ফুলের
মরসুমে ফুল পরবে
সুমন্ত বড়াল
দিগসুই এর সাঁকো পেরিয়ে আমাদের গন্তব্য তখন ইনচুড়া মুখী ,রোদ আর ছায়া মেশানো দুপুরে লং ড্রাইভ মন্দ না। পাকড়ির বিখ্যাত কালী মন্দির পার করে কিছুটা রাস্তা যেতে চোখে পড়ল গ্রামের রাস্তায় এক বিশাল মাঠ আর একটা জমায়েত। তবে জমায়েত টা বেশ অন্যরকম। জমায়েতে হাজির ছেলে বুড়ো পুরুষ নারী সকলেই সুসজ্জিত আর সকলের হাতে হাড়ি, কড়া, খুন্তি জাতীয় রান্নার জিনিস। জমায়েত এ সাজো সাজো রব। আমার সঙ্গী বন্ধু বলে উঠল কোন সাঁওতাল পরব বুঝলি। প্রথম টায় মানতে না চাইলে ও মানতে হলো যখন দুরে সাজানো ধামসা মাদল গুলো দেখালো। সাঁওতাল পরব কিছুটা সংশয় নিয়ে এড়িয়ে গেলাম ।সেবার সেনেট এ এমন ই হয়েছিল এবার ও তাই। কিন্তু সেবার ও আমার সঙ্গী বন্ধুর উৎসাহ এবার এক প্রকার জোড়াজুড়িতেই হাজির হলাম সেই জমায়েত এর মাঠে। বলতে দ্বিধা নেই আমার বন্ধুর উৎসাহ না থাকলে অনেক কিছুই চোখের আড়ালে থেকে যেত।
মাঠে তখন বসন্তের দুপুরের কড়া রোদ, তবে সবকিছু কে উপেক্ষা করে নানা রঙিন বেশে ঝলমলে মানুষ জন বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে রান্নার আয়োজন করছে। যেন বসন্তের বনভোজন। চোখে যা পড়ছে তাতে এই বেশ কিছু মানুষ তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে রান্না খাওয়ার আয়োজন করছে। মাঠ জুড়ে রঙিন শিকলি আর কিছুটা দুরে সাজানো ধামসা মাদল। সেখান টাতে গাছের ছায়ায় ছাউনি দেওয়া কিছু একটা রয়েছে। মনে প্রশ্ন কি হচ্ছে এখানে। পথ চলতি মানুষ দের কাছে জানতে চাওয়াই সঠিক উত্তর এলোনা তবে ছোট করে উত্তর এলো " সাঁওতাল দের পুজো " । কারও থেকে কোন রকম তথ্যের আশা ছেড়ে এবার সরাসরি ক্ষেত্রসমীক্ষা। পৌঁছে গেলাম উৎসবের সেই মাঠটাতে। স্বাভাবিক ভাবেই দুই বন্ধু কে দেখে উৎসব মুখর মানুষ জন কিছুটা হতবাক। কয়েক জন এগিয়ে এলেন মনে মনে ভাবলাম যাক বেশি খানা তল্লাসি করতে হলনা। আসলে এই সাঁওতাল উৎসব গুলো সম্বন্ধে আমি একেবারেই নবিশ তাই ভীষণ ভাবে সাহায্য প্রত্যাশী। আলাপ হল বিশু বেশাই মহাশয় এর সাথে। মহিপালপুর পূর্ব পাড়ার এই সাঁওতাল সম্প্রদায় এর জগো মাঝি শ্রী বিশু বেশাই মহাশয়। " জগো মাঝি " শব্দ টা পাঠাকের খটকা লাগতে পারে তাই একটু বিস্তারিত বলা যাক। সাঁওতাল গোষ্ঠী গুলির মধ্যে আজও বহু রীতি প্রচলিত রয়েছে যা একেবারেই ওদের নিজস্ব। প্রশাসনিক ভাবে সব গ্রামেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং তার অধীনে গ্রামীণ প্রধান উপপ্রধান নির্বাচিত প্রতিনিধি রা থাকেই কিন্তু সাঁওতাল সম্প্রদায় গুলির মধ্যে এই প্রশাসনিক স্তর বিন্যাসের বাইরে ওদের নিজেদের গোষ্ঠী র মধ্যে নানা স্তর রয়েছে , নিজস্ব গোষ্ঠী র মধ্যে মোড়ল বা প্রধান, উপপ্রধান বিভিন্ন পদ রয়েছে। গোষ্ঠী র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তারাই