Tuesday, 28 January 2020


           ধর্ম রাজের পুজো তে হুরুমের মেলা
          
              



 হুগলী জেলার লৌকিক দেব দেবী নিয়ে খোঁজ করলে জানা যাবে এই জেলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানান লৌকিক দেব দেবী । আর এই সব লৌকিক থান কে ঘিরে রয়েছে নানা কাহিনী আর বৈচিত্রে ভরা উৎসব । এই লৌকিক দেব দেবী দের নামে ও রয়েছে বৈচিত্র যেমন শুভ ঠাকুর, বসন্ত রায়, জয়চন্ডী, যোগাদ্যা আরও কত কি ?



তবে আজকের গল্প এদের নিয়ে নয়। আজকের গল্প মুন্ডখোলা গ্রামের ধর্ম ঠাকুর কে নিয়ে। ধর্ম ঠাকুর অর্থাৎ যমরাজ বা ধর্মরাজ। দেবতার বিবরণ এর আগে পথ নির্দেশ টা জানিয়ে দি। হুগলী জেলার বিখ্যাত জনপদ জিরাট। হাওড়া কাটোয়া লাইনের পরিচিত স্টেশন জিরাট। এই জিরাট স্টেশন থেকে  পাটুলির যাওয়ার রাস্তায় এই মুন্ডখোলা গ্রাম।

এবার আসি ধর্মরাজ এর কথায়। ডোম, হাড়ি, বাউড়ি, ধীবর প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা ধর্ম রাজ। বিদগ্ধ জনেরা এই ধর্ম রাজ সম্বন্ধে নানা মত দিয়েছেন ,যেমন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী র মতে ধর্ম ঠাকুর প্রচ্ছন্ন বুদ্ধদেবতা। আবার পুরাণ মতে যমের আর এক নাম ধর্মরাজ।

মুন্ডখোলা গ্রামের ধর্মরাজ "যমরূপী ধর্ম "




লোকশ্রুতি রয়েছে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে এই মুন্ডখোলা গ্রামের এক প্রাচীন পুকুর থেকে কয়েকটি ভগ্ন শিলামূর্তি এবং একটি অমসৃণ শিলাখন্ড পাওয়া যায়। এই ঘটনা গ্রামে আলোড়ন ফেলে দেয়।  কৃষ্ণ.  বর্ণের এই শিলা পরবর্তীতে ধর্মরাজ রুপে পুজিত হয়। যে পুজো আজও চলছে। আর সেই পুকুর পরিচিত হয় ধর্ম পুকুর নামে । অতীতের চালা মন্দির এখন সংষ্কার করা হয়েছে। মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষে র শুরুতেই এই মন্দিরে উত্সব শুরু হয়। চলে তিনদিন। আর এই পুজো কে কেন্দ্র করে মন্দির চত্বরে বসে মেলা। আর এই মেলাই এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ।




স্থানীয় মানুষের কাছে এই মেলার নাম " হুরুম মেলা " । ধর্ম ঠাকুরের পুজো তার নাম হুরুম মেলা?  এই প্রশ্নের উত্তরে    আছে এই হুরুম নামের মধ্যেই। হুরুম শব্দের অর্থ মুড়ি। বাংলাদেশের খুলনা, পাবনা, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় মুড়ি কে হুরুম বলা হয়। আর এই বাংলার মুন্ডখোলা গ্রামেও মুড়ি কে হুরুম নামে ডাকা হয় এই মেলায়। ধর্মরাজ পুজো উপলক্ষে এই মেলা যেন মুড়ি কে ঘিরেই। মন্দির প্রাঙ্গণে চলে মুড়ির বিকিকিনি। নানা সাইজের কুনকে তে ভরা হুরুম। তবে এই হুরুম কিন্তু সাধারণ যে মুড়ি য় তার মত না। এই মুড়ি কলমা ধানের থেকে তৈরী। কলমা ধান কুটে যে চাল হয়, সেই চাল প্রথমে সেদ্ধ করে শুকিয়ে তারপর সেই চাল মাটির খোলায় গরম বালিতে শুকনো ভেজে ধামায় ভরা হয়। শুধু মুড়ি নয়। মুড়ি তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম মাটির হাড়ি, মুড়ি  চালার মাটির চালুনি, বেতের ধামা, কুলো সবই মেলে এই মেলায়।




