রাঢ় বাংলার রাখাল রাজা
কাহিনী টা বহু শতাব্দী প্রাচীন । এ গল্প ধর্মপ্রান রামকানাই গোস্বামী র গল্প। এক সময় কাটোয়ার খাটুন্তি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন এই রামকানু গোস্বামী। আর এই রামকানু র আরাধ্য দেবতা ছিল গোপীনাথ। পারিবারিক কলহ অতিষ্ঠ হয়ে রামকানু তার পরিবার ও তার আরাধ্য দেবতা গোপীনাথ কে নিয়ে খাটুন্তি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন এবং সপরিবারে গোপালদাসপুরে এসে বসবাস শুরু করলেন। সেই সময় গোপালদাসপুর ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। রামকানাই জঙ্গলে বসবাস করেন এবং মাধুকরি করে জীবন নির্বাহ করতে শুরু করেন। এই রামকানাইএর তিন পুত্র সন্তান ছিল। তারা হলেন নিমাইচাঁদ, বলদেব ও রাখাল। রামকানাই তার আরাধ্য দেবতা গোপীনাথের পুজোর জন্য জঙ্গলে একটি মাধবী ফুলের গাছ লাগান। কিন্তু তার ছোট ছেলে রাখাল একদিন খেলতে গিয়ে সেই গাছ ভেঙে ফেললে রামকানাই রেগে যান এবং ছেলেদের কাছে কে গাছ ভেঙেছে এটি জানতে চাইলে তারা উত্তর দেয়না এবং রামকানাই ক্রোধের বসে অভিশাপ দেন যে গাছ ভেঙেছে তার তিন রাত্রের মধ্যে মৃত্যু হবে। এরপর সত্যিই রামকানাই এই অভিশাপে রাখালের মৃত্যু হয়।
পুত্রশোকে বিহ্বল রামকানাই গোপালদাসপুর ত্যাগ করে বৃন্দাবনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রাপথে একদিন রামকানাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নাদেশ পান যে ওই গোপালদাসপুরেই তার কর্মক্ষেত্র, সেখানেই তার বৃন্দাবন। স্বপ্নদেশ অনুসারে তিনি আবার গোপালদাসপুরে ফিরে আসেন। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী তিনি যে জঙ্গলে বসবাস করতেন তার পাশের পুকুর থেকে একটি নিমকাঠ তিনি পান এবং স্বপ্ন নির্দেশ মতো বাঘনাপাড়া গ্রামের পাঁচ বছরের শিশু মহাদেব ওই নিমকাঠ থেকে একটি সুদৃশ্য মূর্তি নির্মাণ করে। যে মূর্তি আজও গোপালদাসপুরে রাখাল রাজা রূপে পূজিত হয়।
এ গল্প আজ থেকে বহু শতাব্দী প্রাচীন,
পূর্ব বর্ধমান জেলার বৈদ্যপুর পঞ্চায়েতের গোপালদাসপরের সবুজে ঘেরা মনোরম পরিবেশে মধ্যে রাখাল রাজার মন্দির। আজ বিখ্যাত তীর্থস্থান রামকানাই গোস্বামীর প্রতিষ্ঠিত এ মন্দির আজ লোকমুখে এবং আপন মহিমায় মহিমান্বিত। রামকানাই গোস্বামীর এই রাখাল রাজা মূর্তি প্রতিষ্ঠার কোনো ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য নেই। এই গল্পই পুরোটাই জনশ্রুতি। যেমন আরেক জনশ্রুতি রয়েছে রাখাল রাজার এই মন্দির প্রতিষ্ঠা কে ঘিরে । ইতিহাস বলছে সতেরোশ পঁচাত্তর সালের পোঁটবা র জমিদার গোপাল দাস এর আর্থিক আনুকূল্যে এ মন্দির নির্মিত হয়। এই গোপাল দাসের নামেই এই গ্রামের নাম গোপালদাসপুর। তবে এ মন্দির নির্মাণের জনশ্রুতি তা কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। কথিত একদিন রাজা শিকারে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কাশর ঘন্টা শুনতে পান। জঙ্গলের মধ্যে থেকে এরম আওয়াজ শুনে রাজা কিছুটা অবাক হন এবং জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে দেখেন এক ব্রাহ্মণ তার কুটিরে কৃষ্ণ পূজা করছেন। রাজাকে দেখে ব্রাহ্মণ তাকে ভোগ খেয়ে যেতে বলেন কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছোট্ট হাড়িতে ভোগের আয়োজন থাকলেও জমিদার গোপাল দাস ও তার সহ যাত্রীরা সেদিন পেট ভরে, তৃপ্তি কর ভোগ খান। দেবমাহততে পরিতৃপ্ত জমিদার ওই জঙ্গলের মন্দির নির্মাণের সংকল্প নেন এবং ভোগের সম্পত্তি দান করেন।
