Tuesday, 18 June 2019

                                স্নানযাত্রায় ঘেমে স্নান

                                                         ( গুপ্তিপাড়ার স্নান যাত্রা ) 



স্নানযাত্রায় ঘেমে স্নান .. সাধারণত তথ্য ভিত্তিক লেখার গন্ডী ছেড়ে এটা অন্যরকম প্রয়াস .. তবে উদ্দেশ্য হুগলী দর্শন ..
ক্যালেন্ডারের পাতা জানান দিয়েছে ১৭জুন ২০১৯ আর ১লা আষাঢ় ১৪২৫ .. ১লা আষাঢ় কালিদাসের মেঘদূত অনুসারে বর্ষার প্রথম দিন .. যদি ও দাবদাহে পুড়ে বঙ্গবাসীর চোখে জল .. যাইহোক দিনটা কিন্তু মেঘলা ছিল .. চোখ খুলে মেঘ চোখে পড়েছিল আকাশ জুড়ে , গুমোট ভাব টা আশা জাগাচ্ছিল বৃষ্টির .. রোদ কে পরোয়া করিনা এতে মেঘ .. মন তো always পবন গতি .. সঙ্গী ক্যামেরা , জলের বোতল্ . চারটে রুমাল যেগুলো মিনি গামছা সাথে নিয়ে আমার হিরো গ্লামার পক্ষীরাজ এ সাওয়ার হলাম ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা ..
গন্তব্য আমার বাড়ি থেকে প্রায় ৭০কিমি দুরে , এই জেলার শেষ তম প্রান্ত , আমার বড় প্রিয় মফস্বল গুপ্তিপাড়া ..
উদ্দেশ্য ওখান কার শতাব্দী প্রাচীন জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রা .. প্রসঙ্গত বলে রাখি গুপ্তিপাড়ায় আমার বেশ যাতায়াত আছে ওখানকার কিছু মানুষের স্নেহ ভালোবাসায় আমি সমৃদ্ধ ।। আর এই স্নানযাত্রা উৎসব এ ও আগে গেছি ..


সে যাইহোক রওনা হলাম .. আইন না মেনে এককানে হেডফোন আর বাইকের স্পিড ৬০-৭০ ওয়েদার দারুণ মেঘলা , সাথে হাওয়া ..মনে মনে ভাবছি রোদ নিয়ে কত দুশ্চিন্তা ছিল .. রাজহাট মোড় পেরিয়ে মগরা ক্রসিং .. রেল গেট টাও আজ খোলা .. সত্যি আজ দিনটা ..
মোড় ঘুরে আমার প্রিয় আসাম রোড (stkk road ), প্রিয় গান , প্রিয় রাস্তা , ভাবনার ক্ষমতা যখন আছে তখন প্রিয় মানুষের উপস্থিতি ফিল করতেই বা সমস্যা কোথায় .. বা পাশের সবুজ মাঠ আর ডান পাশে সবুজ ঘেরা রেললাইন কে নিয়ে চললাম জিরাট ,সোমড়া , বেহুলা নদী পেরিয়ে বেহুলা মোড় কি জলদি পৌঁছে গেলাম , আসলে মেঘলা দিন যে ..
আসাম রোডে যাচ্ছি আর বেহুলা মোড়ে বিপদ দার দোকানে চা এ চুমুক দেবোনা তা হয়।। দোকানে চা এ চুমুক আর ব্রেনের গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে বেরোতেই .. প্রকৃতি তার খেলা টা খেললো .. মোক্ষম চাল .. বিশ্বাসঘাতকতা ..
বিপদ দার দোকান থেকে বেরিয়ে মাথার উপর বিপদ . মেঘ কোথায় গেল এত ঠা ঠা রোদ আর আসাম রোড জুড়ে হুহু করে লু ..
ঘড়ির কাঁটায় পাক্কা ১২টা৫ .. সিধু কাকু বলে দিয়েছেন স্নান শুরু ১টায় ..
আচ্ছা একটু বলে দি সিধু কাকু মানে শ্রী সুব্রত মন্ডল গুপ্তিপাড়ার ভীষণ পরিচিত মুখ .. দারুণ মানুষ .. গুপ্তিপাড়ায় সিধু কাকুর টানেও কিন্তু যাই ..
যাইহোক রাস্তায় ফিরি .. বিপদ দা কে বাই বাই করে এগোলাম। দাদা  জলের বোতলা টা ভরে দিলেন .. হেসে বললেন এই গরমে পাগলামো গেলনা ..
পাগলামি কি যায় ..
বেহুলা মোড় থেকে ভিতরে ঢুকে গুপ্তিপাড়া বড়বাজার .. সেখান থেকে বৃন্দাবন চন্দ্র জিঊ মঠ .. পৌঁছে গেলাম .. ভিড় রয়েছে , পুলিশ রয়েছে .. কিন্তু চেনা মুখ তো একটা ও নেই এ তল্লাটে.. কাকু ফোনে বললেন আটকে গেছেন আসছেন ..
এদিকে ঠাকুর স্নান মঞ্চে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু .. পুলিশ এর চরম নিয়ম স্নান মঞ্চে উঠতে দেওয়া যাবেনা .. মানে এতটা এলাম , এতকিছু ভাবনা সব নষ্ট হয়ে যাবে নীচে থেকে ছবি তোলা অসম্ভব .. নিজের কায়দায় বোঝানো শুরু কিন্তু পুলিশ শুনলে তো .. হঠাৎ ঢাক ঢোলের আওয়াজ জোর হতেই আমার কাধেঁ একটা হাত .. মাথা ঘুরিয়ে দেখি গেরুয়া বসন পরা , সাধুর বেশের একজন মানুষ .. সরাসরি আমায় বলছেন .. "স্নান মঞ্চে চলুন এবারে দেরী করলেন আসতে "  মঠের প্রধান গুরু জী ..
আমি যতটা না অবাক হলাম , অফিসার তার থেকে হতবাক হলেন বেশী .. আসলে গুপ্তিপাড়া আমায় নিরাশ করেনা ..
নিজের ঢাক পেটানো ছেড়ে গল্পে ফিরি ..



