মেরিয়া গ্রামে একবেলা
উদ্দেশ্য
বিহীন বেরিয়ে পড়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে। একটা হাইওয়ে ধরে কিছুটা গিয়ে
তারপর ম্যাপে খুজতে থাকা গন্তব্য। এবার ও তার ব্যতিক্রম হলনা। দিল্লী রোড ধরে
পৌঁছে গেলাম ব্যান্ডেল রাজহাট মোড়। সেখানে দাড়িয়ে আমেদের প্রথম বিরতি আর ঠিক করে
নেওয়া গন্তব্য । ম্যাপ খুজে চোখে পড়ল একটা নাম। মেরিয়া। পোলবা দাদপুর ব্লক এর
অন্তর্গত একটা ছোট্ট গ্রাম,
মনে পড়ল এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম এই
মেরিয়া গ্রামের কথা। মেরিয়া গ্রামে র পালিত বাড়ির কথা।
সময়
নষ্ট না করে রওনা হলাম, রাজহাট থেকে সাত কিলোমিটার মতো, আসলে শেষ ভাদ্রের চড়া রোদ আর মেঘ মুক্ত নীল আকাশ একটু কম দূরত্বের
কথা বলছিল।
সরস্বতী
নদী কুন্তি নদীর ওপরের ব্রীজ পেরিয়ে গ্রামে রাস্তা, মাটির বাড়ির নিকোন উঠোন,
সবুজ
ধান খেত পেরিয়ে পৌঁছলাম মেরিয়া তে।
একটা
তিনমাথা মোড় একটা দিক চলে গেছে রথতলা , একদিক ঝাঁপান তলা আর একদিক মগরার দিকে। আর তিন মাথার মোড়ে রয়েছে বেশ
প্রাচীন এক কালী মন্দির।
ম্যাপ
বলছে পালিত বাড়ি রথ তলার রাস্তায়, কিন্তু তিন মাথার মোড়ের সেই প্রাচীন মন্দিরে কিছুটা সময় কাটাতে মন
চাইল। একবারে বৈচিত্র্য হীন এক কালী মন্দির, কিন্তু ভিতরের বিগ্রহ টি বেশ বড় আর সুন্দর ও। আলাপ হলো অমরনাথ
চ্যাটার্জী র সাথে। সাদা কোঁচকানো চুল, খালি গা, আর ধুতি পড়া পুরোহিত মহাশয়।
কথায়
কথায় উনি যে কখন আকর্ষণ এর কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠছেন বুঝতে পারিনি।
ভদ্রকালী
মন্দিরের ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি শুধু এই মন্দিরের প্রাচীনতা নিয়েই কথা বলেন আসলে
গ্রাম বাংলা জুড়ে এমন বহু মন্দির রয়েছে যার সাল দিনক্ষণ বলা যায়না কিন্তু মন্দির
গুলির প্রাচীনতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকেনা।
কথায়
কথায় এই গ্রামের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে তিনি দুটো প্রচলিত কাহিনীর কথা
বললেন।
ইংরেজ
আমলে আলেকজান্ডার
ডাফ শিক্ষা বিস্তার এর উদ্দেশ্যে এই গ্রামে এসেছিলেন সেই সূত্রে মাতা মেরীর নাম
থেকে এই গ্রামের নাম মেরিয়া, তবে
এই কাহিনী সেই ভাবে মন টানে নি। কিন্তু এর পরের কাহিনীটি বেস সুন্দর। এই গ্রামের
প্রাচীন পূজিত দেবী ছিলেন দেবী মিরানি। আগে একটি মন্দির ও ছিল, কিন্তু সে মন্দির কালের গর্ভে হারিয়ে
গেলেও সেই মিরাণি দেবী র নাম অনুসারে এই এই গ্রামের নাম মেরিয়া। কথায় কথায় জানা
গেল এই ছোট্ট গ্রামের কিছু টুকরো ইতিহাস আর কিছু পুরানো মন্দিরের কথা। এই গ্রামে
প্রাচীন বাসিন্দা বলতে চারটে পরিবারের কথা তিনি বললেন,
অদ্ভুত
ভাবে বাকি সব পরিবারই নাকি বাইরে থেকে এসে এই গ্রামে বসতি করেছে। যেমন এই গ্রামের
একসময় এর জমিদার পালিতরা ।
তারাও চন্দননগর এর আদি বাসিন্দা, পালিত বংশের বংশধর শ্রী গঙ্গাচরণ পালিত মহাশয় এই গ্রামে আসেন এবং তার জমিদারি স্থাপন করেন।
অমরনাথ
বাবু কে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম পালিত বাড়ির দিকে। রাস্তার বাক নিয়ে বুড়ো শিবের
মন্দির আর পুকুর ঘাট পেরিয়ে চোখ আটকালো একটা মন্দিরের চূড়ায়। মন্দিরের চুড়া টি
সুউচ্চ আর আকর্ষণীয় বটে, কিন্তু সামনের দরজা টা বন্ধ। একটু ইতস্ততঃ করে পাশের দরজা দিয়ে আলো
