গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো
( প্রথম বারোয়ারী ও বাংলার প্রথম জগদ্ধাত্রীমন্দিরের কথা )
সুমন্ত বড়াল
বাংলার প্রথম জগদ্ধাত্রী মন্দির এর বিগ্রহ |
রোজ কার জীবন যাপনের একঘেঁয়েমি থেকে একটু অন্যরকম স্বাদ এনে দেয় উৎসব। উৎসব মানেই চেনা ব্যস্ততা ভুলে অন্যরকম ব্যস্ততা যাতে বাধ্যবাধকতা নেই কিন্ত মনের আনন্দ আছে। এই আনন্দ মুখর দিন গুলোর জন্য মানুষ অপেক্ষায় থাকে বছরভর , আসলে উৎসব মানে একরাশ আনন্দ মানুষে মানুষে মিলমিশ। আর আমরা সকলেই তো উৎসব প্রিয়।
তেমনই এক উৎসব এর ইতিহাস, কাহিনী কিংবা লোকশ্রুতি এইসব নিয়ে গল্প হোক।
হুগলী জেলার প্রান্তিক এক জনপদের
এর কথা। আচ্ছা হুগলী জেলার জগদ্ধাত্রীপূজা বলতেই কি মনে আসে?
চন্দননগর, আলোর খেলা আর বিশাল দেবী মূর্তি , তাই তো?
কিন্তু চন্দননগর ছাড়াও হুগলী জেলার জগদ্ধাত্রীপূজা ইতিহাস রয়েছে
জেলার প্রান্তিক জনপদ গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রীপূজা তে এলে আপনি খোঁজ পাবেন সেই ইতিহাসে র । গুপ্তিপাড়ার সেই গল্পই
বলব। আসলে গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রীপূজা র সাথে জড়িয়ে রয়েছে বারোঁয়ারি পুজোর ইতিহাস। যে বারোঁয়ারি পুজো নিয়ে আজ এত মাতামাতি তা প্রথম শুরু হয় এই গুপ্তিপাড়ায়।
আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে ২৬৩ বছর আগের এক দুর্গাপুজোর সময়। সে বছর
গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের কিছু মহিলা স্থানীয় জমিদার বাড়িতে দূর্গাপুজা দেখতে গিয়ে অপমানিত হন, বাড়ি ফিরে তারা সে কথা জানালে , সেই বাড়ির ছেলেরা নিজেদের উদ্যোগে পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দুর্গাপূজা তো তখন হয়ে গেছে তাই কার্ত্তিক মাসের শুক্ল নবমী
তারা পূজা আয়োজন করে। শুরু হয় অবিভক্ত বাঙলার প্রথম যৌথ উদ্যোগে পুজো যা রাজবাড়ির আঙিনায় নয় বরং সাধারণ এর উঠানে যার লৌকিক নাম বারোয়ারী পুজা।
বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী |
দেবীর নাম হয় বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী । সেই থেকে আজও গুপ্তিপাড়ার বিন্ধ্যবাসিনী তলা তে সাড়ম্বরে পালিত হয় এই পুজো । গুপ্তিপাড়া ১২ জন ব্রাহ্মণ যুবক মিলে প্রথম রাজবাড়ীর ঠাকুর দালান থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে এলো উৎসব কে। উৎসব তো সকলের রাজা বা জমিদারের আঙিনায় তা বন্দী থাকবে কেন? আজ থেকে ২৬৩ বছর আগে যেন এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই বারো ইয়ার।
তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় এই ঘটনার উল্লেখ করা হয়।
সেই সময় স্থানীয় ব্রাহ্মণরা
বারোজন কে নির্বাচিত করে একটি কমিটি গঠন করেন ।যারা বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কাছ থেকে সেই সময় ৭০০০ হাজার টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে।
এই বিষয়ে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত "ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া " পত্রিকায় ১৮২০ সালে একটি খবর প্রকাশিত হয়। যাতে লেখা হয়।
" A new species of puja which has been
introduced into Bengal within the last thirty years called barowaree, About
thirty year's ago at Guptipara near Santipoora a twon celebrated in Bengal for