মঞ্চে উঠে চমক ,চমক ,চমক .. মধ্য গগনে তিনি বিরাজ করছেন. এই রকম সময়ে নিজের ছায়া টাও পড়ে না .. কোথাও ছায়া নেই .. গরম চাটুতে পা রাখলে যে অনুভুতি হবে খালি পায়ে সেই অনুভুতি . আর আমার পাঞ্জাবি ..আমি জল কখন ঢাললাম জানিনা .ভিজে জপজপে .. স্নান যাত্রা র সেই শুরু।।
মেঘলা দিনে , শীতে বা ছুটির দিনে যে পরিমাণ ক্যামেরা দেখা যায় .. এই প্রখর দুপুরে তাও সোমবার .. ক্যামেরা দেখতে পেলাম না .. আর একটা কারণ পুলিশের কড়াকড়ি .হতে ..পারে ..ক্যামেরা হাতে আমরা মোটা পাঁচজন .. তিনজনের এই প্রথম বার .. আমি আর একজন পুরানো পাপি .. তিনি হাত নেড়ে জানালেন চিনতে পেরেছেন .. কথায় কথায় একটি ছেলে প্রশ্ন করলো কেমন লাগছে দাদা .. আমার উত্তর ..
" রোদ আসলে আমার প্রেমিকা গায়ে যেটা মাখছি সেটা প্রেমিকার ছোঁয়া" ..
হাসির রোল উঠল ..নীচে তখন কীর্ত্তন এর দল নেচে বেড়াচ্ছে , শাঁখ .মন্ত্র উচ্চারণ , ভক্ত দের উল্লাস এর সাথে কোন এক যাদুবলে অনুভুতি তে দাবদাহের উপস্থিতি আর টের পাচ্ছিনা , সেই তেতে থাকা স্নান মঞ্চে বসে পড়েছি আমরা .. আর যে যার মত একের পর এক ক্লিক .. ছবি ছবি .. একটা ভালো ছবির জন্য তো এই পাগলামী ..
আরতি শেষ এলো সেই মহেন্দ্র ক্ষণ ..শুরু হল জগন্নাথ দেবের মাথায় জল ঢালা .. কাকু ও এসে পৌঁছেছেন .. নিমেষে মনে হল এ তো আমার শহর সবাই আমার ভীষণ চেনা .. আর জানিনা কোন অদ্ভুত জাদুবলে ঠিক তখন আকাশ ঢেকে গেছে মেঘে , নিমেষে উধাও সব তাপদাহ .. চারিদিকে তখন শুধু উৎসব এর উল্লাস .. অগণিত মানুষ ..
গুপ্তিপাড়ার একটি প্রথা আছে স্নানের জল সংগ্রহ ভক্তি আর বিশ্বাস মানুষ কে কতটা আপ্লুত করে এ প্রথা তার উদাহরণ ..


সে এক অবর্ননীয় ক্ষণ , মানুষের কলরব .. পিছনে বহু শতাব্দী প্রাচীন মন্দির , স্নানের জল সংগ্রহের হুড়োহুড়ি .. আর ঘটির পর ঘটি দুধ মেশানো ..জল ..
শেষ হল স্নানযাত্রা , একে একে বিগ্রহ গুলি মন্দিরে নিয়ে যাওয়া শুরু হল .. মঞ্চ ফাঁকা .. আমি একটু দাঁড়িয়ে রইলাম ..
অবশ্যই উদ্দেশ্য ছবি .. মঞ্চে তখন শুধু জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ .. ঠিক পিছনে শতাব্দী প্রাচীন রথ টা। ছবি তুলতে তুলতে মনে হল .. প্রভু জগন্নাথ দেব যেন উৎসব এর সূচনা করছেন আর বলছেন পনেরো দিন পর যখন আবার আসবো সাজিয়ে রেখো সব ..
 


