Thursday, 2 July 2020


                উত্তরবাহিনীর গল্প কথা 

" বর্ধমানে বন্দী গাবো সর্বমঙ্গলা
উত্তর বাহিনী বন্দো গ্রাম শেয়াখালা "

কবিকঙ্কন মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী চন্ডী কাব্যে , যে দেবী উল্লেখ কিংবা রূপরামের ধর্মমঙ্গলে                          

 " শ্মশানে বন্দিলাম শ্যামা করাল বদনী
সেই থালায় বন্দিলাম উত্তর বাহিনী " .

সেই দেবী উত্তর বাহিনী কথা শোনাই আজ




শ্রীরামপুর মহকুমার, চন্ডিতলা থানা ব্লকের অন্তর্গত বর্ধিষ্ণু জনপদ শিয়াখালা এই শিয়াখালাতেই দেবী উত্তরবাহিনীর অবস্থান  মজে যাওয়া কৌশানি নদী, লাল মোরামে ঢাকা রাস্তা আর সবুজ গাছগাছালির ভিড়ে এক প্রাচীন মন্দির দেবী উত্তরবাহিনীর তবে মন্দিরের মধ্যে প্রাচীনত্বের কোনো নিদর্শন নেই ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রাচীন এই মন্দির ভেঙে গেলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই মন্দির পুনরায় গড়ে ওঠে বর্তমানে উত্তরবাহিনীর সেবা সমিতিরউদ্যোগে এই মন্দির সংলগ্ন নাট মন্দিরটি পুনরায় মেরামতের ফলে মন্দিরটি ঝা চকচকে এবং আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে উত্তরবাহিনীর মন্দিরের মধ্যে সেইভাবে কোনো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় না সমান্তরাল ছাদ বিশিষ্ট এই মন্দির বৈচিত্র্যহীন হলেও উত্তরবাহিনীর দেবী মূর্তিটি কিন্তু বিশেষ বৈচিত্র্যপূর্ণ শিবের বুকের উপর দণ্ডায়মান দেবীর উচ্চতা প্রায় সাড়ে চার হাত অর্থাৎ ফুট পশ্চিমবাংলায় কোনো লৌকিক দেবতার এত বড় পাথরের মূর্তি দেখা যায় না শুধু উচ্চতাতে নয় দেবীর সাজসজ্জা, অলংকরণ সবেতেই বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়
দেবীর গায়ের রং তপ্ত কাঞ্চন বর্না, এককথায় শিউলি ফুলের ডাটির মতো দেবী দ্বিভুজা তার ডান হাতে খড়গ আর বাম হাতে রুধির পাত্র আগে বাম হাতে মরার খুলি থাকতো কিন্তু কালের নিয়মে তার পরিবর্তন এসেছে দেবী ত্রিনেত্র, নাকে নথ, গলায় মুন্ডমালা এবং নানাবিধ অলংকারে সুশোভিত মুকুট পড়া মাথায় দেবীর কেশ আলুলায়িত উত্তরবাহিনীর সাজ অলংকারে হিন্দুস্তানী রমনীদের একটা প্রভাব লক্ষ করা যায় হিন্দুস্তানী রমণীরা যে ধরণের চুরি,বলা পড়েন দেবীও সেই ধরণের অলংকারে সুসজ্জিত 




তবে দেবী উত্তরবাহিনী উলঙ্গিনী নন, তবে তার রক্তবর্ণ শাড়ি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে
এত গেল দেবীর সাজসজ্জার কথা, এবার আসি দেবীর মূর্তি এবং তার কারুকার্যের বর্ননায় উত্তরবাহিনী একটি লৌকিক দেবী, ভুভারতে এই দেবীর নিদর্শন প্রায় নেই বললেই চলে, সেদিক থেকেও শিয়াখালা গ্রামের এই প্রাচীন দেবী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দেবী মহাদেবের ওপর দন্ডায়মান দেবীর বাম পা বটুক ভৈরবের মাথার কাছে নস্ত আর ডান পা মহাকালের বুকের ওপর দেবীর দু পায়ের মাঝখানে শিবের নাভিদেশে রয়েছে দৈত্য নিসুম্ভের ছিন্ন মুন্ড আর গলায় দুটি সাপ
দেবী উত্তরবাহিনী বহু প্রাচীন এক লৌকিক দেবী যার খ্যাতি শিয়াখালা গ্রাম ছাড়িয়ে সমগ্র হুগলী জেলা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে এই দেবীর প্রাচীনতা নিয়ে সন্দেহ থাকে না, কারণ মধ্যযুগীয় মঙ্গল কাব্য গুলিতে এই দেবীর উল্লেখ রয়েছে সে কথা লেখার শুরুতেই বলেছি কিন্তু দেবী উত্তরবাহিনীর উৎপত্তি কোথা থেকে, তার পিছনেও রয়েছে এক কাহিনী যে কাহিনীটি মন্দির কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে খুব সুন্দর করে দেয়ালে পাথর খোদাই রয়েছে



