Saturday, 23 January 2021

 

      কাঠের টুকরো পুতুলের জীবন পায়  যে গ্রামে

                                                                                                                           সুমন্ত বড়াল


এ গ্রামে তে জীবন মানে পুতুল খেলা তবে পুতুল খেলার মতো সহজ জীবন যাত্রা নয় এ গ্রামের মানুষের জীবন যাত্রার সাথে জড়িয়ে কঠিন লড়াই তবে হ্যাঁ সবটাই পুতুল কে নিয়ে এ গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙে পুতুল নিয়ে, দিনের প্রত্যেক মুহূর্ত নানা কাজের সাথে জড়িয়ে আছে পুতুল, শুধু পুতুল নয় দেব দেবীর মূর্তি থেকে শুরু করে আসবাব সব কিছু নিয়েই এই গ্রাম

একটা কাঠ কে কাটাই ,চেরাই করে কি অপূর্ব শিল্প সুষমায় একটা আকার দিয়ে দেওয়া যায় তা এই গ্রামে এসে চাক্ষুষ করতে হয়

পূর্ব বর্ধমান বলতেই মনে পড়ে সীতা ভোগ, মিহিদানা, কালনার ১০৮ শিব মন্দির, টেরাকোটা, বর্ধমান রাজ বাড়ি আবার পূর্ব বর্ধমান মানেই এই পুতুলের গ্রাম এই জেলার বিখ্যাত কাঠের পুতুলের গ্রাম অগ্রদ্বীপের নতুন গ্রাম

হাওড়া কাটোয়া শাখার পরিচিত জনপদ অগ্রদ্বীপ অগ্রদ্বীপ খ্যাত তার গোপীনাথের জন্য তবে অগ্রদ্বীপ রেল স্টেশনের পশ্চিম দিকে কিছুটা গেলেই সবুজে ঘেরা লাবণী ভাস্কর,জবা ভাস্করদের নতুন গ্রাম, তবে গ্রাম না বলে পাড়া বলা ভালো নতুন গ্রামের কাঠের পুতুল শিল্পীদের পাড়া একটা গোটা পাড়া সব সময় মুখরিত হচ্ছে ছেনি হাতুড়ি তে কাঠ কাটার শব্দেএকটা কাঠের টুকরো হাতুড়ি ছেনির কারিকুরি তে নানা রকম আকার পাচ্ছে আর নানা উজ্জ্বল রঙে সেজে রঙিন করছে পাড়া টাকে। সারা পাড়া জুড়ে কাঠের তৈরি পেঁচা, রাজারানী, গণেশ,রাধাকৃষ্ণ, চৈতন্য,নানা আকারের নানান পুতুল। যে পুতুল সারা বাংলা জুড়ে নানা মেলায় দেখা যায়,যে পুতুলের চাহিদা ও রয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। তবে বর্তমানে গ্রাহকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে শিল্পীদের শিল্পকলায় বৈচিত্র্যও এসেছে। এই কাঠের পেঁচা, ঘর সাজানোর আয়না কিংবা আসবাবে জায়গা পেয়ে যাচ্ছে, হয়ে উঠছে ঘর সাজাবার উপকরণ। আবার পড়ার টেবিল আকার নিচ্ছে পেঁচার মতো।


এই কাঠের পুতুল পাড়ার প্রায় প্রতিটি পরিবার যুক্ত রয়েছে এই কাজে। পরিবারে প্রায় সকলেই যুক্ত রয়েছে এই কাজেকাঠ চেরাই , খোদাই এর কাজ গুলি সাধারণত করে পরিবারের পুরুষ সদস্য রা আর পুতুলের রং,আঁকার কাজ মহিলারা। আট থেকে আশি সবাই এই কাজে যুক্ত। যেমন এই গ্রামের জবা ভাস্কর, সংসার সামলে সুনিপুন দক্ষতায়  পুতুল রঙের কাজ করছে, আবার গ্রাহক এলে দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছে বেচাকেনা। কিশোরী লাবনী ভাস্করের তুলির টান দেখে তো মুগ্ধ হতে হয়। সাধারণ আটপৌড়ে চেহারার মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এক একজন দক্ষ শিল্পী। বংশপরম্পরায় চলছে এই কাজ। ই পরিবার গুলির মধ্যেই আবার রয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী শ্রী শম্ভুনাথ ভাস্কর পরিবার। এই কাঠের পুতুল এর জন্য ১৯৬৬ তিনি  রাষ্ট্রপতি পুরস্কার,  তিনি মারা গেলেও তার কীর্তি রয়ে গেছে আর চলছে তার কর্মযজ্ঞ, তাঁর পরিবারের মানুষের মধ্যে দিয়ে। বর্তমানে প্রয়াত শম্ভুনাথ ভাস্কর এর পূত্রবধু শ্রীমত্যা করুণা ভাস্করের তত্তবধানে সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে তার পরিবারের মানুষজন ।



