই মন্দিরের কাছে গেলে সত্যি স্তম্ভিত হতে হয় এই মন্দিরের টেরাকোটা দেখে।
মন্দির গাত্রের কাজ সবই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে , কিন্তু কিছু কাজ আজও অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। মন্দিরের
গায়ের উদ্ভিজ্জ ধর্মী অলংকরণ গুলো আজও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে , এই মন্দিরের গায়ে ফুল পাখির যে
টেরাকোটা দেখা যায় তা বেশ বিরল। তবে এই রঘুনাথ মন্দিরের উল্লেখযোগ্য টেরাকোটা হল
শকুনের ও শিয়ালের মৃত মানুষের মাংস খাওয়ার দৃশ্য। মন্দিরের অলংকরণ এ যুদ্ধের ছবি
রয়েছে সেই সূত্র ধরে এই ধরনের চিত্র কিনা সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনা। তবে বৈষ্ণব
মন্দির এর গায়ে শেয়াল শকুনের মৃত দেহ ভক্ষণ এর দৃশ্য বেশ অন্য রকম। হুগলী জেলার
আরও কিছু মন্দিরে এই ধরনের টেরাকোটা লক্ষ্য করা যায় বটে তবে এই রূপ অলংকরণ খুবই
বিরল। অযত্নে পরে থাকা এই মন্দিরের গায়ে এই কাজ কতদিন অক্ষত থাকবে সেটা সময় বলবে, তবে এই মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষন
প্রয়োজন।
শিব মন্দির এর টেরাকোটা |
রঘুনাথ মন্দির |
বর্তমানে
রঘুনাথ মন্দির টিও পরিত্যক্ত।
জেলার
আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন নানা মন্দির তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
এই মন্দির গুলো বাংলা তথা এই জেলার স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য এর নির্দশন বহন করে চলেছে।
কিছু মন্দির যত্ন ও রক্ষনাবেক্ষনে থেকে যাবে ইতিহাসে র সাক্ষী হয়ে। কিছু মন্দির
আবার কালের গহ্বর এ হারিয়ে যাবে। তাই এই সবটা কে সাদাকালো অক্ষরে সাজিয়ে রাখা
ইতিহাসের প্রামাণ্য তথ্য হিসাবে।
No comments:
Post a Comment