কিংবদন্তীর এক সেতু
বেনারসের মাতৃ ঋণ মন্দির এর কথা তো সকলের জানা। মণিকর্ণিকা ঘাটে , গঙ্গা বক্ষে অর্ধেক ডুবে থাকা সেই মন্দির খানা। জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, প্রায় ৫০০ বছর আগে রাজা মান সিংহের মা রত্না বাইয়ের জন্য এক নামহীন ব্যক্তি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি তৈরি করার পরে, সেই ব্যক্তি গর্ব করেছিলেন যে তিনি তার মাতৃঋণ শোধ করেছেন। যেহেতু নিজের মায়ের প্রতি ঋণ কখনও শোধ করা যায় না, তাই মায়ের অভিশাপের কারণে মন্দিরটি হেলতে শুরু করেছিল। একারণে মন্দিরটি মাতৃঋণ মন্দির নামেও পরিচিত । এই কীংবদন্তী উপর নির্ভর করেই বেনারস এর রত্নেশ্বর মন্দির হয়ে উঠেছে মাতৃ ঋণ মন্দির। তবে সে তো সুদূর উত্তর প্রদেশের কথা, এই বাংলা তেও রয়েছে এক কীংবদন্তী নির্ভর কাহিনী। তবে সেটা কোন মন্দির নিয়ে নয় অবশ্য, সে কাহিনী এক সেতু কে ঘিরে আর এই কাহিনী তে মা নয় মাসির কথা।
![]() |
মাসি সেতু |
তাহলে আগে গল্প টা বলে নি, তারপর ঘুরে আসা যাবে সেই সেতু তে , যে সেতু পরিচিত মাসি সেতু নামে ।
গল্প টা সেই মোঘল আমলে, বর্ধমান এর সিংহাসনে তখন রাজা নিত্যানন্দ দালাল ওরফে দানিশমন্দ। যুবক বয়সেই বনওয়ারিবাদ এর দায়িত্বে রাজা দানিশমন্দ। যিনি ছোট বয়স থেকেই তার মাসির কাছে লালিত পালিত। রাজার মনে বহুদিনের ইচ্ছে, এই যে মাসি তাকে এত যত্ন করেন তাই তিনি মাসির ঋণ শোধ করবেন। ভাবনা মতই কাজ, রাজা মাসির কাছে জানতে চান তার মনের ইচ্ছে।
বৃ দ্ধা মাসি, রাজা কে জানালেন যে তার নৌকা করে গঙ্গাস্নানে যেতে খুব অসুবিধা হয় তাই সে যদি সেতু বেধে দেয় তাহলে তার এবং বাকি সকলের গঙ্গা স্নানে যেতে খুব সুবিধা হয়।
মাসির ইচ্ছে জানার সাথে সাথেই , রাজা কোষাগারে র দুজন কর্মচারী কে নিযুক্ত করলেন সেতু নির্মাণের কাজে। এক বছর দুই মাস সময় ধরে, প্রায় তেইশ হাজার টাকা ব্যায় করে দুই খিলানের উপর এক মজবুত সেতু নির্মিত হয়। আসলে রাজার কাছে মাসির ইচ্ছের থেকেও বড় ছিল তার মনের ইচ্ছা অর্থাৎ মাসির ঋণ শোধ। তাই রাজা সেই সেতুর নাম দেন মাসি সেতু।
কাহিনীর ঠিক এখানে এসেই মিল খুজেঁ পাওয়া যায় বেনারসের রত্নেশ্বর মন্দির বা মাতৃ ঋণ মন্দিরের সাথে । রত্নেশ্বর মন্দির যেমন কিছুটা গঙ্গা বক্ষে ডুবে গিয়েছিল তেমনই এক অজানা কারণে মাসি সেতুও একরাতে র মধ্যেই ভেঙে পড়ল। মাসি র সেতুর উপর দিয়ে গঙ্গা স্নানে যাওয়া হলনা। আর শোধ হলনা রাজার মনের ইচ্ছে, আদতে স্নেহের , ঋণ কি শোধ করা যায় ? তবে এই সেতু নির্মাণে কোন গাফিলতি কিন্তু ছিলনা । পরবর্তীতে শোনা যায় পার্শ্ববর্তী রাস্তা নির্মাণের জন্য ওই সেতু থেকে ইট খোলার চেষ্টা হলে শ্রমিক রা সমর্থ হয়না। ।
