পতিত পাবন
জগ্ননাথ দেবের তিনশতকের
ডাবের জলে স্নান যাত্রা
সুমন্ত
বড়াল
সময় সরণী তখন জানান দিচ্ছে সূর্যদয়ের সময় ভোর পাঁচটা বাহান্ন মিনিট। আসলে গন্তব্যে পৌঁছে জানতে পারলাম কিছুটা আগে এসে পড়েছি,
যে উদ্দেশ্যে এখানে আগমন তার এখনো দেরী আছে তাই একটু সময় কাটাতে পাশের গঙ্গার ধারে। এমন মাঝে মাঝে হয় না সব হিসাব মিলে যাওয়ার দিন। যেমন দিনের শুরু সূর্যদয়ের সাথে। আর চুচুঁড়ার ষণ্ডেশ্বর তলা এলাকা টা যেন তীর্থ ক্ষেত্র,
কত মন্দির আর কত দেবদেবী আর সুন্দর পাড় বাধানো ঘাট বেশ মন ভালো করা পরিবেশ। মুঠো ফোন জানান দিচ্ছে সময় টা কাটানো হয়েছে এবার উঠতে হবে। ঘাট থেকে ফিরব আবার গন্তব্যে ঠিক সেই সময় কানে এলো কীর্তনের সুর,
চমক লাগল। একদল মধ্যবয়সী ও প্রবীণ মহিলা দলবেঁধে কীর্তন করছেন আর সেই তালে চলছে নাচ , এ যেন স্নান যাত্রা উৎসব দিনের শুভ নান্দীমুখ। হ্যাঁ আজ জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রা। খুব সকালে বেরিয়ে পড়েছি স্নান যাত্রা দর্শনে চুচুঁড়ার ধর বাড়িতে ,স্থানীয় দের কাছে যে বাড়ি রথ বাড়ি নামে খ্যাত।
কদিন আগেই এই বাড়ির সদস্য অরূপ ধর মহাশয় এর থেকে সময় নির্ঘন্ট জানা গেছে। ষন্ডেশ্বর তলার খুব কাছেই এই ধর বাড়ি,
স্নান যাত্রা শুরুর আগে বরং এই বাড়ির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা যাক।
হুগলী জেলার সদর শহর চুঁচুড়া র বড় জগন্নাথ বাড়ি। স্থানীয় দের কাছে ধর বাড়ি কিংবা মল্লিক বাড়ি নামেও পরিচিত। সেই বাড়ির প্রভু জগন্নাথ। তবে এখানে বলভদ্র ও সুভদ্রার দেখা মেলে না। প্রভু এখানে পতিত পাবন মূর্তি তে বিরাজ মান। আনুমানিক ৩০০ বছরের পুরানো এই মূর্তি ও রথ। হুগলী জেলায় এমন পতিত পাবন রূপী মহাপ্রভুর দারুমূর্তি সত্যিই বিরল। এই পরিবারের প্রভু জগন্নাথ কে ঘিরে নানা উৎসব যেমন
রথ স্নান যাত্রা তাদের ঠাকুর দালানেই
হয় যা পরিচালনা করেন পরিবারের মানুষ জন। তবে স্থানীয় মানুষজন ও অংশগ্রহণ করেন। এই বড় জগন্নাথ বাড়িতে এসে এই পরিবারের সদস্য স্বপন ধর ও অমিত ধর মহাশয় এর সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল এই পরিবার ও রথের ইতিহাস। এই রথ ও মূর্তির সাথে যোগ রয়েছে কলকাতার রাজেন্দ্র মল্লিক এর পরিবারের। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় এই বাড়ির ভোগ নিবেদনে। সোজা রথের দিন পাঁচ রকমের খিচুড়ি দিয়ে ভোগ নিবেদন হয় প্রভুর আর উল্টো রথের দিন বাহান্ন ভোগ নিবেদনে চলে পতিতপাবন জগন্নাথ দেবের উপাচার। তবে স্নান যাত্রায় ভোগের বাহার নেই। ওই দিন পতিত পাবন ঈশ্বর কে দুধ ননী ডাবের জল ও গঙ্গা জলে স্নান করানো হয়।