গ্রহণ করেন। এছাড়া এই সাঁওতাল গোষ্ঠী গুলির নানা আচার অনুষ্ঠানে এনাদের বিশেষ ভূমিকা ও থাকে। গোষ্ঠীর সকলের মিলিত সিদ্ধান্তে এই প্রধান , উপপ্রধান পদাধিকারী নির্বাচিত হন। সাঁওতালি ভাষায় গোষ্ঠী প্রধান কে বলা হয় মাঝি সাধু ভাষায় মাঝি আপা। বিশেষ উল্লেখ্য এই গোষ্ঠী গুলির পুজা অনুষ্ঠানে মাঝি আপার নামে থান করে সেখানে পুজো অর্চনা করা হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায় মাঝি আপা এই সম্প্রদায় এর কাছে বিশেষ সম্মানীয়। মাঝির পরেই স্থান জগো মাঝির অর্থাৎ উপ প্রধান এর। অর্থাৎ শ্রী বিশু বেশাই মহাশয় এই মহিপাল পুর উত্তর পাড়ার এই গোষ্ঠীর উপ প্রধান।
তিনি আলাপ করিয়ে দিলেন এই গ্রামের ছেলে পূর্ণ র সাথে। পূর্ণ না থাকলে এই পুরো বিষয় টা এত সুন্দর করে বোঝাই যেতো না।
পূর্ণ সোরেন আলাপ হতেই বলে উঠল আজ আমাদের বাহা পরবে আপনাদের স্বাগত। কথায় সাঁওতালি টান ভাষা গত একটা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ওর সাথে কথোপকথনে এই ভাষার বৈচিত্র্য মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
বাহা পরব, এতক্ষণে জানা গেল এই মাঠে কি হচ্ছে। মনে পড়ল সাঁওতাল দেব দেবী দের সম্বন্ধে একটি বই তে পড়েছিলাম এই বাহা পরবের কথা। সাঁওতালি ভাষায় বাহা অর্থাৎ ফুল। এ পরব ফুলের পরব। গোটা ফাল্গুন মাস জুড়ে বিভিন্ন গ্রামে যেখানে সাঁওতাল গোত্রের মানুষের বাস তারা পালন করে এই পরব। আসলে ফাল্গুন মাস বসন্তের মাস। রং এর মাস, ফুলের মাস। বাহা পরব আসলে শাল ফুলের উৎসব। একে শালুক পরব ও বলা হয়ে থাকে। মূল উৎসবের দিনে জহর থানে অর্থাৎ মূল দেবতার আসনে পুজো পার্বণ চলে। বোঙ্গার (দেবতা) কে খুশি করতে এই উৎসব। শালফুল এদের ভাষায়- ‘সারজম বাহার’। এ উৎসবে সাঁওতালরা শালফুলকে বরণ করে নেয় কিছু আনুষ্ঠানিকতায়। তার পর সাঁওতাল মেয়েরা মাথায় নানা রঙিন ফুল দিতে পারে। বাহা পরবের আর একটা দিক বলি প্রথা। দেবতার উদ্দেশ্যে এরা মুরগি বলি দেয়। আর পুজোর পর সেই মুরগি নিয়ে চলে রান্না খাওয়া এই পরবের মাঠে। যে রান্নাবাটির ছবি দেখেই এখানে আসা।
এই কথা গুলো পূর্ণ সোরেন তার মত করে সুন্দর ভাবে ব্যাখা করতে করতে আমাদের নিয়ে এলো মূল পুজোর স্থানে ওদের ভাষায় জহর থান। তখন সবে মাত্র পুজো শেষ হয়েছে একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নীচে মূল আয়োজন। জায়গা টা সুন্দর করে নিকানো হয়েছে , দরমার ছাউনির নীচে রয়েছে তিনটি মূর্তি। মূর্তি মানে কোন দেব বিগ্রহ নয় আরাধ্য মূর্তি এখানে পাঁচমুড়ার পোড়া মাটির হাতি ও ঘোড়া। তবে হাতি টি বিশেষ উল্লেখ্য হাতির মূর্তি টি বোঙা হাতি । বোঙা হাতি সাঁওতাল গোত্রে পূজনীয় ।