শীতের দুপুরে ঘুড়ির মেলায়
মেলা অর্থাৎ মিলনক্ষেত্র, বহু
মানুষের সমাগম, বহু মানুষের আনাগোনা কোন এক উপলক্ষ কেন্দ্র করে
। আমার জেলা হুগলি এই মেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে বেশ খানিক স্বতন্ত্র। রথের মেলা
কিংবা চড়ক গাজনের মেলা তো এই জেলায় সাধারণ ব্যাপার আর সেসব মেলা বিখ্যাত ও বটে,
কিন্তু একেবারে অন্য ধরনের মেলা খুঁজতে হুগলি জেলা একেবারেরই
আদর্শ জায়গা। এই জেলায় বিভিন্ন মরশুমে নানা বিচিত্র জিনিস কে উপলক্ষ করে মানুষের
সমাগম হয় অর্থাৎ মেলা বসে যায়। উদাহরণ এ রান্না খাওয়ার মেলা , আলুর দম মেলা , মাছের মেলা , মুড়ির মেলা , খুন্তির মেলা
এইসব হরেক বিচিত্র মেলার কথা বলা যেতেই পারে। আর এইসব
মেলার বয়স ও কিছু কম নয়
, মেলা গুলি সবই প্রাচীন , শতাধিক বছর পুরনো।
এই নানান মেলার ভিড়ে এবারের গন্তব্য ঘুড়ির
মেলা। অর্থাৎ ঘুড়ি কে উপলক্ষ করে মানুষের মিলনক্ষেত্র। সাধারণত পৌষের শেষের দিকে
এই মেলা আয়োজন হলেও তিথি নক্ষত্রের ফেরে পৌষের শেষের থেকে মাঘের শুরুতে ও এই মেলা
হয়ে থাকে, তবে এই ঘুড়ির মেলার প্রধান
উপলক্ষ ঘুড়ি না বলে একটি বিশেষ জনপদের বিশেষ সম্প্রদায়ের এক বিশেষ পুজো বলা যেতে
পারে।
হুগলি জেলার বেগমপুর অঞ্চল তাঁতশিল্পে প্রসিদ্ধ
এক জনপদ। বেগমপুর ও তার আশে পাশের অঞ্চল ছোট তাজপুর, খরসরাই তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। প্রত্যেক
পৌষে কিঙ্গবা মাঘের প্রথমে এই অঞ্চল
মেতে
ওঠে তাঁতি
সম্প্রদায়ের বিশ্বকর্মা পুজো কে কেন্দ্র করে আর এই পূজাকে উপলক্ষ করেই ঘুড়ির
মেলা। বিশ্বকর্মা পুজো সাধারণত হয় ভাদ্র সংক্রান্তিতে তবে তাঁতি বিশ্বকর্মা পুজোর
সময় পৌষে। তবে এ বছর এই পুজো অনুষ্ঠিত হলো মাঘের ৮ তারিখে ( বাং – ১৪২৭) ইংরেজি ২২ শে জানুয়ারি ২০১২১।
আমার শহর শ্রীরামপুর থেকে বেগমপুর এর দূরত্ব
খুব বেশি নয় , কাজেই এই শীতের দুপুরে একটা অন্যরকম
উৎসবে সামিল হতেই হয়। সেইমতো বেরিয়ে পড়া বেগমপুরের তাঁতি বিশ্বকর্মা পুজো দেখার
জন্য। এই পূজা সম্পর্কে একটু বলি। বেগমপুর অঞ্চল জুড়ে প্রায়
পঞ্চাশ টি বারোয়ারি বিশ্বকর্মা পুজো আয়োজিত
হয়। লাইট প্যান্ডেল এ বেশ চমকপ্রদ এই উৎসব। চন্দননগরের আলোকসজ্জা, থিমের মণ্ডপসজ্জা বেশ আকর্ষণীয়।
বেগমপুর তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ আর তাঁতি সম্প্রদায় এর উৎসব, তাদের আরাধ্য দেবতা বিশ্বকর্মা কে। এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো এই
তাঁতি বিশ্বকর্মার মূর্তির সাথে প্রচলিত বিশ্বকর্মা মূর্তির বিস্তর ফারাক। এই
বিশ্বকর্মার বাহন ঘোড়া, হাতি
নয়। প্রচলিত বিশ্বকর্মা চতুর্ভুজ হলেও তাঁতি বিশ্বকর্মা কিন্তু দ্বিভুজ।