এবারে স্নান শুরু হবে সকাল সাড়ে ছয়টা। পুরোহিত মশাই উপস্থিত হয়ে গর্ভগৃহ থেকে বিগ্রহ ঠাকুর দালানে আনার কাজ শুরু করেছেন। ঠাকুর দালানে উপস্থিত তখন এই পরিবারের দুজন মহিলা সদস্য যারা ব্যস্ত স্নানের উপাচার সাজাতে,
তারই ফাঁকে আমার সাথে আলাপ চারিতা চলছে। এমন মিশুকে প্রাণ উচ্ছ্বল মানুষ আমার কমই চোখে পড়েছে। ইদানীং আমার সাথে কথা হলে আমার স্বাস্থ্যের খবর সবাই নেয়। ইনি তার ব্যতিক্রম হলেন না তবে এনার আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যায়। ঠাকুর দালানে আরো দুজন মানুষ ও ছিলেন এই প্রজন্মের দু জন নবীনা। যারা সম্পর্কে দুই বোন। ইতিমধ্যে রত্নবেদী ছেড়ে ভক্ত মাঝে ঠাকুর দালানে উপস্থিত স্বয়ং প্রভু জগন্নাথ।
এখানে বলা প্রয়োজন প্রায় তিন ফুট উচ্চতার এই পতিত পাবণ দারু মূর্তি সত্যি মনমুগ্ধ কর। আর এই মূর্তির নির্মান শৈলী বেস অন্যরকম।
সদাহাস্য পুরোহিত মশাই এর মন্ত্র উচ্চারণ,
শঙ্খ,
কাঁসর , ঘন্টার সমবেত মাঙ্গলিক শব্দে শুরু হল স্নান উৎ সব।
প্রথমে ননী তারপর দুধ দিয়ে স্নান করানো হল বিগ্রহ কে। এখানে উল্লেখ্য বিষয় এটা,
ধর বাড়ির স্নান রীতি তে ননী দুধ ঘটি থেকে শাঁখের মধ্যে ঢেলে তারপর বিগ্রহের উপর ঢালা হয়। এই বাড়িতে জগন্নাথ দেবের সাথে তিনটি রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তির ও স্নান হয়। এই মূর্তি গুলি একই গর্ভ গৃহে পূজিত হয়।
দুধ ননীর পর হলুদ জল আর সাতটি ডাবের জলে স্নানের পর,
সাত ঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করে সম্পন্ন হয় প্রভুর স্নান।
ইতিমধ্যে ঠাকুর দালানে জড় হয়েছেন পরিবার এর মানুষ জন ও প্রতিবেশী। স্নান শেষে যাদের ব্যস্ততা স্নানের জল সংগ্রহে।
ত্রিশ মিনিট বা তার থেকে একটু বেশী সময় ধরে চলা এই রীতি আচারে কোন অতিশয্য চোখে পড়েনি সব টাই যেন আত্নিক। যেন পরিবারের সবার প্রিয় এক সদস্য কে পরিবারের মানুষ আদরে যত্নে তার উপাচার করছেন। আসন্ন উৎসব এর জন্য প্রস্তুতি শুরু। স্নান যাত্রার পর শুরু " অনবসরকাল"।
নিয়ম মতে স্নানযাত্রার পর জগন্নাথদেবের জ্বর আসে। তাই রথযাত্রার পর্যন্ত তিনি বিশ্রাম নেন, আবার রথের দিন আত্মপ্রকাশ করেন এবং রাজবেশে সামনে আসেন।
এখানেও এই রীতির ব্যতিক্রম নেই।
প্রভু অন্তরালে চলে গেলেন। এবার আমার ফেরার পালা। হ্যাঁ অবশ্যই ফেরার আগে রথ আর দূর্গাপুজোর আগাম নিমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম। এই বাড়ির ঠাকুর দালানে দূর্গাপুজোও হয় সেও প্রাচীন, আচ্ছা সে গল্প ও হবে সময় করে।