সম্প্রীতির গল্প বলা এক লৌকিক দেবীর থান
এক
কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। প্রতিদিন প্রতি মূহুর্ত সুস্থ ভাবে বেচেঁ
থাকাটাই যেন উৎসব। আর এই সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজ চালানো প্রায়
অসম্ভব। তবুও কাছেপিঠে খোঁজ করা আর ঘুরে দেখা। এমনই ঘরের কাছে খোঁজ পাওয়া এক
প্রসিদ্ধ থানের। এ থান মহামারী রোধ কারী দেবীর থান ( যদিও করোনা নামক মহামারীর
প্রকোপে এই থানে বাৎসরিক উৎসব দু বছর বন্ধ) , আবার এই থান হিন্দু মুসলিম সম্প্রতির এক অনন্য নজীর সৃষ্টি কারী থান
ও বটে। এককথায় পশ্চিমবঙ্গ তথা হুগলী জেলার লৌকিক দেব দেবী চর্চার ক্ষেত্রে এই থান
বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই জায়গা বা এই দেবী কে নিয়ে আলোচনা র শুরুতে আমাদের ফিরে
দেখতে হবে
১৮২২
খ্রীষ্টাব্দে র সমাচার দর্পণের একটি প্রতিবেদন এ । যেখানে বলা হয়েছে,
“মহামহাবারুণী তিথিতে চাকদহ, ত্রিবেণী ও বৈদ্যবাটীতে অনেক লোক
আসিয়াছিল। কিন্তু ইহার মধ্যে বৈদ্যবাটীতে ওলাউঠারোগে অধিক লোক মারা গিয়াছে।
ইহাতে বোধ হয় যে, ওলাউঠাও বুঝি যোগেতে বৈদ্যবাটীতে
গঙ্গাস্নান করিতে আসিয়াছিল এবং সেখানে তাহার শাসক কেহ না থাকাতে অবাধিতরূপে ঐ সকল
বিদেশীয় যাত্রিকেরদের উপর আপন পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছে।”
এই
প্রতিবেদন এ পরিষ্কার বলা হয়েছে ওলা ওঠা অর্থাৎ কলেরা রোগে মানুষ মারা যাওয়ার কথা।
বৈদ্যবাটী
র মহা বারুণী তিথির কথা। আর আমাদের প্রসঙ্গ ছিলো এক মহামারীর দেবীর থান নিয়ে। এবার
তাহলে পুরো বিষয় টাকে এক সূতোয় বেঁধে ফেলা যাক।
একসময়
বৈদ্য শ্রেণির মানুষ দের বাসস্থান ছিলো হুগলী জেলার এই প্রাচীন জনপদ বৈদ্যবাটী। এই
অঞ্চলের গঙ্গার তীর খুবই প্রসিদ্ধ স্থান। শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বর এর জল যাত্রা
পূন্যস্নান এই বৈদ্যবাটী র ঘাটেই হয়। কথিত আছে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু জলপথে ভ্রমণ
কালে এই জনপদের একটি ঘাটে বিশ্রামের জন্য আসেন। তার পাদস্পর্শে ঘাট সংলগ্ন একটি
নিম গাছে জবা ফুল ফুটে ওঠে , সেই
থেকে এই ঘাটের নাম হয় নিমাইতীর্থ ঘাট। এই নিমাই তীর্থ ঘাটের বারুণী মেলা ও সেই
মেলা কে কেন্দ্র করে লোক সমাগম ও উৎসব বহু প্রাচীন। ১৮২২ খ্রী এই বারুণী তিথি তে
আয়োজিত মেলায় বহু লোক সমাগম হয় এবং পূণ্য স্নানের উদ্দেশ্যে। আর সেই বছর এই পূণ্য
স্নানে বহুমানুষ ওলা ওঠা / কলেরা তে মারা যান। আর সেই কারণে এই নিমাইতীর্থ ঘাটের
পাশেই যাত্রাপথের, এই মরণব্যাধি র প্রকোপ থেকে বাঁচতে
ওলাওঠা মহামারী প্রতিরোধ কারী দেবী ওলাবিবি র একটি বেদী স্থাপন করা হয়। শতাব্দী
