নবান্নের দিনে চমক সফর
সফর কিংবা বেরিয়ে পরা যে নামেই ডাকি না কেন সবসময় একটা চমক থাকবেই। শীত মরসুম প্রায় শেষ তাই চুম্বকে শীত শুরুর স্মৃতি চারণ। আসলে লেখা শুরু হয়েছিল শীত শুরুতেই একপাতা লিখে হারিয়ে ফেলেছি নতুন করে যখন লিখতে বসলাম তখন কনকনে ভাব উধাও কিন্তু সফরের সেই উষ্ণতা এখনও টের পাচ্ছি। দুদিনের বেড়িয়ে পরা আর চমক লাগা কিছু ঘটনা।
ইদানীং
মন কেমন করলে সোজা বহরান। মন মেরামত করে
ফিরে আসা। হাওয়া বদল করতে উত্তর রাঢ়ে। সফর মানেই
শুরু থেকেই নানান রঙ চঙে মানুষ
আর তাদের নানা কীর্তি কলাপ। তবে এবারের সফর সূচনা বেস কিছুটা পানসে। কিছুটা রাস্তা ভীষণ কাছের মানুষের সঙ্গ পাওয়া কিন্তু শেষ অবধি নয় এমন হলে
মন কেমন তো হয় কিন্তু
আগেই বলেছি এ বার শুধু
চমক ভরা। মনের গুমোট ভাব দুর হল যখন গন্তব্য
ছুলো ট্রেন। গ্রামের
নাম যখন বহরান চমক হবেই। সওয়ারি রইল রাস্তায় সামান চড়ল গাড়ি। ঠিক এমন টা হল সন্ধ্যের
সুচনা তে। আমি আর শুভঙ্কর চা
পকোরা খেয়ে গ্রাম ভ্রমণ করে যতক্ষণে আস্তানায় ফিরলাম আমাদের সামান সযত্নে পৌঁছে গেছে টোটো চড়ে । আসলে এই ছোট্ট গ্রাম টা আমায়
বারে বারেই অবাক করে। তাই হয়ত বারবার ছুটে আসা। শুধু গ্রাম কেন। ছোট ভাই এর মতো একটা
বন্ধু আর তার বাড়ির দুজন মানুষ আর বাড়ির পোশ্য বাঘা সবাই বড় আপন করে নেয়।
সে কথা থাক
বরং পরদিন ভোরের কথায় চলে আসি। ও হ্যাঁ এবার বহরান আসার অনেক গুলো কারণ ও রয়েছে। খেজুর
রস, নবান্নের কার্তিক আর নবান্ন উৎসব
। আসলে অগ্রহায়ণ
এর নবান্নের কথা শুনেছি অনেক পড়েছি জেনেছি। স্বপন স্যারের লেখায় বারবার উঠে এসেছে এবার
তাই চাক্ষুষ করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
সন্ধ্যেবেলায়
টোটো তো চলে গেল আর আমরা হাটা পথে গ্রাম এর প্রথম শীত মেখে যখন ফিরছি তখনই চোখে পড়েছে
খেজুর গাছে হাড়ি বাধা। আর ভোরে কুয়াশা না দেখার দুঃখ নিয়ে কালীতলা পেরিয়ে যেই মূল রাস্তার
মোড়ে আসা এক অবাক করা চমক দেওয়া দৃশ্য। রাস্তার পাশে সোনালী ধানের গায়ে রাতে ঝরে পরা
শিশির সূর্যের নরম আলোয় আরমোড়া ভাঙছে আর লাল আভা মিশে যাচ্ছে সাদা ধোয়া খেজুর রসের
মিষ্টি গন্ধ নিয়ে।
গতবছর এই
ছবি র জন্য কত না কাঠ খড় পুড়িয়েছি। আর এবছর মেঘনা চাইতে জল হাতে পাঁচশো এম এল টাটকা
খেজুর রস বিনামূল্যে। সাথে নরম গরম পাটালি। আর বাকি লেন্স বন্দী দৃশ্য গুলো সে আর নাই
বা বললাম।
ঠিক তখনই
