আশাপূর্ণা
দেবীর বাড়ি দুর্গাপূজা
বেগমপুরের শতবর্ষ পুরানো গুপ্তবাড়ির পুজো
প্রাক্ শারদীয় এই মরশুম টা ভীষণ ই সুন্দর। মহৎসবের প্রস্তুতি তে প্রকৃতি নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে। আর প্রকৃতির এই বাহারের স্বাদ নিতে বাইরে বেড়িয়ে পড়তেই হবে।
প্রাক্ শারদীয় এই মরশুমে খুব কমন গন্তব্য কুমোর পাড়া, আর সেখানে দেখা পটুয়া দের শিল্প কর্ম, কিংবা কাশ ফুলে ঢাকা নদীর পাড়।
এসব কিছু বাদ দিয়ে আর এক গন্তব্যে পৌঁছে যেতে মন চায়। যদিও বছরের যেকোন সময় ই সেই জায়গা ভীষণ আকর্ষণীয় তবু এই সময় সেই জায়গার এক আলাদা আকর্ষণ আছে। হ্যাঁ, আমি বনেদি বাড়ির অন্দর এর কথা বলছি। সেই বাড়ি গুলো, যেখানে আজও দূর্গাপুজো হয়। এই প্রাক্ পুজো মরশুমে যে বাড়ি গুলোর ঠাকুর দালানে চোখে পড়ে ঠাকুর গড়ার ছবি,যে দালানের দেওয়ালে কান পাতলে অতীত থেকে ভেসে আসে উৎসব এর হাজার কলরব। সেই সব বাড়ি গুলোর জৌলুষ এ ভাটা পড়লেও আসন্ন উৎসব এর মেজাজ সেখানে অন্যরকম।
ঘুরতে ফিরতে এমনই এক বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া,হুগলী র বেগমপুর অঞ্চলের গুপ্ত বাড়ি।
এখানে একটা মজার কথা বলি, এমন ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে যায়।
আসলে কোন পূর্ব প্রস্তুতি বা হিসাব কষে ঘোরাঘুরি করার স্বভাব আমার নয়,যখন যেখানে যা চোখে পরে দাঁড়িয়ে পড়ি।আর হঠাৎ ই কোন গুপ্তধন পাওয়ার মতো পেয়ে যাই কোন দারুন তথ্য।
বেগমপুরের গুপ্ত বাড়ির ক্ষেত্রে ও তাই হল, একটা পুরানো ঠাকুর দালান দেখে ভিতরে ঢুকে তো পড়ি কিন্তু আলাপ পরিচয়ে জানতে পারি গুপ্ত বাড়ি র মেয়ে স্বনামধন্য লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী।
অর্থাৎ এককথায় যে বাড়ির দুর্গাপূজা নিয়ে কথা বলছি তা লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ির দুর্গাপূজা।
গুপ্ত বাড়ির ঠাকুর দালান পেড়িয়ে গুপ্ত বাড়ির ভিতর ঢুকতেই আলাপ হল উজ্জ্বল গুপ্ত-র সাথে, উজ্জ্বল বাবু শিক্ষক ছিলেন, বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত। আলাপ হল ওনার দাদা নিশীথ গুপ্ত মহাশয়ের সাথে। গুপ্ত বাড়ির এই দুজন মানুষের সম্পর্কে প্রথমেই যে কথাটি মাথায় আসে, এনারা এনাদের বয়স কে হারিয়ে দিয়েছেন। নিশীথ বাবুর বয়স আশি পেরলেও ষাট বলে ভুল হয় আর দ্বিতীয় ওনাদের আতিথেয়তা ও ব্যবহার যা মনমুগ্ধকর।
ওনাদের থেকে বয়েসে অনেকটা কাঁচা হলেও গল্প আড্ডা জমে উঠল। প্রসঙ্গতই এলো গুপ্ত বাড়ির পুজোর কথা, আশাপূর্ণা দেবীর কথা। উজ্জ্বল বাবু জানালেন, আশাপূর্ণা দেবী এই বাড়িরই মেয়ে। ওনাদের জ্ঞাতি সম্পর্কে। তবে গুপ্ত বাড়ির দূর্গাপুজোর থেকেও কালী পুজো আরও প্রাচীন, এবং আমরা যে ঠাকুর দালান দেখছি সেই দালান আসলে পঞ্চমুন্ডির আসন এবং তাদের কালী পুজো আড়াইশো বছরের পুরানো। তবে গুপ্ত বাড়ির এই দুর্গাপূজোও শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। যে পুজো আজও চলছে। গুপ্ত বাড়ির পুজোর জৌলুষ এখনো একই রকম ভাবে বজায় রেখে চলেছেন শ্রী নির্মল চন্দ্র গুপ্তের পরিবারের মানুষজন।
শ্রী উজ্জ্বল গুপ্ত |
