Tuesday, 27 July 2021

চন্দননগরের তিনপক্ষ কালের বারোয়ারী পুজো

 

         চন্দননগরের তিনপক্ষ কালের বারোয়ারী পুজো

 

২০২১ সালের মাতৃ মূর্তি 


একসময় যেখানে ছিল কুস্তিগীর দের আখড়া এখন সেই খানে ব্যস্ত রাস্তার পাশে দাড়িয়ে এক বারোয়ারি  মন্দির। আর যে মন্দিরে সারা বছরই চলে নানা পুজা অর্চনা। তবে এই মন্দির পরিচিত তার বিশেষ একটি পুজোর কারণে। যে বারোয়ারি পুজো চলে দেড়মাস ধরে। তিন পক্ষকাল সময় ধরে কোন বারোয়ারি পুজো যেমন বিরল তেমনি বিরল পুজিত দেবী। আমাদের আজকের গল্প শহর চন্দননগর এর ভুবনেশ্বরী তলার ভুবেনেশবরী পুজো নিয়ে। দেড় মাস ধরে চলা এমন পুজো সত্যিই বিরল। এই চন্দননগর এর চালকে পাড়াতেই ভুবেনেশবরীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির থাকলে বারোয়ারি পুজো দেখা যায়না।

এই পুজো কে কেন্দ্র করেই এই এলাকার নামকরণ।



তবে প্রাচীন এই পুজো নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী ও নানা লোকশ্রুতি ।।

লোকশ্রুতি আছে, এক দিন গঙ্গার ঘাট সংলগ্ন আখড়ায়, হঠাৎ ই এক বয়ষ্ক মহিলা এসে উপস্থিত হন। আখড়ার সদস্য রা স্বভাবতই কিছুটা অবাক হন এবং সেই মহিলার কাছে জানতে চান যে তিনি তাদের মুগড় ভাজার আখড়ায় কি করছেন? বৃদ্ধা তখন তাদের জানায় যে দস্যু রা তার সব সম্পতি লুঠ করেছে তিনি তাই আশ্রয় চাইছেন। আখড়ার সদস্য রা সব শুনে বয়ষ্কা কে সেখানে আশ্রয় দেন। সেই রাতেই তাদের স্বপ্নে আসেন দেবী ভুবনেশ্বরী , এবং বলেন তার মন্দিরে দস্যু রা লুটপাট চালিয়েছে তাই তিনি এখানে আশ্রয় চান। তিনি বৃদ্ধার রূপ ধরে তাদের আখড়া তে এসেছেন।

এরপর থেকেই স্থানীয় মানুষ দের উদ্যোগে শুরু হয় ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো। তবে নাম ভুবনেশ্বরী তলা হলেও এই মন্দিরে বর্তমানে সব দেবদেবীর পুজোই জাকজমক সহকারে হয়ে থাকে। তবে মূল উৎসব এই  ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো। যা চলে তিন পক্ষ কাল অর্থাৎ দেড় মাস ধরে।

সোজা রথের দিন শুরু হয়ে পুজো চলে দেড়মাস। আগে স্নানযাত্রা তে এই পুজো শুরু হত কিন্তু বর্তমানে তিথি পরিবর্তিত হয়ে সোজা রথের দিন থেকে পুজো শুরু হয়।



এই রীতি মেনেই প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই পুজো। ঠিক কবে থেকে এই পুজো র সূচনা তার হিসাব নেই, তবে এই পুজোর প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাস ও নেই।

চন্দননগর এর ভুবনেশ্বরী তলার ভুবনেশ্বরী মাতার সাথে এক সুতোয় বাধা এই জেলার ই সেনেটের প্রাচীন বিশালাক্ষী মাতা। যে বিশালাক্ষী মাতার ফাল্গুন সংক্রান্তির বার্ষিক উৎসব “রান্না খাওয়া মেলা” মেলা বিখ্যাত।

আদতে ভুবনেশ্বরী তলার ভুবনেশ্বরী মাতা সেনেটের বিশালাক্ষী মাতার ই আর এক রূপ।

অতীতে আষাঢ় মাস থেকে তিনপক্ষ কাল সেনেটের মন্দির বন্ধ থাকত , সেই সময় এই ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো আয়োজিত হত। তবে সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু তে বদল এসেছে। বর্তমান এ সেনেটের মন্দির বন্ধ  থাকেনা ঠিকই , তবে সেনেটের বিশালাক্ষী মাতার নিত্য পুজো সম্পন্ন হলে ,তারপর ভুবনেশ্বরী পুজো শুরু হয়।

সবমিলিয়ে ইতিহাস, লোকশ্রুতি র মিলমিশে আধুনিক এই শহরের মধ্যে প্রাচীন এই পুজো জমজমাট।

শুধু যে এই পুজো দেব মাহাত্ম্য বা ইতিহাস বৈচিত্র্য পূর্ণ তা নয়। মাতা ভুবনেশ্বরীর যে মূর্তি তাতে ও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। মূল দেবী মূর্তির ডান পাশে রয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব, বাম পাশে নারদ মুনি, নীচে উপবিষ্ট রয়েছেন বম্ভ্রা, বিষ্ণু। দেবীর সাথে রয়েছে জয়া, বিজয়া , নন্দী, ভৃঙ্গি, আর সখী গণ। সবমিলিয়ে বহু মূর্তির মিল মিশে এক অন্যরকম মাধুর্য এর সৃষ্টি হয়।

চন্দননগর ভুবনেশ্বরী তলার দেড় মাস ধরে চলা এই পুজো সম্পূর্ণ ভাবে মানুষের ভক্তির উপর টিকে আছে। স্থানীয় মানুষ শুধু নন, দূর দুরান্ত থেকে মানুষ জন দেবীর কাছে মানসিক করেন এবং তারা এক এক দিনের পুজোর ভার নিয়ে নেন। প্রত্যেহ পুজো দানে মানুষের উত্সাহ এতটাই যে এক এক দিনে দু তিনজনের নামে পুজো উত্সর্গ করতে হয়। তাতেও সামাল দেওয়া যায়না।

পুজোর কর্মকর্তা দের কথায় “সবই মা এর কৃপা, মা এর মনের ইচ্ছা মা নিজেই পূরণ করেন”। আর ভক্তরাও পরম আনন্দ পান।



এককথায় ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো যেন দেড় মাস ধরে চলা ভক্ত ও ভগবান এর মিলন উৎসব ।

তিনপক্ষ কাল ধরে চলা এই পুজো তে প্রত্যহ ভোগ হলেও বিসর্জন এর দিন ভুবনেশ্বরী তলায় নরনারায়ণ সেবা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ভুবনেশ্বরী তলার খুব কাছেই চালকেপাড়া তে রয়েছে ভুবনেশ্বরীর প্রাচীন মন্দির, সেখানে মাতা বারোমাস পুজীত হন ,কিন্তু ভুবনেশ্বরী তলায় এই দেড় মাস ব্যপী এই পুজোর জৌলুস অন্যরকম, ভক্ত দের আনাগোনা, সুবিশাল মূর্তি, ঢাকের বাদ্য, আলো ঝলমলে নবনির্মিত নাট মন্দির সবমিলিয়ে এ এক ব্যাতিক্রমী উৎসব । এই বঙ্গে তিনপক্ষ কাল ধরে চলা এমন বারোয়াঁরি উত্সব সত্যি ই বিরল।

No comments:

Post a Comment

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...