তা থেকে জানা যায় প্রায় ৪০০ বছর আগে এই মন্দিরের পাশ দিয়েই বয়ে যাওয়া কৌশানি নদীর গর্ভ থেকেই স্থানীয় শান্ডিল্য গোত্রীয় ভট্টনারায়ণ বংশধর এই উত্তরবাহিনীর আদি বিগ্রহটি পেয়েছিলেন, যা লম্বায় ছিল মাত্র ইঞ্চি এই মূর্তির আকার এত ছোট হবার কারণে সেই সময় ওই বিগ্রহের আদলে মাটির মূর্তি তৈরি করে পুজো হতো দেবীর নব ঘট প্রতিষ্ঠার রীতি সেই সময় থেকে চলে আসছে যা আজও বর্তমান প্রতি বছর শারদীয়ার শুক্লা একাদশী তিথিতে এই নব ঘট প্রতিষ্ঠার উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয় আদি কাল থেকে স্বর্ণমণ্ডিত ক্ষুদ্র বিগ্রহটি মন্দিরে পুজো হতো যাকে বলা হতো ভোগ মূর্তি পরবর্তীতে আদি মূর্তিটি খোয়া গেলে অনুরূপ আরেকটি মূর্তি তৈরি করা হয়
বর্তমানে শিয়াখালা গ্রামে কৌশানি নদীর অস্তিত্ত নেই, নদীটি মজে গেছে আর সাথে সাথে দেবী মুর্তিতেও পরিবর্তন এসেছে সেই ক্ষুদ্রকায় মূর্তি পরিবর্তিত হয়ে রূপ নিয়েছে আলোচ্য এই বিশাল মূর্তির ১৩৪০ বঙ্গাব্দ  অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় ডাক্তার জামিনিকান্ত বলের চেষ্টায় ভক্তদের অর্থানুকূললে কাশির ভাস্করদের দিয়ে তৈরি হয় বর্তমান এই সুসজ্জিত সুশ্রী সুদীর্ঘ এই পাষান মূর্তি
১৩৪০ এর ষোলোই আসার  এই তিরাশি বছরের পুরানো মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয় সেই থেকে ষোলো ই আষাঢ় দিনটি দেবী উত্তরবাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবস বার্ষিক উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয় সময়ের সাথে সাথে এই উৎসবের শ্রী বৃদ্ধি হয়েছে বর্তমানে এই উৎসবের জাঁকজমক চখে পড়ার মতো উৎসব চলে তিনদিন ব্যাপী



উৎসবকে ঘিরে লোক সমাগমের কথা বলা বাহুল্য শিয়াখালা গ্রাম তো বটেই আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে এমনকি শহর শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, বালি, হাওড়ার মানুষ এসে জড়ো হন উত্তরবাহিনী মন্দির চত্বরে ঢাক কসর ঘন্টা মন্ত্রচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গন আলোর মালায় সেজে ওঠে উত্তরবাহিনী মাতার মন্দির এই উৎসবের তিনদিন উত্তরবাহিনী সেবা সমিতির উদ্যোগে ভক্তদের জন্য থাকে ভোগের আয়োজন নানান ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় এই তিনদিন ধরে এই মন্দিরের আশপাশে সবুজ ঘেরা পরিবেশে চলে মেলাও
আধুনিকতায় মোরা এক প্রাচীন লৌকিক দেবী শিলা ক্ষেত্র বা শিয়াখালা গ্রামের দেবী উত্তরবাহিনী শতাব্দীর পর শতাব্দী আপন মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ভক্তদেরকে আকর্ষণ করে চলেছে দেবী আর শুদু ভক্তই বা বলি কেনই, এই মন্দির , এই মূর্তি সব কিছুই এক ইতিহাসকে বহন করে চলেছে উত্তরবাহিনী মন্দিরের প্রাঙ্গনে দাঁড়ালে এক লহমায় সেই ইতিহাসকে ছোয়া যায় গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে প্রাচীন এই মন্দির বড়োই আকর্ষনীয় আর মোরামে ঢাকা রাস্তার পাশে যে বোর্ডটায় লেখা রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন উত্তরবাহিনী মাতার মন্দির এই দিকেসেই বোর্ড তা যেন এক অমোঘ ইতিহাসের হাতছানি

https://youtu.be/zuztBpV0VJU

No comments:

Post a Comment

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...