অকাল রথযাত্রার গল্প
ভদ্রেশ্বর তেলেনিপাড়ার
অন্নপূর্ণার রথযাত্রা
সুমন্ত বড়াল
“ রথ যাত্রা
লোকারণ্য মহাধুমধাম “
লাইন গুলো শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আষাঢ়
মাসে মেঘলা এক দিনে দুপুর বেলা ভিড়ে ঠাসা রাস্তার
দুধারে মানুষের ঢল। আর রাস্তা দিয়ে চলেছে রথ। আর তাতে সারওয়ার প্রভু জগন্নাথ। আর
রথ মানেই মেলা জিলিপি পাপড় ভাজা।
আর হুগলী জেলার রথ মানেই মাহেশ কিংবা
গুপ্তিপাড়া।
সেসব তো আষাঢ় এর কথা তবে এই ভরা বৈশাখে রথের
কথা কেন ?
আসলে এই বৈশাখে ও যে সেই রথের ধুমধাম আর
লোকারণ্য রাস্তা ঘাট , উৎসব
মুখর হয়ে ওঠে।
এই অকাল রথযাত্রার স্বাদ নিতে হলে আপনাকে
যেতে হবে হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরের তেলেনীপাড়ায়।
ভদ্রেশ্বরের তেলেনীপাড়া যার গা ঘেঁষে বয়ে গেছে
গঙ্গা নদী। গঙ্গা পাড় হলেই শ্যামনগর এর বিখ্যাত আর মূলোজোড়ের কালি বাড়ি। তবে এই
তেলেনিপাড়া বিখ্যাত তার অন্নপূর্ণা মন্দিরের জন্য।
এই
অন্নপূর্ণা মন্দির ২১৮ বছরের পুরানো
মন্দির। তেলেনীপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বন্দোপাধ্যায় ১২০৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনী
পূর্ণিমায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই অকাল
রথযাত্রা র গল্প। তবে এই বহু প্রাচীন এই মন্দিরের ও জৌলুস কিছু কম নয় । মন্দিরটি নবরত্ন এবং দক্ষিণমুখ বিশিষ্ট্য।
মন্দিরের সামনে ইউরোপীয় স্থাপত্যের স্তম্ভের ব্যবহার লক্ষনীয়। নবরত্ন মন্দিরের
সমতল ছাদ এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য। এই ধরনের ছাদ যুক্ত মন্দির এই জেলায় আরও কয়েকটি
আছে। যেমন মহানাদের ব্রম্ভময়ীর মন্দির। এই মন্দিরে কোন পোড়ামাটির অলংকরণ নেই। তবে গর্ভ
গৃহের ভিতর অন্নপূর্ণা মূর্তি সত্য
নয়নাভিরাম। কাঠের সিংহাসনে অষ্টধাতুর দেবী
অন্নপূর্ণার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। মায়ের ডান হাতে অন্নদান করার হাতা এবং বাম হাতে
অন্নপাত্র। দেবীর ডান পাশে রুপোর মহাদেব অবস্থান করছেন। তাঁর বাম হাতে সিঙা ও ডমরু
এবং ডান হতে ভিক্ষাপাত্র। এছাড়া সিংহাসনে লক্ষী সরস্বতী এবং নারায়ণ শীলাও রয়েছেন।
এখানে দেবীর তন্ত্র মতে পুজো হয় এবং একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল মা অন্নপূর্ণার ভোগে
প্রতিদিন মাছ দিতেই হবে পাশে তিনটি ঘরে তিনটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের উঠানে
রয়েছে দুটি হাড়ি কাঠ। একটি ছাগ ও একটি মহিষ বলির জন্য। তবে এই বলিপ্রথা বর্তমানে
বন্ধ।
তবে হাড়িকাঠ গুলি অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তেলেনীপাড়ার এই মন্দির ইঙ্গ
বঙ্গ স্থাপত্য এর এক অপূর্ব নিদর্শন বলা চলে ।
এই মন্দিরেই অনুষ্ঠিত হয় অকাল রথযাত্রা। এই
রথযাত্রা উত্সব নিয়ে রয়েছে মজার গল্প ।