স্থানীয় মানুষের ভক্তি বিশ্বাস এর সাথে যেমন শয়ে শয়ে মানুষ ভিড় করেন ধর্ম ঠাকুরের থানে তেমনই বেচা কেনা চলে এই মেলায়। মাটির পুতুল ব্যবসায়ী প্রদীপ পালের সাথে কথা বলে জানা গেল ব্যবসা ভালো ই হচ্ছে এবছর। তবে আগে এই মেলা প্রাঙ্গনে ই মুড়ি ভেজে বিক্রি হলেও আজ তা বন্ধ। আজ বিক্রেতা রা বাড়ি থেকে মুড়ি ভেজে আনেন।



নানা লোকশ্রুতি নানা কাহিনী, ধর্ম ঠাকুর ধর্ম পুকুর এই উৎসব চলছে বহু দিন ধরে। অতীতে এই অঞ্চল ছিল দিল্লী সুলতানি সাম্রাজ্যের অধীনে পরবর্তী তে বর্ধমান রাজা র জমিদারি তে এই অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় ,জমিদার প্রথা বিলোপ হলে স্থানীয় মানুষ ও ভক্তদের সহায়তা তে একই ভাবে পালিত হচ্ছে এই উৎসব , যার কৌলীন্য এ ভাটা তো পড়েইনি বরং সময়ের সাথে জমজমাট হচ্ছে উত্সব। আর জমে উঠছে হুরুম এর মেলা।




 হুরুম বা মুড়ি যাই বলুন শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সবারই ভীষণ প্রিয় খাদ্য এবং যা পেট ও ভরায় , কিন্তু মুড়ি আর মুড়ি তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে এমন মেলা বোধহয় পশ্চিমবঙ্গ এ এই একটিই ।



Thursday, 16 January 2020


    কৃষ্ণপুরে মাছ নিয়ে মানুষের মেলা 





ভারী অবাক কান্ড হুগলীর আদিসপ্তগ্রামের কৃষ্ণপুরে। বৈষ্ণব মন্দিরের পাশে বসেছে মাছের মেলা।
হ্যাঁ মাছের মেলা। মেলা অর্থাৎ মিলনক্ষেত্র আর প্রত্যেক বছর মাঘের প্রথম দিনে এই অঞ্চল এক মিলন ক্ষেত্রেই পরিণত হয়। তাও এই অদ্ভুত ঘটনা কে কেন্দ্র করে।
অদিসপ্তগ্রাম স্টেশন থেকে জি টি রোড ধরে কিমি দুয়েক গিয়ে বাম হাতে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে এগোলেই কৃষ্ণপুর গ্রাম আর সবুজে ঘেরা পরিবেশের মাঝে রয়েছে  রঘুনাথ দাস গোস্বামী র আখড়া। আর এই বৈষ্ণব আখড়ার পাশেই প্রত্যেক বছর মাঘ মাসের প্রথম দিনে পালিত হয় উত্তরায়ন মেলা, যা স্থানীয় মানুষ দের কাছে মাছের মেলা নামে পরিচিত। এই বছর এই মেলার বয়স হল ৫১৩ । 


