রান্না আর খাওয়া মিলেমিশে একটা গ্রাম্য মেলা
সুমন্ত বড়াল
গত বছরের কথা , ঠিক কি কারণে ওই রাস্তায় গিয়েছিলাম
মনে নেই তবে তারিখ টা বেশ মনে আছে ২ রা চৈত্র। চুঁচুড়া ধনিয়াখালি রোড ধরে চলেছি
। আমনান, হারিট, সাইয়া পার হয়ে হঠাৎ বা হাতে চোখে পড়ল
একটা জোড়বাঙলো মন্দির আর ছোট্ট ভাঙা মেলা। ওই রাস্তায় আগেও গিয়েছি কিন্তু কোন
কারণে নজর এড়িয়ে গিয়েছিল বোধহয় কিন্তু এবার বাইক থামিয়ে ভীতরে ঢোকা। ভিতরে ঢুকে
অবাক কান্ড দেখি পুরো মন্দির চত্বর জুড়ে ছোট বড় উনুন খোঁড়া আর কালো ছাই। যেন অনেক
মানুষ মিলে পিকনিকের আয়োজন। প্রচন্ড কৌতুহল ব্যাপার টা কি?
উল্টো
দিকের চায়ের দোকান দেখে দৌড়ে গেলাম গিয়ে যা শুনলাম তা শুনে একটা কথা মুখ দিয়ে বের
হলো " যা মিস হয়ে গেল " ।
তাই
এবছর আর মিস নয় ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন সেই মেলা। সেনেটের বিশালাক্ষী তলার রান্না
খাওয়া মেলা। আমার বাড়ি থেকে বিশেষ দুর নয় সেনেট আর গত একবছরে বহুবার গিয়েছি ও ওই
রাস্তায়। চুঁচুড়া র সুগন্ধ্যা মোড় থেকে সাতেরো কিলোমিটার সেনেটের বিশালাক্ষী
মন্দির।
প্রায়
দুশো বছরের পুরাণো এই মন্দির। মন্দিরের গায়ে প্রতিষ্ঠার সাল ১২২৯ বঙ্গাব্দ লেখা
রয়েছে। অর্থাৎ ইংরেজি 1822 সালে এই মন্দির নির্মিত। মন্দির টি এই
বাংলার নিজস্ব চালা স্থাপত্য ধারা র একটি মন্দির ,তবে মন্দির টি জোড় বাঙলা রীতির মন্দির। এই জোড় বাঙলা মন্দির হুগলী
জেলায় যেকটি অবস্থিত রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। মন্দিরের সামনে রয়েছে ঢাকা নাট
মঞ্চ। তবে বর্তমানে মন্দির টিতে আধুনিক টাইলস বসানোর দরুণ প্রাচীন সৌন্দর্য নষ্ট
হয়েছে। ত্রিখিলান বারান্দা পেরিয়ে গর্ত গৃহ। সেখানে রয়েছেন দেবী বিশালাক্ষী। দেবী
মূর্তি টি বেশ আকর্ষণীয়।
দেবীর বিশাল মূর্তিটি দ্বিভুজা। মন্দিরের মধ্যে প্রথম স্তরে বিশালাক্ষী র দক্ষিণে মহাদেব ও বামে
রামচন্দ্র। আর তার পিছনে মহাদেবের অনুচর ভূতপ্রেতাদি। দ্বিতীয় স্তরে দক্ষিণ পাশে লক্ষ্মী আর বামে
আছেন সরস্বতী। আর তৃতীয় স্তরে দক্ষিণে
গণপতি ও বামে কার্ত্তিক। স্থানীয় হালদার বংশ এই মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় একশো বছর
আগে এই দেবী কে প্রতিষ্ঠা করেন। আর এই দেবীর সাথে জড়িয়ে রয়েছে দারুণ এক কিংবদন্তি।
মন্দিরের
পাশেই রয়েছে বিশাল পুরান পুকুর। সেই পুকুরের ধারে দেবী নাকি কুমারী র বেসে এক
শাঁখারি র কাছ থেকে শাখা পড়ে দাম আনতে যাচ্ছি বলে স্থানীয় হালদার বাড়িতে চলে জান।
শাঁখারি হালদার বাড়ি পৌঁছে মেয়ে টির কথা বললে হালদার কর্তা অবাক হন কারণ তিনি
ছিলেন অপুত্রক। সেই রাতে হালদার মহাশয় স্বপ্ন পান যে পুরাণ পুকুরে দেবীর শাখা পড়া
হাত দেখতে পাবে এবং দেবী কে ওখানে প্রতিষ্ঠা করতে। হালদার মহাশয় ওই স্থানে দেবীর
সুন্দর দবীভূজা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিহাস, কিংবদন্তি তে ঘেরা সেনেটের বিশালাক্ষী
আর সেই আকর্ষণীয় মেলা। যে কথা বলছিলাম।
ফাল্গুন
এর সংক্রান্তি ইংরেজি ১৪ ই মার্চ। সকাল ১১ বাড়ি থেকে রওনা হলাম। সাথে বন্ধু সৌরভ।
চারিদিকে ভাইরাস ভাইরাস গল্প। কিন্তু আমাদের মাথায় সেনেট এর সেই মেলা। সৌরভ
কে আগেই বলেছি গতবারের অভিজ্ঞতা , ওর উৎসাহ চরমে। সুগন্ধ্যা মোড় থেকে চুঁচুড়া ধনেখালি
রোড ধরে এগোতে শুরু করলাম। দমকা হাওয়া তে রোদ তেমন গায়ে লাগছে না। আর রাস্তার দু
ধারে সেই হাওয়া কচি ধান গাছ এর সাথে খেলা করে যাচ্ছে। সৌরভ এর কথায় এখানে সবুজ আর