টেরাকোটার হাতি বানিয়ে সাঁওতালরা তাঁদের উপাস্য দেবতা সিং বোঙার কাছে উৎসর্গ করেন। সেখান থেকেই 'বোঙা হাতি' নামটা এসেছে। বোঙা হাতি নিয়ে ছোট্ট করে বলে রাখি এই টেরাকোটার হাতি প্রথম তৈরী করেন হুগলি জেলার লোকশিল্পীরা। পরবর্তী তে বাঁকুড়ার শিল্পীরা এই কাজ শিখে নেন। তবে এই বোঙা হাতি শিল্প মাধুর্যের দিক থেকে অনন্য। মল্ল রাজাদের আমলে রাজদরবারে হাতি দের নানা অলংকার এ সাজানো হত বোঙা হাতির গায়ে তাই গয়নার কারুকার্য দেখা যায় । এ যেন সেই রাজ ঘরানার প্রতিরূপ। হাতি নিয়ে বাকি কথা অন্য সময়। ফিরে আসি ফুলের উৎসবে।হাতির রহস্য উদঘাটন হল কিন্তু ঘোড়া? পূর্ণ জানালো ওই দুটি ঘোড়া সাঁওতাল তাদের জন্ম ও মৃত্যুর দেবতা মারাংবুরু ও গৃহ দেবতা আবগে বোংগা কে উৎসর্গ করে। এই দেবতার নাম প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা ঘটে গেল। পুন্য সোরেন বলে চলেছে শুদ্ধ সাঁওতালি ভাষায় আর আমার সে ভাষা বুঝতে বেস অসুবিধা হয়ে চলেছে। কিন্তু বুঝতে তো হবেই কাজেই বারবার তাকে প্রশ্ন করায় সে ভেবে বসেছে আমি বোধহয় কানে খাটো। সে গলার স্বরযন্ত্রে জোর বাড়াচ্ছে কিন্তু সমস্যা তো উচ্চারণে । যাইহোক সে ও বিরক্ত হয়নি আমি হাল ছাড়িনি।
সময় মধ্য দুপুর, রোদ জানান দিচ্ছে উপস্থিতি। মূল থান ঘিরে মানুষের জটলা আর সাজানো রয়েছেন ধামসা মাদল। আর দেব মূর্তির সামনে সাজানো বলি দেওয়া মুরগির মাথা। ঠিক এর পাশেই ঘোড়ার ছলন দেওয়া মাঝি থান এই গোষ্ঠীর প্রধান কে উৎসর্গ করে। সাঁওতাল দের কাছে গোষ্ঠী প্রধান ভগবান তুল্য।
গাজন হোক বা বাহা গ্রাম্য শহুরে যে উৎসব হোক নেশার হাতছানি থাকবেনা সে হয়। সেবার বহরানের গাজন এবারে বাহা পরব। হাড়িয়া চেখে দেখার সুযোগ এলো কিন্তু ওতে কি নেশা হয় জানিনা আমার নেশার সামান সাথেই থাকে। সেই নেশার টানেই এই রোদে সাঁওতাল উৎসবে ওদের মধ্যে মিশে তখন ছবি তুলে চলেছি ফুলের উৎসব গন্ধ আর রঙে মাতোয়ারা। ছোট্ট একটা বাচ্চা ধামসা তে বোল তুলেছে। পুন্য বিদায় নিলো। ওরা যাবে শিকার এ, এও এই উৎসবের অঙ্গ। তবে হুগলী জেলার বলাগড় এর মহিপালপুর পূর্ব পাড়ায় আর কি শিকার করবে তারা , আসলে পুরো ব্যাপার টাই প্রতীকী । কিন্তু মহিলাদের খোঁপা য় রঙিন ফুল সেটা প্রতীকী নয়। পূর্ব পাড়ার বাহা উৎসব তখন জমজমাট কড়া খুন্তি র শব্দে এক অন্য সুর ধরেছে ফাল্গুনী দুপুর। তবে আমায় ফিরতে হবে আসলে এখানে যে হঠাৎ এসে পড়া তাই তাগাদা দিলো বন্ধু। হাড়িয়া তে রুচি ছিলোনা কিন্তু বিকেলে সাঁওতাল নাচ ধামসা মাদল আর মুরগির ঝোলের আক্ষেপ সারা রাস্তা কুড়ে কুড়ে খেল। সে আক্ষেপ নিয়ে বন্ধুর কাছে চলল ঘ্যান ঘ্যান। শেষটায় রেগে সে বলে উঠল কানার মত গাড়ি চালাস, না দেখালে হতো বাহা পরব দেখতেই পেতিস না , আবার মুরগির ঝোল খাবে। কানা গাড়ি চালাক বা না চালাক আসছে বছর আবার আসছি বলাগড়ের মহিপাল্পুর পূর্ব পাড়ায় ,আসছে বছর মুরগির ঝোল আর নাচ মিস হবেনা।