দেবী অন্নপূর্ণা নাকি অভিমান করে মন্দির ছেড়ে চলে যান আর লক্ষ্মী নারায়ণ তার
অভিমান ভাঙিয়ে তাকে মন্দিরে ফিরিয়ে আনেন।
আদতে প্রাচীন এই রীতির পিছনে রয়েছে এক স্থানীয়
উতসবের কথা।
বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মহাসমারোহে
পালিত হয় রথযাত্রা। এই রথ উৎসব কে শিব-অন্নপূর্ণার একশত আটবার গঙ্গাস্নান বলা হয়ে
থাকে। এই রথ কে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই মাতোয়ারা হয়ে ওঠে স্থানীয় মানুষ জন।
অন্নপূর্ণার রথটি তিনতলা কাঠের রথ , সাথে কাঠের
ঘোড়া আর সারথী। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সকাল
বেলা ভক্তরা শিব অন্নপূর্ণা কে রথে করে মন্দির থেকে কিছুটা দুরে স্থানীয়
অন্নপূর্ণা বারোয়ারির মোড়ে নিয়ে আসেন। আগে এই রথ গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত যেত কিনা
বর্তমানে বারোয়ারির মোড় পর্যন্ত যায়। এরপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলা শুরু হয় মূল উৎসব। ভক্তরা চতুর্দলায় লক্ষ্মী নারায়ণ কে
নিয়ে কীর্তন সহযোগে শিব অন্নপূর্ণা কে
মন্দিরে ফিরিয়ে আনার জন্য রওনা হয়। তবে সে কীর্তন এও রয়েছে এক অন্য
স্বকীয়তা । সে কীর্তনে গাওয়া হয় শিব অন্নপূর্ণার কথা ।।
"আনতে শিব অন্নপূর্ণা চল সবে যাই গো ত্বরা,
অবসান হল দিবা উচিত
নয় বিলম্ব করা।।
তৃতীয়ার উপলক্ষে, হর গৌরী অন্তরীক্ষে,
রথেতে গঙ্গা সমক্ষে
বিরাজিছেন মনোহরা।।
সত্বর পদ সঞ্চারে, চল যাই জাহ্নবী তীরে,
বুঝি মা রেখেছেন হরে
হয়ে বিরহ কাতরা।।
ত্যজি দম্ভ গর্বমদ, হেরিগে সেই অভয়পদ,
যে পদ সম্পদপ্রদ
সর্বাপদ নাশ করা।।"
সারা তেলেনিপাড়া তখন উৎসবে মাতোয়ারা। স্থানীয়
মানুষ জন রাস্তায় বেড়িয়ে রথের দড়িতে টান দেন। এই উৎসবে নারী পুরুষ উচু নীচু সব
ভেদ ঘুচে যায় সকলে মিলে রথের রশী তে টান দেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে শিব
অন্নপূর্ণা ফেরে তার আপন মন্দিরে। শুরু হয় সন্ধ্যারতি।
তবে উৎসবের এখানে শেষ নয়। উৎসবের রেশ থাকে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত
পর্যন্ত। তার কারণ এই রথযাত্রা কে কেন্দ্র
করে স্থানীয় উদয়ন ব্যায়ামাগারের মাঠে বসে মেলা। যে মেলায় নানা বয়েসের নানা
মানুষের ঢল নামে। আনন্দ উৎসবের রেশ নিয়ে রাত নামে। শেষ হয় শিব-অন্নপূর্ণা র
রথযাত্রা উৎসব ।
তেলেনীপাড়ার এই অকাল রথযাত্রা সত্যি কিছুটা
অন্যরকম। শতাব্দী প্রাচীন এই উৎসব আজও তার কৌলীন্য বজায় রেখেছে। পারিবারিক মন্দির
হওয়া সত্ত্বেও এই মন্দিরের উত্সব কে নিয়ে সকল শ্রেণীর মানুষের উত্সাহ এবং অংশ
গ্রহণ চোখে পড়ার মত। এককথায় হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরে র তেলেনীপাড়ার অক্ষয় তৃতীয়া র
দিন শিব অন্নপূর্ণা র রথযাত্রা সত্যি যেন মিলন উৎসব ।