বৈষ্ণব মন্দিরের পাশে মাছের মেলা! একটু খটকা লাগে। কিন্তু এই প্রাচীন মেলার সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক প্রাচীন কাহিনী।
এই অঞ্চলের এক সময় জমিদার ছিলেন গোবর্ধন মজুমদার। এই গোবর্ধন মজুমদার এর একমাত্র ছেলে রঘুনাথ দাস গোস্বামী মাত্র ষোল বছর বয়সে ঘর ত্যাগ করেছিলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর স্মরনে। বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে দীর্ঘদিন বাদে তিনি মকরসংক্রান্তির দিনে ফিরে আসেন এই কৃষ্ণপুরে।
জমিদারের  ছেলে ফিরে এসেছেন এই আনন্দে গ্রামের মানুষ জমিদার এর কাছে দরবার করেন গ্রামের সকল মানুষকে পুকুরের মাছ ধরে পাতপেড়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঠাকুর বাড়ির উত্তর দিকে এই উত্‍সবের আয়োজন করা হয়। সেই থেকেই প্রতি বছর বসে এই মাছের মেলা ।



আবার আর এক জনশ্রুতি বলছে,   শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নীলাচল থেকে ফেরার পথে একদিন রাত কাটান এই কৃষ্ণপুরে। বৈষ্ণব হয়েও ওইদিন মাছের ঝোল দিয়ে পরম তৃপ্তিতে ভাত খেয়েছিলেন তিনি।
সেই ঘটনা কে স্মরণে রেখেই  বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ শুরু করেন এই মেলা।
তবে কাহিনী কিংবা লোকশ্রুতি যাই থাক আদিসপ্তগ্রামের কৃষ্ণপুরে র এই এক দিনের মেলা যেন মাছ মহতসব। আশপাশের বিভিন্ন যায়গা থেকে মাছের ব্যবসায়ী রা তাদের পসরা নিয়ে আসে এই মেলায়। চলে দেদার কেনাকাটা।
পরিচিত রুই, কাতলা, ভেটকি থেকে শুরু করে অচেনা হরেক রকম মাছ।
শুধু মাছ কেন কাকড়া কিনবা সামুদ্রিক প্রাণী ও বেচাকেনা হয় এই মেলায়।
কথা হল মাছ ব্যবসায়ী নেপাল দাসের সাথে তিনি এসেছেন ব্যান্ডেল থেকে। সাথে এনেছেন হরেক রকমের ভেটকি মাছ। অন্য সব মাছের ভিড়ে ও এই মেলা আলো করে রয়েছে চির প্রতিদ্বন্দ্বী চিংড়ি আর ইলিশ ।





মাছের মেলা সত্যি অন্য রকম মাছ কে কোলে নিয়ে ছবি কিংবা মাছের কানকো ধরে সেলফি ও এই মেলায় দেখা যায়। আসলে বাঙালি তো মাছ দেখে আবেক প্রবণ।
তবে এই মেলায় শুধু যে মাছ রয়েছে তা নয়। একটা গ্রাম্য মেলায় যা যা মেলে সব ই আছে এই উত্তরায়ণ মেলায়।




আর একদিনের এই মেলা স্থানীয় গন্ডী ছাড়িয়ে বিস্তার করেছে জেলার আনাচে কানাচে ।জেলার সীমানার বাইরেও। মানুষ জন মেলা ও আখড়ার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে পিকনিকের জন্য। বলাবাহুল্য সকলের মেনুতেই থাকছে মাছের পদ।
সবুজে ঘেরা মেঠো গ্রাম তার মাঝে এই বৈষ্ণব আখড়া যেখানে চলছে নাম সংকির্তন। আর পাশে রাস্তার একধারে গ্রামীণ মেলা অন্ত দিকে মাছের হাট। আর একটু এগোতেই সার বেধে মানুষ পিকনিকে মসগুল। সবমিলিয়ে মাঘের প্রথম দিনে আদিসপ্তগ্রামের কৃষ্ণপুর এ যেন মানুষের মেলা।
তবে এ মেলা একদিনের। এই বছর শেষ হয়ে গেল এ মেলা আসছে বছর আবার হবে।



ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...