তবে পুজোর কথা জানতে গেলে একটু অতীত চর্চা প্রয়োজন। বেগমপুর গ্রামে তখন দুর্গাপুজো হয়না বললেই চলে,পুজো বলতে বেশ কিছুটা দূরে বাকসা কিম্বা জনাই এর জমিদার বাড়ির পুজোগুলো। কাজেই উৎসবের দিনে এই অঞ্চলের মানুষের বেশ মন খারাপ। বেগমপুর অঞ্চলের মানুষের এই মন খারাপ চোখ এড়ালোনা সেই সময়ের এই অঞ্চলের সমাজসেবী, ওরিয়েন্টাল কোম্পানিতে কর্মরত এবং বেগমপুর অঞ্চলের “দি ক্লাব” – এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী নির্মল চন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের। এই মফস্বল এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। কাজেই এই কথা বলাই যায় নির্মল চন্দ্র ছিলেন খুব পরিচিত মুখ। এই নির্মল চন্দ্র ঠিক করলেন এই অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে দূর্গাপূজা শুরু করবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ কিন্তু সেই গুপ্ত বাড়ির মানুষজন চাইল পুজো যখন হবে তখন সেটি গুপ্ত বাড়ির ঠাকুর দালানে কেন নয়। কিন্তু পঞ্চমুন্ডির আসনে কি দুর্গাপূজা সম্ভব।
আসলে মানুষের ইচ্ছে-খুশীর কাছে নিয়ম তুচ্ছ। আর মায়ের আবির্ভাবই তো হবে, তাই সব বাঁধা পেড়িয়ে শ্রী নির্মল চন্দ্র গুপ্ত প্রথম শুরু করলেন এই গুপ্ত বাড়ির দূর্গাপূজা।
উজ্জ্বল বাবু তার বাবার কথা বলতে বলতে নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলেন, আর ওনার কথা বলা ধরন একটা দারুণ গল্প শোনার অনুভূতি যেন। তবে এই দুর্গাপূজা নিয়ে একটি ছোট কাহিনী শোনালেন নিশীথ গুপ্ত মহাশয়। তার কথায়, কোন এক সন্ধ্যাবেলা ওনাদের ঠাকুমা দেখেন তাদের ঠাকুর ঘর থেকে এক কিশোরী মেয়ে হঠাৎ ঠাকুর দালানের দিকে গিয়ে মিলিয়ে যায়, ঠিকই একই রকম দৃশ্য নির্মল চন্দ্র ও দেখেন। এই ঘটনা কোন দৈব ঘটনা নাকি নিছক চোখের ভুল সেটা নিয়ে দ্বন্দের অবকাশ নেই।
এককথায় মানুষের জন্য কিংবা দৈব আদেশেই হোক গুপ্ত বাড়িতে যে দুর্গাপূজা শুরু হয় টা আজও মহাসমারোহে পালিত হয়ে চলেছে। সেই শত বর্ষ আগে যে সংকল্প নিয়ে শুরু হয়েছিল আজও সেই ভাবে হয়ে চলেছে। পুজোর পাঁচদিন গুপ্ত বাড়ির ঠাকুর দালান শুধু গুপ্ত বাড়ির থাকেনা, সারা বেগমপুরের মানুষ এই গুপ্ত বাড়ির পুজোয় অংশগ্রহণ করে। সব মিলিয়ে পুজোর পাঁচদিন মেতে ওঠে গুপ্ত ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এই গুপ্ত বাড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে।
গুপ্ত বাড়ির পুজো হয় শাক্তমতে। পুরানো রীতি মেনে প্রতিমার দলার সাজ ও তার সাদা রঙ শতবর্ষ পার করেও অপরিবর্তিত। সাদা রঙের ডাকের সাজের প্রতিমা বেশ মনমুগ্ধকর। গুপ্ত বাড়িতে বলি প্রথা প্রচলন রয়েছে। স্থানীয় মানুষ জন মানসিকের বলি উৎসর্গ ও করে থাকেন। তবে এই বাড়ির পুজোর আকর্ষণীয় বিষয় দশমীর নরনারায়ণ ভোজন। দশমীর দিন দুপুরে স্থানীয় অঞ্চলের সকল ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ গুপ্ত বাড়িতে আসেন ভোগ গ্রহন করতে। সন্ধ্যেতে সরস্বতী নদীতে বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি হয় শারদ উৎসবের। আর প্রস্তুতি শুরু হয় কালীপুজোর। আগেই জানিয়েছি গুপ্ত বাড়ির কালীপূজো বহু প্রাচীন।
প্রাক পুজো ভ্রমণে বেগমপুরের গুপ্ত বাড়ি মন ছুঁয়ে গেল। বাড়ির সদস্যদের আতিথেয়তা যেমন মন ছুঁয়ে গেল তেমনি এই বাড়ির সাথে আশাপূর্ণা দেবীর সূত্র ও কোথাও যেন অন্য একটা আকর্ষণ এনে দেয় এই বাড়ির প্রতি। কাজেই যে পুজোয় একসময় আশাপূর্ণা দেবী অংশগ্রহণ করেছেন, সেই শতবর্ষ পেরোনো গুপ্ত বাড়ির পুজোয় আপনিও ঘুরে যেতে পারেন। আশা করি মন্দ লাগবেনা।
সুমন্ত বড়াল
No comments:
Post a Comment