নতুন গ্রামের কাঠের পুতুল তৈরির সাথে গল্প কথা ও কম নেই সে গল্প কাঠের পুতুল গুলির মতোই রঙিন। এই গ্রামে পুতুলের মধ্যে বিশেষত্ব হলো কাঠের পেঁচা। নানান আকারের নানান ধরণের পেঁচার পুতুলে ছয়লাপ এই পাড়া, যে পেঁচা বাংলার কাঠের লক্ষী পেঁচা নামেই বিখ্যাত। আর এই গ্রামে পেঁচার পুতুলের আধিক্য নিয়েই আছে মজার গল্প, অগ্রদ্বীপের নতুন গ্রামের এই কাঠের পুতুল তৈরির ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রায় তিনশো বছরের বেশি সময় ধরে এই গ্রামের সূত্রধর পরিবার গুলি এই কাজ করে চলেছে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী একসময় এই গ্রামের নাম ছিল জানোকিনগর, আর গঙ্গার তীরের এই গ্রাম ছিল বনাকীর্ণ। সেইসময় এক সাধক এই গ্রামে তপস্যা করতে আসেন এবং তিনি সেই সময় গ্রামবাসী দের মা লক্ষীর বহন পেঁচার আরাধনা করতে বলেন, যাতে গ্রামের প্রভূত উন্নতি সাধন হবে। আবার অন্য জনশ্রুতি অনুযায়ী পুরানো দিনে এই গ্রাম ছিল ভীষন নিরিবিলি সারা গ্রাম জুড়ে ছিল পেঁচার আধিক্য সেই থেকে সংস্কার বসতই এখানে পেঁচার পুতুল তৈরি শুরু হয়।



নানা জনশ্রুতি, লোকশ্রুতি নিয়ে সেই ঐতিহ্য কে সামনে রেখে সুদীর্ঘ অতীত থেকে আজও চলছে কাঠের পুতুল তৈরির কাজ। সাধারণত গামার কাঠ থেকে এই পুতুল গুলো তৈরি। শিল্পী গৌড় সূত্রধর জানালেন তাদের এই কর্মকান্ডের কথা। গামার কাঠ ওজনে হালকা হওয়ার জন্য পুতুল তৈরিতে এর বিশেষ ব্যবহার, তবে আসবাব তৈরিতে অন্য কাঠ ব্যবহার করা হয়। কাঠ প্রথমে চেরাই করে আনা হয়। তারপর ছেনি হাতুড়ির ছোয়ায় রূপ পায় পুতুলে। আসবাব এর ক্ষেত্রেও তাই তবে সেখানে গালা রঙ করে তারপর পুতুল আঁকা। সবমিলিয়ে পুতুল তৈরির কর্মকান্ড জমজমাট।



সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঠের পুতুল শিল্পেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষের চাহিদা মেনে পেঁচা স্থান পেয়েছে চেয়ার কিংবা বুক সেলফ এ। রাজরানী হয়ে উঠেছে কানের দুল, চাবির রিং। এতকিছুর পরও কোথাও যেন প্রতিযোগিতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে এই কাঠের পুতুল শিল্প। হতে পারে শিল্পের পরিশ্রম অনুযায়ী দাম না পাওয়া কিংবা কিছুটা প্রচারের অভাব। তবে বর্তমানে সরকার কিছু ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন মেলা, ওয়ার্কশপে স্থান পাচ্ছে শিল্পীরা, শিল্পীদের গ্রামে আয়োজিত হচ্ছে বাৎসরিক উৎসব মেলা। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতেও ভিড় বাড়ছে এই পুতুল গ্রামে। এইভাবে সুদিন ফিরে আসুক কাঠের পুতুলের গ্রামের, ঐতিহ্য, গৌরব নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক কাঠের পুতুলের এই নতুন গ্রাম।


কাঠপুতুলের গ্রামের ছবি কথা

2 comments:

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...