প্রাচীন সেই বেদী আজও বর্তমান, ওলাবিবির
থান নামেই যা পরিচিত।
ওলাবিবি
এক অনার্য লৌকিক দেবী। ওলাবিবি 'ওলাওঠা' অর্থাৎ কলেরা রোগের দেবী। ‘ওলা' শব্দের অর্থ 'দাস্ত নামা' এবং 'ওঠা' অর্থে 'কমন'। অর্থাৎ সে ব্যারামে দাস্ত ও বমি হয়, তাই-ই হল ‘ওলাউঠা' বা 'ওলাওঠা' ব্যাধি। এই ওলাওঠা রোগ নিরাময়ের একমাত্র দেবী ওলাবিবি। এছাড়া
জলবসস্ত, হাম, পানবসস্ত প্রভৃতি রোগে ওলাবিবির পূজা করা হয়। ‘ওলাবিবি' নাম থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইনি মুসলমানদের আরাধ্যা। তবে ওলাবিবির
পূজারী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, এমনকি শুদ্র পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং ওলাবিবি সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতির দেবী। সেই সময় নিম্ন বর্গের হিন্দু কিংবা মুসলিম রা রাস্তার ধারে, কিংবা পাতার ছাউনি তে ওলাবিবির থান
তৈরী করে এই কলেরার দেবী কে পুজো করতেন। ওলাবিবি ফুল জলেই সন্তুষ্ট। ওলাবিবির
বিগ্রহ থাকলেও তা সহজলভ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ই মাটির স্তূপ বা ঢিপি করে হিন্দু
মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ ওলাবিবির পুজো করেন।
বৈদ্যবাটী
র এই থানে ও দেবীর বিগ্রহ নেই ।থান বলতে লাল রঙে বাঁধানো একটি বেদী। সেই খানে পুজো
চলে।
তবে
বৈদ্যবাটী র এই ওলাবিবি র থান প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভিন্ন মত ও প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয়
কাজী পাড়ার মুসলমান সম্প্রদায় এর মানুষের মতে, মুর্শিদাবাদ নবাবের কোন এক আত্মীয়া এই বৈদ্যবাটী তে এসে কলেরা তে
মারা যান। পরবর্তীতে তার স্মৃতি রক্ষার্থে এই ওলাবিবির মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিষ্ঠার
কারণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও এই কথাও সত্য, কাজীপাড়ার কাজী আব্দুল মতিন ও তার পুর্বপুরুষ রা বহুদিন এই মাজারের
দেখভাল করেছেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নানা কারণ, যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা কাজী সাহেবের বয়স জনিত কারণে ১৩৭২
বঙ্গাব্দের ১৫ ই কার্তিক খাদেম কাজী আব্দুল মতিন স্থানীয় ব্যবসায়ী শম্ভু দত্ত কে
এই মাজারের দায়িত্ব সপে দেন। সেই থেকে দত্ত পরিবার এই থানের দেখভাল করে আসছে।
নানান
লোক শ্রুতি, নানান কাহিনী রয়েছে এই ওলাবিবি র থান
কে ঘিরে। এই থানে ভক্ত রা নিজেরা আসে বেদী ছুঁয়ে পুজো করিয়ে নিয়ে যায় কোন পুরোহিত
বা মৌলবির প্রয়োজন নেই এখানে। ভক্তের ভক্তিই শেষ কথা, সে যে সম্প্রদায় এর ই হোক না কেন।