ঠিক করে ছিলাম এই সফর নিয়ে লিখতে হবে। আর নাম দেবে " একটা গ্রাম একটা উৎসব আর অনেক চমক । নামে পরিবর্তন হলেও ভাবনা পরিবর্তন
হয়নি ।
শুভঙ্কর এর
তাড়া তে ফিরতে হল যদিও তাড়া ছিল বটে। এ যে নবান্নের সকাল। উঠান জুড়ে আলপনা তে সেজেছে
গোটা গ্রাম। রাস্তা জুড়ে কচিকাঁচা দের হইচই আর বাড়িতে বাড়িতে নবান্ন খাওয়ার ধুম।
নবান্ন মানে
নতুন ধানের উৎসব। কিন্তু বিষয় টা এতটাও সরল নয় বেস গুরু পাক। নবান্ন স্থানীয় ভাষায়
লবান। এককথায় একটা দিন শুধুই খাওয়া দাওয়া।
আসলে বাঙালির ৎসব মানেই পেটপুজো। কিন্তু এই গ্রাম্য উৎসবের পেট পুজোর ধরন অন্যরকম।
নতুন ওঠা
চাল এর গুঁড়ি করে। তাতে নানা রকম ফল মিষ্টি দুধ মিশিয়ে একট মন্ড তৈরি করা এবং সেই
মন্ড দেবতা কে উত্সর্গ করার পর খাওয়া শুরু করা।
নবান্ন নামক
এই পদ টি মিষ্টি জাতীয় এবং একথা বলাই যায় যে ধরনের মিষ্টি আমরা শহুরে মানুষেরা খেয়ে
অভ্যস্থ এটা তার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম।
বহরানে একটা
পরব আর গান বাজবে না? সে আবার হয়। আসলে গান ছাড়া এ সব কিছু যেন আনোনা আলুভাতে। তবে সে গানে চমক আছে। ভাব টা
বুঝিয়ে দি। আপনি ফাঁকা মাঠে দাড়িয়ে আছেন আর নানা দিক থেকে নানা রকম গান তারসবরে চালিয়ে দেওয়া হল।
ঠিক যেমন অনুভূতি হবে এই উত্সব দিনে গানের ব্যাপার টাও ঠিক তেমন যেটা সারাদিন ব্যাপি।
তবু উঠানে রোদ মেখে স্নান, লাঞ্চে পুকুরের
কাতলা আর নানা পদের বাহার, দুপুরে পুকুর পাড়ে
গুলজারে কবিতা। সব কিছুই ভালো লাগিয়ে দেয়।
শুরু থেকেই
চমকের কথা হচ্ছে, সেই সন্ধ্যে তে একটা চমক ছিলো বটে। এই ছোট্ট গ্রাম টাকে মনে হয় সব
পেয়েছির আসর কিন্তু চমক দিয়ে ভুল ভাঙে। যখন জানতে পারি এ গ্রামে ডাক্তার এর অভাবের
কথা ওষুধ দের দোকান লেডিজ টেলার হয়ে যাওয়ার কথা। তবে ওই ভালো থাকার রসদ মজুত থাকলে
না পাওয়া গুলো গায়ে লাগেনা।
বহরান এমন
ই গ্রাম যেখানে মাষ্টার মশাই ছাত্রে জন্য অপেক্ষা করে থাকেন মাংসের দোকানে। পুরানো
ছাত্র স্যারের অনুরোধে তার বাড়ি মাংস পৌঁছে দিয়ে আসে। তবে স্যারে স্কুল যেতে পারেন।
সে গল্প থাক বরং। কারণ নবান্নের পরদিন মানে বহরানে কার্তিক পুজো।