সবুজ এই অক্সিজেনে ভাইরাস আসতে লজ্জা পাবে। যাইহোক আমনান, হারিট, সেইয়া পেরিয়ে সেনেট। দুর থেকে চোখে পড়ল মন্দিরের চুড়া আর কাছে
পৌঁছতেই গ্রামীণ মেলা। মেলা দেখেই সৌরভ চলল রঙিন চুড়ি কিনতে। আর আমি ওকে টেনে নিয়ে
গেলাম মন্দির চত্বরে। দুজনেই অবাক। বেশ ভিড়। অনেক মানুষ মন্দির কে ঘিরে। দুজনই বলে
উঠলাম পিকনিক হচ্ছে নাকি এখানে।
গতবারের
যে দৃশ্য দেখে অবাক হয়েছিলাম এবার সেই দৃশ্য যেন পরিপূর্ণ তা পেল। সারা মন্দির
চত্বর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খোঁড়া হয়েছে ছোট বড় নানান সাইজের উনুন ,যাতে চাপানো কোথাও কড়া কোথাও হাড়ি। কোন
উনুন থেকে গরম ভাতের গন্ধ কোন উনুনে মশলা কষা চলছে।
মন্দিরের বারান্দা আর
নাটমন্দির ভক্ত দের দখলে। গর্ভ গৃহ তে দেবী দর্শন বেস কষ্ট কর। তবে ঠেলে ঠুলে
ক্যামেরা উঁচিয়ে ভিতরে পৌঁছে দর্শন পাওয়া গেল। মন্দির থেকে ছবি তুলে নীচে নামতেই
দেখি সৌরভ দু হাতে লেবু বরফ নিয়ে দাড়িয়ে। রোদে লেবু বরফে চুমুক বেস লাগছিল। আর চোখ
খুজছিল ছবির সাবজেক্ট। কত মানুষ কত মুখ ভঙ্গি তবে একটা বিষয় কমন। সবার মুখে হাসি
আর সবার মেজাজে উৎসব । মিশে গেলাম মানুষের মধ্যে ফোড়নের
ঝাঁঝালো গন্ধে চোখ মেলা দায়। কত মানুষ কেউ এসেছেন পান্ডুয়া থেকে কেউ পাশেই এক
গ্রাম থেকে, আবার কেউ ধনেখালি। হঠাৎ আলাপ হল
চুঁচুড়া র গুরুদাস বাবুর সাথে। তিনি এসেছেন এই মেলার টানেই। আদি বাড়ি এই গ্রামেই।
তারাও দল বেধে এসেছেন এই মেলায়। বড় কড়াই এ চলছে তাদের খিচুড়ি র প্রস্তুতি। কথায়
কথায় উনি বললেন এই মেলার গল্প। ফাল্গুন মাস জুড়েই এই বিশালাক্ষী তলায় এমন রান্না খাওয়া চলে তবে
সংক্রান্তির দিন বিশেষ আয়োজন। দেবীর বিশেষ পুজো হয় ,মানুষ জন মানত করে পাশের পুরাণ পুকুরে দন্ডী দেয়, বলি ও হয় তবে বলি চোখে পড়েনি। গুরুদাস
বাবু বলে
চললেন। এই রান্না খাওয়া মেলা একেবারেই এক গ্রাম্য উত্সব। পুরানো দিনে
গ্রামের মানুষের বিনোদন বলতে সেই রকম কিছুই ছিলনা। গ্রামের পুরুষ দের কিছু উপায়
থাকলেও নারীরা বাড়ির বাচ্চা রা ছিল অন্তঃপুরে। তাই শীত শেষে বসন্তের দিনে পুজো কে
উপলক্ষ করে একটা দিন অন্যরকম জীবন যাপন। জীবনের একঘেয়েমি ছেড়ে একদিন অন্যরকম। সবাই
একসাথে মিলে মিশে খাওয়া দাওয়া। সেই থেকে আজও চলছে। সময় বদলেছে বদলেছে গ্রাম তবে
আনন্দ উৎসব একই আছে। মন্দির চত্বরে
মানুষ দের দেখছিলাম আর পরছিল রবীন্দ্রনাথ এর সেই উক্তি
" যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার
সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভাবে পল্লীর হৃদয় কে ভরিয়ে দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা।
"
গুরুদাস
বাবু দুপুরে মেলা তে ওনাদের সাথে খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। আমার প্রবল ইচ্ছে সৌরভ
এর চুড়ি কেনা আর মেলা দেখার ইচ্ছের কাছে হার মানলো। ও হয়ত কথা দিয়েছে মেলা থেকে
রেশমি চুড়ি উপহারের। গুরুদাস বাবু কে বিদায় জানিয়ে মেলায় এলাম। মেলা ঘুরবো আর
জিলিপি খাবো না হয় নাকি। জিলিপি সহযোগে মেলা দেখা শুরু হল। ছবি তোলাও চলল সমানে।
কিন্তু সৌরভ চুড়ি পেলনা মনের মত। তাই চাবির রিং আর মাথার ক্লিপ। আমি নিলাম বাদাম
ভাজা আর গুড়কাঠি , খাওয়া নিয়ে মেলা আর খাবার নিয়ে ফিরবো না। ঘড়ি তখন আড়াই টের ঘর ছুতে চলছে। আমরা রওনা দিলাম ফেরার
রাস্তায়। ব্যাগ বোঝাই মেলার ধুলো, ক্যামেরা ভর্তি মেলার ছবি আর মনের মধ্যে অনেক অনেকটা ভালোলাগা।