বৈশাখ
মাসের শুক্লপক্ষের দুই বৃ হস্পতিবার ওলাবিবি র বাৎসরিক উৎসব পালিত হয়। এই প্রাচীন
উৎসব ঘিরে অতীতে বহু মানুষের সমাগম হত , বৈদ্যবাটী শহরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে এই ওলাবিবি র উৎসব ও মেলার কথা
জানা যায়। এই থানের পাশেই রয়েছে গঙ্গা আর পাড় বাঁধানো ওলাবিবির ঘাট ।উৎসবের দিন
ভক্তরা স্নান করে দন্ডি কেটে এই বেদী তে জল ঢেলে মনস্কামনা জানায়। সময়ের সাথে সাথে
মেলা বিলুপ্ত হয়েছে, মানুষের রোগ ব্যাধির ক্ষেত্রে দৈব
নির্ভরতা কমেছে বটে কিন্তু ওলাবিবির থানে ভক্ত দের আনাগোনা তে ভাটা পড়েনি।
বৈশাখ
মাস ছাড়াও মাঘ ও ফাল্গুন মাসে র শুক্লপক্ষ এর বৃ হস্পতিবার দেবীর বিশেষ পুজো হয়। এছাড়া
আতপ চাল ও বাতাসা দিয়ে দেবীর নিত্য পুজা ও চলে এই বেদীতে।
তবে
এই উৎসবে আগে রান্না খাওয়া লোকাচার এর প্রচলন ছিল। ভক্তরা রান্নার সামগ্রী এনে
আতপ চালের ভাত তরকারি রান্না করে দেবীকে
ভোগ দেওয়া হত। " হুগলী জেলার লৌকিক দেবতা " গ্রন্থে শ্রী কৌশিক পাল এই
বিষয়ে লিখেছেন - " বৈদ্যবাটীর
ওলাবিবি শুধু ওলাওঠা রোগের দেবী নন; তিনি জ্বর-জ্বালা, ব্যথা-বেদনা
ও পক্ষাঘাত উপশমের দেবীও বটে। সেই সঙ্গে তিনি পশুরক্ষক দেবী। প্রজননের দেবী। শস্য
উৎপাদনের সঙ্গেও তিনি জড়িত। তাঁর মাজারচত্বরে বসে 'রান্না খাওয়া'র
লোকাচার সেই ইঙ্গিতবাহী। "
লোকমুখে
জানা যায় ব্যারাকপুর এর জনৈক মৌলবি এই মাজারে এসে নিরামিষ ভোগ চড়াতেন।
ওলাবিবির
এই মাজার কে ঘিরে নানান লোকশ্রুতি র মধ্যে ঘোড়ার ছলনের কাহিনী বেস মনোজ্ঞ ।
একবার
এক স্থানীয় বাসিন্দা ট্রেনে ভ্রমণ এর সময় এক দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনা তে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও
তাঁর পা ভীষণ ভাবে জখম হয়,
এবং তিনি দেবী র কাছে প্রার্থনা করে
দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন, সেই ব্যক্তি ওলাবিবির থানে সোনার ঘোড়ার
ছলন দেন। আসলে চাল, বাতাসা, চিনি সন্দেশ প্রসাদের সাথে, পক্ষাঘাত নিরাময় কল্পে ঘোড়ার ছলন দেয়ার রীতি এই থানে প্রাচীন।
প্রসঙ্গত
বলা যায় এই অঞ্চলে বেশ কিছু কুমোর শ্রেণীর মানুষের বসবাস যারা সারা বছর মাটির নানা
সামগ্রী র সাথে মাটির ঘোড়াও তৈরী করে।
আজ
দুবছর মহামারী র প্রকোপে আর এক মহামারী র দেবীর বাৎসরিক উৎসব স্থগিত বটে, কিন্তু বহু প্রাচীন এই থানে ভক্তদের
আনাগোনা লেগেই থাকে, আসলে ভক্তি মানুষ কে বেচেঁ থাকার
লড়াইয়ে শক্তি জোগায়। আর বৈদ্যবাটী র এই ওলাবিবি র থান যেন ভক্তি, বিশ্বাস, ধর্ম বর্ণ, সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে এক বহু শতাব্দী ধরে সম্প্রীতির ভার বহন করে চলেছে।