বহরানের গাজনের সেই রাত এর স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল। সেই স্মৃতি কে উস্কে আবার হাজির বহারানে বন্ধু শুভঙ্কর এর বাড়ি। উপলক্ষে র প্রয়োজন নেই তবু একদিনের বর্ষা উজ্জাপন। বলাবাহুল্য বর্ষা নিরাস করেনি। বৃষ্টি বাদল ভরা নদী সবই ছিলো এই মন মেরামতির সফরে। সফর শেষের দিকে চোখে পড়ল মাসি সেতু। আসলে গতবার যখন এসেছিলাম তখন ও চোখে পড়েছিল এই সেতু তবে গল্প টা অজানা ছিলো। এবার আমাদের টোটো সারথী মিঠুন এর উদ্যোগে এই অজানা কাহিনী জানতে পারা গেল যদিও কাহিনী টা গুছিয়ে দিল শুভঙ্কর। যখন এই গল্প হচ্ছে, মেঘ রোদ এর জমাটি আড্ডা আকাশ জুড়ে। আমরা দাড়িয়ে গঙ্গাটিকুরি থেকে উদ্ধারণপুর বাস রাস্তা র উপর ছোট্ট সাঁকো তে , সাঁকো র একপাশে ঈশাণী নদী, আর একপাশে শিবাই নদী। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই ঈশাণী নদীর দুই তীরে দুই সতী পীঠ। তবে এই উদ্ধারণপুরের রাস্তায় ঈশানী মিশেছে শিবাই এর সাথে। আর এই মিলন স্থলে দাড়িয়ে পশ্চিম দিকে তাকালেই চোখে পরে কিংবদন্তী র সেই মাসি সেতু। সেবার শেষ বসন্তে এই দুই নদীর শীর্ণ চেহারা চোখে পড়েছিল বর্ষার ছোয়া পেয়ে ভরে উঠেছে এই দুই নদী। মিলনস্থল টইটম্বুর স্থানীয় রা যে স্থান কে বলে কান্দর , কিন্তু সেই সেতু খানি একঝলক দেখলে মনে হয় কেউ যেন কথা দিয়ে কথা রাখেনি। কেউ বলেছিল তুমিই হবে যোগসূত্র, তুমি মিলিয়ে দেবে দুই পারের সব সুখ দুঃখ। কিন্তু অসমাপ্ত থেকে গেছে সে কথা। দুপারের গল্প শোনা হয়নি। কথা না রাখা আর না পারার অভিমানে সে যেন নিজেকে ঢেকেছে কঠিন আগাছা তে।![]() |
বর্ষায় শিবাই নদী ও মাসি সেতু |
একটা নদীর মাঝে দুটো খিলান। ঘোর বর্ষা তে ছবিওয়ালা দের কাছে সাবজেক্ট হিসাবে যা মন্দ না।
শুভঙ্কর আর মিঠুনের কাছে কীংবদন্তীর কথা শুনে প্রথমেই মনে এসেছে বেনারসের মাতৃ ঋণ মন্দিরের কথা। যে গল্প দিয়ে শুরু করলাম।
আসলে
বহারান নিরাস করে না কিছুনা কিছু
উপহার রেখেই যায় সেবার গাজনের রাত আর এবারের ঝটিকা
সফরে এক কীংবদন্তী। দূরে দাড়িয়ে থাকা প্রাচীন দুই খিলান আর এক অসমাপ্ত সেতু। এত গল্প
কাহিনী যাকে ঘিরে। এসব কাহিনীর প্রামাণ্য সত্যতা আছে কিনা জানা নেই, তবে কালের আগাছায় ভরে যাওয়া মাসি সেতু যে অনেক ইতিহাসের
সাক্ষী তা বলা ই যায়।
এসব নানা ভাবনার মাঝে হাজির টোটো সারথী মিঠুন আসলে তার ওপর দায়িত্ব ট্রেন ধরানোর। এখনও দুটো নদী পেরনো বাকি। কাজের মাসি সেতু ভালো থেকো আবার ফিরব আমার প্রিয় পল্লী, তখন নতুন গল্প শুনিও আবার।
No comments:
Post a Comment