রাস্তার দু'পাশে বিস্তৃর্ণ চাষের জমি আর এই জমি জুড়ে মানুষের ভিড়। সবাই ঘুড়ি ওড়াতে ব্যস্ত , বলা ভালো লাটাই মাঞ্জা সুতো নিয়ে আকাশকে জয় করে নিতে ব্যস্ত। ভোকাট্টা চিৎকারে তখন গমগম করছে বারুনিঘাটা। দেখা হল সাজ্জাদ শেখের সাথে। সাজ্জাদ শ্রীরামপুর থেকে গেছেন , ঘুড়ি বিক্রেতা। নানান রঙয়ের নানান ধরনের ঘুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছে সে। আর বিক্রি বাট্টা এতটাই ব্যস্ত যে কথা বলার ফুসরত টুকু নেই তার কাছে। সাজ্জাদ এর মত অনেকেই আশপাশ থেকে ঘুড়ির সম্ভার নিয়ে এসেছেন আর বিক্রিবাট্টাও চলছে দেদার আর ঘুড়ির সাথে সাথে ফুচকা , ঘুগনি , চা , চাওমিনের অস্থায়ী দোকান ও রয়েছে রাস্তাজুড়ে। এক কথায় ঘুড়ি কে কেন্দ্র করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে মেলা আর মানুষের ভিড়। আর এত মানুষ যেখানে সেখানে টুকরো টুকরো ছবিতে চোখ আটকে যায়। যেমন একটা কাঁটা ঘুড়ি কে ধরার জন্য মানুষের উন্মাদনা। ছোট-বড় সব বয়সের মানুষ হাতে বড় বাঁশের লগা নিয়ে জমির আলপথ দিয়ে দৌড়চ্ছে, ঘুড়ি ধরতে নদীতে নেমে যেতেও পিছপা হচ্ছে না কেউ। আবার অন্যরকম ছবি ও চোখে পড়ছে ঘুড়ি নিয়ে ভাই বোনের খুনসুটি কিংবা চাষির নিজের জমি পাহাড়া দেওয়ার ছবি।
যেমন স্থানীয় বাসিন্দা ভদ্রেশ্বর বাবু , তিনি জানাচ্ছেন মানুষ ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে এতই মশগুল হয়ে যান যে চাষের জমিতে নেমে পড়ে চাষের ক্ষতি হয়, তাই এই সময় জমি ঘিরে রেখে পাহারা দেওয়া তাতেও নিস্তার পাওয়া যায় না। কিন্তু মানুষের উৎসব এনারাও শামিল তাই কিছুটা ক্ষতি মেনে নিয়ে এনারাও উৎসবে মেতে উঠেছেন । এই নানা ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে করতে কখন যে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে খেয়াল করিনি। গোধূলির সেজে উঠেছে আলপথ, দিগন্ত বিস্তৃত চাষের জমি, আর আকাশে অস্তগামী সূর্যকে বিদায় জানাচ্ছে কোন চাঁদিয়াল । সামনেই একটা চায়ের দোকানে চা এ চুমুক দিতে দিতে এইসব দৃশ্য উপভোগ করছি , তখন সন্ধ্যা নামছে। চায়ের দোকানের মানুষের কাছেই জানলাম এই ঘুড়ি মেলা একদিনের সকাল থেকে মানুষের সমাগম হয় , এবছর অতিমারির কারণে ভিড় কিছুটা কম। অস্ত যাওয়া সূর্যের লাল রঙে রেঙেছে আকাশ আর দূর থেকে ভেসে আসছে ভোকাট্টার শব্দ। হয়তো এটাই এই বছরের ঘুড়ির মেলার যবনিকা পতনের আহ্বান। আর নদীর ধারে ছোট মফঃস্বল খরসরাই বেগমপুর তখন এলইডি আলোয় সেজে উঠেছে রাস্তায় রঙিন শীত পোশাকে সেজে ওঠা মানুষজন।
এবার ফেরার পালা কাটা ঘুড়ির ঠিকানা থাকে না ভেসে যায় সে , এবারের ঘুড়ির মেলা শেষ আর এ কাটা
ঘুড়ি গুলো হয়তো ঠিকানা পাবে আগামী বছরের এই ঘুড়ির মেলায়।
No comments:
Post a Comment