কিন্তু মন কেমন এর কারণ আছে সেদিন সকাল অবধি ঠিক আমরা সেদিন দুপুরে ই বহরান কে টাটা করছি এবারের মত। তাড়া টা যত না আমার তার চেয়ে অনেক বেশী শ্রী শুভঙ্কর এর। ফিরতেই হবে। কিন্তু চমকপ্রদ গল্পের এই রকম অমীমাংসিত সমাপ্তি ঠিক নয়। তাই বোধহয় শুভঙ্কর এর মত পরিবর্তন আজ নয় কাল ভোরে ফেরা। তারমানে চমক এখনো বাকি। শুরু টা হল দুপুরের টোটো যাত্রায়। মিঠুন দার টোটো টাই চমকের কিছু কম না। টোটো যেখানে থামল সেখানে রাস্তাও থেমেছে। পশ্চিম আকাশ জানান দিচ্ছে আজকের দিনের আর কিছুক্ষণ বাকি।
সামনে ঈশানী নদী আর একটা জীর্ণ কাঠের সেতু। পার হতে গেলে
হাটু জলে নামতেই হবে। আসলে ভেসে যাওয়ার মজা জলে না নামলে বুঝি কেমনে। তবে ভেসে যেতে
পারলাম কই ডাঙা য় পৌঁছে গেলাম। সতী পীঠের অন্যতম কেতু গ্রামের বাহুলক্ষ্মী। পুরাণ মতে
এই স্থানে পড়েছিল সতীর বাম বাহু। ঈশানী নদীর হাটু জল ভেঙে যে মন্দিরে পৌছালাম সেটি
দেবী বাহুলক্ষ্মীর প্রাচীন মন্দির। রাজা কেতু চন্দ্র পরবর্তীতে বিগ্রহ অন্যস্থানে স্থানান্তরিত
করেন যেখানে বর্তমানে মন্দির অবস্থিত এবং সতী পীঠ নামে পরিচিত। সে যাইহোক সতী পীঠ নিয়ে
তাত্ত্বিক আলোচনা থাক। ফিরে আসি চমক সফরে। প্রাচীন এই মন্দিরে প্রাচীন বট গাছ, তার
তলায় উপবিষ্ট মহাদেব আর পশ্চিম আকাশের নিভু নিভু সূর্য। অবাক হওয়ার রসদ কিছু কম ছিলো
না।
এ সফর যে
চমকে চমকে চমকপ্রদ হয়ে ওঠবে সেদিনের সে সন্ধ্যে না এলে জানা যেত না। সতী পীঠের সফর
শেষে বহরান এ পা রাখেছি মাত্র এক অচেনা পরিবার এর আবদার তাদের পারিবারিক ছবি তুলে দিতে
হবে। আসলে এই ছোট্ট গ্রামে বিচ্ছু বাবু অর্থাৎ শুভঙ্কর কে গ্রামের ঘাস পাতা থেকে শুরু
করে গ্রামের প্রধান সবাই চেনে। সে চিনুক তাই বলে পারিবারিক ফ্যামিলি পিকচার। জীবনে
এ কাজ তো নৈব নৈব চ।তবু প্রবাসী মানুষ জন এবং তাদের বয়স্ক মা। ছবি চাই। আমার ঠিকানা
জানতে পেরে বহু মানুষের নাম করছেন তারা কিন্তু আমার কাছে সব অচেনা। আমার মাথায় আলো
কম ঘরে গ্রুপ ছবি। আর তাদের চরম বায়নাক্কা। কেন জানিনা মন বা মাথা দুই তুমুল শান্ত
ছিল। হতে পারে সেটা আকষ্মিকতার প্রভাব কিনবা প্রবাসী যুবতী দের আবদারের ছলে বলে ওঠা
আমার ছবি গুলো ভালো হয়েছে তো। নিজেকে চিত্রগ্রাহক হিসাবে দাবি না করা আমি সে সুযোগ
ছাড়ি কেন। একটা খারাপ ছবি হোক খুব খারাপ ছবি যাতে সেই মেয়ে টি যতবার সেই ছবি টা দেখবে
মনে হবে আমার কথা কিংবা হয়ত ওই কম আলোয় কোন সেরা গ্রুপ ছবি। ঘোর লাগা ভালো কিন্তু ঘোর লাগেই কাটবে বলে এবার তার ব্যাতিক্রম হলনা।
যে মেয়েটির জন্য আমি ছবি তোলা টাকে কাব্যের পর্যায় ভাবছি সে এসে বলে আচ্ছা ছবিটার
পিছনে সমুদ্র দিলে হয়না! !