শেষ হল স্নানযাত্রা .. আমার সাথী ক্যামেরা ম্যান দের সাথে আলাপ পরিচয় সেরে ,তাকিয়ে দেখি কাকু ডাকছেন ..
ফিরতে হবে এবার .. সিধু কাকুর কথা আগেই বলেছি .. শুধু মুখে তিনি কি ছাড়েন .. ঠান্ডা পানীয় আর ঠান্ডা দই খেতে খেতে ওনার শ্রী হরি গেস্ট হাউসে যখন রেস্ট নিচ্ছি .
. কাকু বললেন কালো পাঞ্জাবি পড়ে কেউ এই গরমে .. প্রায় ঘণ্টা খানেক  পর নিজের দিকে খেয়াল হল .. কালো পাঞ্জাবি .. আমার সবুজ পাঞ্জাবি পুরো ঘামে ভেজা যেটা একঝলক দেখলে কালো মনে হয় ..
আমি বললাম কালো না সবুজ .. কালচে সবুজ ঘামে ভিজে কালচে .. আসলে স্নান যাত্রা তাই ঘেমে স্নান ..
হাসতে হাসতে বিদায় জানালাম , আবার আসবো অবশ্যই আসবো .. ফেরার পথে বিপদ দার দোকান বন্ধ .. ঘামে ভেজা শরীরে কোন ক্লান্তি নেই .. আসলে এই ভেজা শরীরে যে অনেক প্রাপ্তি আছে .. ওই যে বলেছিলাম রোদ আমার প্রেমিকা ..
ঠিক তখন হেডফোনে বেজে উঠল লালনের গান
" অমৃত মেঘের বারি মুখের কথায় কি মেলে?  চাতক স্বভাব না হলে .. "


হুগলী দর্শন

Friday, 7 June 2019

সৈয়দ জালাউদ্দিন এর মসজিদ 


                                           (সৈয়দ জালাউদ্দিন এর মসজিদ এর সম্মুখ ভাগ )


প্রাচীন বাংলার এক বিখ্যাত বন্দর ছিল আমাদের এই জেলার সপ্তগ্রাম ।। সরস্বতী নদী কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র ।। চতুর্দশ শতকে সপ্তগ্রামের শাসক ফকরুদ্দিনের রাজত্বকালে আফ্রিকান পরিব্রাজক ইবন বতুতা এখানে আসেন ।। তবে কালের স্রোতে স্রোতস্বিনী সরস্বতী স্রোত হারিয়েছে এখন এই নদী কে নালা বলে ভুল হতে পারে ।। আর এই নদীর স্রোতের সাথে হারিয়েছে এই বন্দরের জৌলুষ ।। বর্তমানে সপ্তগ্রাম আদিসপ্ত গ্রাম নামে পরিচিত ।। এই জেলার প্রাচীন জনপদ ।। 
তবে সেই সময় কার স্মৃতি নিয়ে আজও আদিসপ্ত গ্রামে কিছু স্থাপত্য রয়েগেছে ।।
যেমন সৈয়দ জালাউদ্দিন এর মসজিদ ।। 

 

                                         ( সৈয়দ জালাউদ্দিন এর মসজিদ এর পশ্চাৎ ভাগ )


চতুর্দশ শতকে সপ্তগ্রামের শাসক ফকরুদ্দিনের পুত্র সৈয়দ জালাউদ্দিন এটি নির্মাণ করেন ।। মসজিদের গায়ে ১৪৫৭খ্রী( হিজরী ৮৬১ ) একটি আরবী ভাষায় লেখা শিলালিপি আজও আছে ।।
যেটি বঙ্গানুবাদ করলে যেটা হয়  -


                                           
                                                     ( আরবী ভাষায় লেখা শিলালিপি )


" মহম্মদের উক্তি এই যে, যিনি মসজিদ নির্মাণ করেন তার উপর , তার গৃহের উপর এবং তার সঙ্গীদের উপর ঈশ্বরের কৃপা সংরক্ষিত হয় ।। যিনি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন , তার জন্য ঈশ্বর স্বর্গে একটি ঘর নির্মাণ করেন "



                                                    
                                                      ( মসজিদের পাশের সমাধী ক্ষেত্র)

মসজিদ টির পাশেই একটি বাধানো স্থানে রয়েছে তিনটি সমাধী ।। এগুলি সৈয়দ জালাউদ্দিন ও তার পরিবার বর্গের সমাধী ।। 

হাওড়া থেকে বর্ধমান মেন লাইনে আদিসপ্তগ্রাম স্টেশনে নেমে অটো কিনবা টোটো তে পৌছে যেতে পারেন এই স্থানে ।। আর সড়ক পথে দিল্লী রোড ধরে আদিসপ্তগ্রাম মোড় থেকে সরস্বতী নদীর ব্রিজ পেরিয়ে কিছুটা এগোলেই ডানদিকে জি।টি রোডের উপর এই মসজিদ ।। 


( ছবি ও তথ্য - সুমন্ত বড়াল )
 

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...