আধারি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটি ঠাকুর দালান। জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালান
গুলি যেমন হয় এও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবে কালের বলিরাখার ছাপ পড়েছে তাতে। হ্যাঁ
আমরা এসে পড়েছি পালিত বাড়িতে।
বাড়িটাতে
একটু চোখ বোলালেই বোঝা যাবে অতীতের জৌলুস আজ অস্তমিত। ভেঙে পড়া ঝুল বারান্দা কিনবা
পলেস্তারা খসা কার্নিশ থেকে পায়রার উকি সে কথাই বলছে।
আমাদের
দেখে ঠাকুর দালান ঝাঁটা দেওয়া থামিয়ে এগিয়ে এলো একটি মেয়ে। বয়স ২৪ এর আশেপাশে।
শুএষা, এই পালিত বাড়ির মেয়ে। আমাদের
উদ্দেশ্য ও কথা শুনে নিজে দায়িত্ব নিয়ে ঘুরিয়ে দেখতা লাগল তাদের বাড়ি আর বাড়ি
লাগয়া পাশের মন্দির।
এই
পালিত বংশ মেরিয়া গ্রামের আদি বাসিন্দা নয় সে কথা বলেছি। চন্দননগর থেকে গঙ্গাচরণ
পালিত মহাশয় এই গ্রামে এসে জমিদারি স্থাপন করেন। আর নির্মাণ করেন এই বাড়ি ও
মন্দিরের। মন্দিরের উপরে ফলকে মন্দির নির্মাণের কথা লেখা রয়েছে।“ ত্রিজগজ্জননী
শ্রী শ্রী পতিত পাবণী শ্রীচরণ ধ্যান পরবস শ্রী গঙ্গাচরণ পালিত দাসেন কৃতস্বজং দেবালয়ং ” ।
মন্দির
টি স্থাপত্য রীতির দিক থেকে অভিনব। এই জেলায় যে ধরনের মন্দির রীতি দেখা যায় এটা
তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । ত্রিখিলান যুক্ত মন্দিররের অলিন্দ অংশ তিনটি চূড়া
বিশিষ্ট, কিন্তু গর্ত গৃহ টিতে রয়েছে সমতল ছাদ।
গর্ত
গৃহে অধিষ্ঠিত দেবী পতিত পাবনী। দেবী পতিত পাবনী দেবী দূর্গা র ই রূপ। একটি অষ্ট
ধাতু র দূর্গা মুর্তি। শেওড়াফুলি রাজবাড়ি র দেবী সর্বমঙ্গলার সাথে এই মূর্তির
অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়।
মন্দিরের
সামনের অংশে প্রসস্থ নাটদালান। তবে সবকিছুতেই জীর্ণতার ছাপ স্পষ্ট।
মন্দির
দেখা শেষে যখন আবার পালিত বাড়ির ঠাকুর দালানে এলাম সেই সময় আরও কয়েক জন সদস্য এসে
উপস্থিত হয়েছেন, তবে সকলেই বাড়ির মহিলা। কোন সময় এনাদের
বংশের মহিলারা হয়ত অনন্তপুর বাসিনী ছিলেন। কালের সাথে নিয়ম গুলো ও বদলেছে। যেমন
বদল এসেছে পালিত বাড়ির পুজো তে।
আগে
এই বাড়ির পুজো তে বলি প্রথা থাকলেও এখন আর বলি হয়না। আগে দেবী পতিত পাবনীর মূর্তি
ঠাকুর দালানে আনা হত এবং মাটির তৈরি কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী দিয়ে পুরো পরিবার পুজো হত।
কিন্তু কয়েক বছর বাধা পড়ায় বর্তমানে পুজো বোধন থেকে বিসর্জন অষ্ট ধাতুর পতীতপাবণী
দেবীর পুজা নিষ্ঠা সহকারে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পালন করে চলেছে মেরিয়া গ্রামের
পালিত পরিবার।
![]() |
দেবী পতিত পাবনী |
আলাপ পরিচয় গল্প গুজব শেষে এবার ফেরার পালা, ওনারা আগাম পুজোর নিমন্ত্রণ জানালেন। এবার ফেরার পালা, ফিরতি পথে দেখি অমরনাথ বাবু মন্দিরের দাওয়া তে তখনও বসে। ওনাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এলাম।
ফিরতি
পথে কিছুটা ইচ্ছে করে ভুল রাস্তা ধরে লাল মাটির রাস্তা নদীর ভাঙা সাকো পেরিয়ে যখন
দিল্লী রোডে উঠলাম ঘড়ির কাটা বলছে আবারও দেরী হয়ে গেছে।
আসলে
উদ্দেশ্য বিহীন ঘুরে বেড়ানো তে সময়ে র হিসাব রাখা যে মানা। কাজেই দেরী বলে কিছু
নেই।
সুমন্ত বড়াল ...
No comments:
Post a Comment