এই সময় মুর্শিদাবাদের নবাব ছিলেন, মুসর্শিদ কুলি খাঁন। তিনি পোঁটবা র রাজা গোপাল দাসের মুখে রামকানাই এর কথা শুনে নিঃসুলক জমি দান করে। সুদূর বৃন্দাবন নয় আমাদের এই রাঢ় ভূমিতে তৈরি হয় রাখাল রাজার সুদৃশ্য জোর বাংলো মন্দির।
করা ইটের তৈরি এই মন্দিরে বর্তমানে রঙের ছাপ পড়েছে। যা এই মন্দিরের প্রাচীনত্মকে কিছুটা হ্রাস করলেও ঐতিহ্য কে নস্ট করে না । সবুজ গাছগাছালি যে ঢাকা এই মন্দির প্রাঙ্গন। এই মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি নাট দালান আর পাশেই রয়েছে একটি দল মঞ্চ। রাম নবমীর আগের দিন এই দল মঞ্চে নিয়ে আসা হয় রাখাল রাজা কে। রাম নবমীতে চলে রাখাল রাজার দল উৎসব।
রাখাল রাজার এই মূর্তি ভেসে বৈশিষ্ট পূর্ণ। কৃষ্ণরূপে পূজিত হলেও এই রাখাল রাজার পাশে রাধা কিংবা সখি দের দেখতে পাওয়া যায় না। বরং রাখাল রাজার চারিদিকে রয়েছে গাভী ধবলী। রাখাল রাজার গায়ের রং এখানে আকাশ নীল। মুখীমণ্ডলে এক মিষ্টি হাসি মাখা রাখাল বালকের ছাপ। বা হাতে রয়েছে নাড়ু আর ডান হাতে লাঠি। রাখাল রাজার দান পাশে রয়েছেন রঘুনাথ, তার গায়ের রং সবুজ আর বাম পাশে নীল রঙের গোপীনাথ। ত্রিখিলানযুক্ত বারান্দার পরে রয়েছে গর্ভগৃহ। মন্দিরের ভক্তদের জন্য মন্দিরের ওপরে ওঠা মানা। বংশপরম্পরায় রামকানাই গোস্বামীর পরিবারের লোকজনেরা এই রাখাল রাজার পৌরোহিত্ত্ব করেন। আর এই রাখাল রাজার ভোগেও রয়েছে চমক। প্রত্যেকদিন নানান পদের ভোগ নিবেদন করা হয় রাখাল রাজা কে।

আগত ভক্ত বা দর্শনার্থীরা খুব সামান্য মূল্যে এই ভোগ পেতে পারেন। মন্দিরের পিছনেই রয়েছে ভোগ রান্নার সুব্যবস্থা। প্রত্যেকদিন বহু ভক্ত সমাগম কাশর ঘন্টার ধ্বনি আর কীর্তনে মুখিরিত হয়ে ওঠে এই রাখাল রাজার মন্দির চত্বর। তবে জনশ্রুতি এও রয়েছে যে সন্ধ্যা আরতির পর এই মন্দির চত্বরে কারো প্রবেশ নিষেধ। এ মন্দির চত্বরে নাকি তখন এক অলৌকিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বয়ং রাখাল রাজা নাকি তখন বিরাজ করে এই খানে। এই জনশ্রুতির সত্তাসত্ব বিচার্য নয়। আসলে ভক্তিভাবের কাছে অনেক লৌকিক ও অলৌকিক কাহিনীর বাখ্যা হয় না।
বর্তমানে রাখাল রাজাতলা পৌঁছে যাওয়া খুবই সহজ। হাওড়া-বর্ধমান মেন শাখা বৈচিগ্রাম কিংবা হাওড়া-কাটোয়া শাখার কালনা স্টেশন থেকে বৈদ্যপুর তালার মোড়ে নেমে অটো কিংবা টোট করে রাখাল রাজা মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া যায়। সড়ক পথে কলিকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হয়ে বা জি টি রোড ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় এই মন্দির। সবুজ ধান ক্ষেত গ্রাম্য ঘর বাড়ি, গ্রাম্য মানুষ জন, নতুন সিমেন্ট এ বাঁধানো রাস্তা আর সবুজ প্রকৃতি এই রাখাল রাজার মন্দিরের যাত্রা পথ এই মন্দির কে অন্য মাত্রা দেয়। আর মন্দির চত্বরেই যমুনা পুকুর আর বড় বড় বৃক্ষ এনে দেয় তপবনের অনুভূতি। আর মন্দিরটি রাখাল রাজার বলেই কিনা কে জানে এই মন্দির চত্বরে দেখা মেলে প্রচুর গবাদি পশুর। একদিন সময় করে রাখাল রাজার টানে , ভক্তির টানে কিংবা নিছক বেরিয়ে পড়তে চলে আসাই যায় এই রাখাল রাজার কাছে।
No comments:
Post a Comment