আমার মন আর
মাথা নিয়ন্ত্রণ হারাবে জানা কথা। সরাসরি উত্তর আপনারা কি সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলেন যে
পিছনে সমুদ্র আসবে।
শুভঙ্কর তড়িঘড়ি
হো কার্ত্তিক হো কার্ত্তিক দেখতে হবে , এই অজুহাতে বেরিয়ে যায়। এভাবে ঘোর কাটে ধুর
ধুর, হাসি পায় মজা লাগে আর চোখে পরে হো কার্তিক। সে এক চমক বটে। আগেই বলেছি বহরানে সেদিন নবান্নের কার্তিক পুজো।
তবে সে কার্তিক পুজো হয় ঘরের শিশু সন্তান হিসাবে ।তাই এই পুজো তে দেব সেনাপতি শিশু
বেসে পরনে কাপড় নেই। এক কথায় ন্যাংটা কার্তিক। তবে হো কার্তিক অন্যতম। শতবর্ষ প্রাচীন
সে কার্তিক। বায়েন এর বাড়ির পুজো । শেষ সন্ধ্যায় যখন আমরা পৌঁছালাম তখন কার্তিক মন্ডপ
ফাঁকা। ওই যে প্রথমেই বলেছি চমক কাজেই এলাম দেখলাম চলে গেলাম সে কি করে হয়। বেস খানিকক্ষণ
অপেক্ষার পর হো কার্তিক কে এলেন বাইক চড়ে। কয়েক কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদ এর সোনারুন্দী
থেকে। আগে পায়ে হেটে মাথায় করে ঠাকুর নিয়ে আসার চল থাকলেও বর্তমানে তা আর সম্ভব হয়
না। কিন্তু সেটা চমক নয় চমক এই যে যিনি শিল্পী তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন ঠাকুর গড়ার কথা
কাজেই কাচা মূর্তি ভিজে মাটি। আসলে শিশু সন্তান রূপে পুজো কিনা শিল্পী বোধহয় সদ্যজাত
ফিল টা দিতে চেয়েছিলেন। বায়েন পরিবারে হালকা হুলুস্থুল কাটতেই যেটা চোখে পড়ল সেটা বেস
চমকপ্রদ। বহরান গ্রামে আমি যে পরিবারের অতিথি অর্থাৎ সিংহ পরিবার। তাদের এই গ্রামে
একটা আলাদা সম্মান রয়েছে। বায়েন দের ঠাকুর কিন্তু কেমন সাজবে তা ঠিক করে দিলো সিংহ
পুত্র শুভঙ্কর। আমিও অতিথি হিসাবে কিছু টুকরো সম্মান পেলাম অবশ্যই। সেই টুকরো ঝোলায়
ভরে যখন ফিরছি গ্রামে তখন মৌতাত জমেছে মন্ডপ এ ঠাকুর ঢেকে গেছে কিন্তু সাউন্ড সিস্টেম
ভীষণ ভাবে জানানা দিচ্ছে তার উপস্থিতি। এবারের সফর এ এতগুলো চমক হবে ভাবিনি এমনি সময়
কাটানোর উদ্দেশ্যে চলে আশা কিন্তু প্রাপ্তি কপালে থাকলে যা হয়।প্রথম ভার কাক ভোরে ট্রেন
শীত মেখে সহযাত্রী দের ঘুম চোখের দিকে তাকিয়ে। ফেরার পালা এবার অনেক কাজ বাকি করতে
হবে রান্নাবাটি।
ও পুনশ্চ তে একটা ইনফরমেশন দিয়ে যাই চমক ও বলতে পারেন। কাটোয়া থেকে বহরান কিংবা বহরান থেকে কাটোয়া আপনি যদি এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কাউন্টার থেকে কাটেন আপনার খরচ হবে ত্রিশ টাকা কিন্তু ওই টিকিট uts এর মাধ্যমে কাটেন তাহলে খরচ পঁাচ টাকা।