ধর্ম রাজের পুজো তে হুরুমের মেলা
হুগলী জেলার লৌকিক দেব দেবী নিয়ে খোঁজ করলে
জানা যাবে এই জেলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানান লৌকিক দেব দেবী । আর এই সব লৌকিক থান কে
ঘিরে রয়েছে নানা কাহিনী আর বৈচিত্রে ভরা উৎসব । এই লৌকিক দেব দেবী দের নামে ও
রয়েছে বৈচিত্র যেমন শুভ ঠাকুর, বসন্ত রায়, জয়চন্ডী,
যোগাদ্যা আরও কত কি ?
তবে আজকের গল্প এদের নিয়ে নয়। আজকের গল্প
মুন্ডখোলা গ্রামের ধর্ম ঠাকুর কে নিয়ে। ধর্ম ঠাকুর অর্থাৎ যমরাজ বা ধর্মরাজ।
দেবতার বিবরণ এর আগে পথ নির্দেশ টা জানিয়ে দি। হুগলী জেলার বিখ্যাত জনপদ জিরাট।
হাওড়া কাটোয়া লাইনের পরিচিত স্টেশন জিরাট। এই জিরাট স্টেশন থেকে পাটুলির যাওয়ার রাস্তায় এই মুন্ডখোলা গ্রাম।
এবার আসি ধর্মরাজ এর কথায়। ডোম, হাড়ি,
বাউড়ি, ধীবর প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা ধর্ম
রাজ। বিদগ্ধ জনেরা এই ধর্ম রাজ সম্বন্ধে নানা মত দিয়েছেন ,যেমন হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী র মতে ধর্ম ঠাকুর প্রচ্ছন্ন বুদ্ধদেবতা। আবার পুরাণ মতে যমের আর এক নাম
ধর্মরাজ।
মুন্ডখোলা গ্রামের ধর্মরাজ "যমরূপী ধর্ম
"
লোকশ্রুতি রয়েছে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে এই
মুন্ডখোলা গ্রামের এক প্রাচীন পুকুর থেকে কয়েকটি ভগ্ন শিলামূর্তি এবং একটি অমসৃণ
শিলাখন্ড পাওয়া যায়। এই ঘটনা গ্রামে আলোড়ন ফেলে দেয়। কৃষ্ণ.
বর্ণের এই শিলা পরবর্তীতে ধর্মরাজ রুপে পুজিত হয়। যে পুজো আজও চলছে। আর সেই
পুকুর পরিচিত হয় ধর্ম পুকুর নামে । অতীতের চালা মন্দির এখন সংষ্কার করা হয়েছে। মাঘ
মাসের শুক্ল পক্ষে র শুরুতেই এই মন্দিরে উত্সব শুরু হয়। চলে তিনদিন। আর এই পুজো কে
কেন্দ্র করে মন্দির চত্বরে বসে মেলা। আর এই মেলাই এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ।
স্থানীয় মানুষের কাছে এই মেলার নাম "
হুরুম মেলা " । ধর্ম ঠাকুরের পুজো তার নাম হুরুম মেলা? এই প্রশ্নের উত্তরে আছে
এই হুরুম নামের মধ্যেই। হুরুম শব্দের অর্থ মুড়ি। বাংলাদেশের খুলনা, পাবনা,
বরিশাল প্রভৃতি জেলায় মুড়ি কে হুরুম বলা হয়। আর এই বাংলার মুন্ডখোলা
গ্রামেও মুড়ি কে হুরুম নামে ডাকা হয় এই মেলায়। ধর্মরাজ পুজো উপলক্ষে এই মেলা যেন
মুড়ি কে ঘিরেই। মন্দির প্রাঙ্গণে চলে মুড়ির বিকিকিনি। নানা সাইজের কুনকে তে ভরা
হুরুম। তবে এই হুরুম কিন্তু সাধারণ যে মুড়ি য় তার মত না। এই মুড়ি কলমা ধানের থেকে
তৈরী। কলমা ধান কুটে যে চাল হয়, সেই চাল প্রথমে সেদ্ধ করে শুকিয়ে
তারপর সেই চাল মাটির খোলায় গরম বালিতে শুকনো ভেজে ধামায় ভরা হয়। শুধু মুড়ি নয়।
মুড়ি তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম মাটির হাড়ি, মুড়ি
চালার মাটির চালুনি, বেতের ধামা, কুলো সবই মেলে
এই মেলায়।
স্থানীয় মানুষের ভক্তি বিশ্বাস এর সাথে যেমন
শয়ে শয়ে মানুষ ভিড় করেন ধর্ম ঠাকুরের থানে তেমনই বেচা কেনা চলে এই মেলায়। মাটির
পুতুল ব্যবসায়ী প্রদীপ পালের সাথে কথা বলে জানা গেল ব্যবসা ভালো ই হচ্ছে এবছর।
তবে আগে এই মেলা প্রাঙ্গনে ই মুড়ি ভেজে বিক্রি হলেও আজ তা বন্ধ। আজ বিক্রেতা রা
বাড়ি থেকে মুড়ি ভেজে আনেন।
নানা লোকশ্রুতি নানা কাহিনী, ধর্ম
ঠাকুর ধর্ম পুকুর এই উৎসব চলছে বহু দিন ধরে। অতীতে এই অঞ্চল ছিল দিল্লী সুলতানি
সাম্রাজ্যের অধীনে পরবর্তী তে বর্ধমান রাজা র জমিদারি তে এই অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় ,জমিদার
প্রথা বিলোপ হলে স্থানীয় মানুষ ও ভক্তদের সহায়তা তে একই ভাবে পালিত হচ্ছে এই
উৎসব , যার কৌলীন্য এ ভাটা তো পড়েইনি বরং সময়ের সাথে জমজমাট হচ্ছে উত্সব। আর
জমে উঠছে হুরুম এর মেলা।
হুরুম বা মুড়ি যাই বলুন শীত, গ্রীষ্ম,
বর্ষা সবারই ভীষণ প্রিয় খাদ্য এবং যা পেট ও ভরায় , কিন্তু
মুড়ি আর মুড়ি তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে এমন মেলা বোধহয় পশ্চিমবঙ্গ এ এই একটিই ।