it's numerous colleges a number Brahmans formed on association for the
celebration of puja independently of the rules of shastra "
অর্থাৎ এই পত্রিকার প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এই পুজা শুরু ১৭৯০ সালে , ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকা এই মত গ্রহণ করেছে তবে সাল নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। বিন্ধ্যবাসীনি তলা নিবাসী উষানাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয় এই পুজোর দ্বিতীয় বর্ষের পুজোর একটি ফর্দ খুঁজে পান। যে ফর্দের কথা শ্রী বিনয় ঘোষ তার পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (পাতা ৪৭৭ ২য় সংষ্করন) । যে ফর্দের উল্লেখিত সাল বাংলার ১১৬৭ সন অর্থাৎ ১৭৬০। বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী মূর্তিটিও বৈশিষ্ঠ পূর্ণ । সিংহ বাহিনী দেবীর ডান পাশে থাকেন মহাদেব বাম পাশে নারায়ণ।
পুজোর রীতি নীতি তে ও রয়েছে নানা বৈশিষ্ঠ। শক্তির আরাধনা হলেও এই পুজোতে বলি প্রথার চল নেই। মূলক শুক্ল নবমী তিথিতে চারপ্রহরের এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পুজো দিন সকাল থেকেই বহুমানুষের সমাগমে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর। ঢাক , ঢোল , করতাল , সানাই এর সম্মিলিত সুরে মুখরিত হয়ে হয় বিন্ধ্যবাসিনী তলা। তবে এই পুজোর আরেক আকর্ষণ তার ভোগ আচারে , মূলত খিচুরি ভোগের আয়োজন করা হয় বটে কিন্তু এই ভোগ গ্রহন করে সারা গুপ্তিপাড়ার মানুষ শয়ে শয়ে মালসা র আয়োজন করা হয়। দুপুরে চলে মালসা ভোগ বিতরণ সাথে চলে পংক্তি ভোজন। এই পুজোর আরো এক বৈশিষ্ঠ তার বিসর্জনে। পুজোর পরদিন বিসর্জনের দিন সন্ধ্যেবেলা আয়োজন হয় বাজি প্রদর্শনীর। প্রাচীন এই রীতির আজো বদল ঘটেনি তবে সরকারী নির্দেশ মেনে পরিবেশ বান্ধব বাজীই পোড়ানো হয় এই প্রদর্শনী তে। স্থানীয় রথ তলায় আয়োজন করা হয় এই বাজী খেলার যা চলে সন্ধ্যেথেকে রাত পর্যন্ত। এই বাজী উৎসব শেষে মায়ের নিরঞ্জন সম্পন্ন হয়।
কাঁঠালেশ্বরী |
এবার আসি গুপ্তিপাড়ার আর এক প্রাচীন বারোয়ারির কথায় । তেলিপাড়া কাঁঠালেশ্বরী বারোয়ারি । এই পুজো শুরু হয় বাংলা ১২১৭ সালে। যেখানে বিন্ধ্যাবাসিনী পুজোর প্রচলন হয়, সেখান থেকে অনেকটাই দূর তেলিপাড়ার এই পুজোমণ্ডপ৷ এই এলাকার বাসিন্দা, বিশেষত মহিলাদের পক্ষে অতদূরের প্রতিমা দর্শন সহজ ছিল না। তাই এই এলাকার বারোয়ারি।
কাঁঠালতলায় শুরু হয় পুজো। এটিই গুপ্তিপাড়ার দ্বিতীয় জগদ্ধাত্রী পুজো । বাংলা ১২১৭ অর্থাৎ ইংরাজি ১৮১০ খ্রী এই পুজো সম্ভবত বাংলার দ্বিতীয় বারোয়ারী পুজো । কাঠালেশ্বরী বারোয়ারির ৩১ বছর পরে শুরু হয় আর এক বারোয়ারির
। যে পুজোর সাথে জড়িয়ে ভবাণীচরণ দাস, দ্বারিকানাথ ভট্টাচার্য, সাতকড়ি কর মজুমদার, কালীচরণ প্রামাণিক ও কালাচাঁদ মুখোপাধ্যায় নামে পাঁচজন বালক এর নাম । এই পাঁচ বালক মিলে ১২৪৮ সালে গুপ্তিপাড়ার পাঠমহলা অঞ্চলে আর এক পূজো শুরু করেন । পাঁচ বালকের হাতে সৃষ্টি এই পুজোর নাম হয় বালকেশ্বরী জগদ্ধাত্রী । গুপ্তিপাড়ায় পাটমহল এলাকায় রয়েছে
রঘুনাথতলায় রঘুনাথজির মন্দির । এই রঘুনাথজির মূর্তি
নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা যায় সেই কথা থাক আবার প্রসঙ্গে ফিরি । এই
মন্দিরকে কেন্দ্র করেই বালকেশ্বরী
বারোয়ারি পুজোর চল শুরু । আজও এখানে সংকল্প করা হয় রঘুনাথের নামে। পুজোর সময় শিলা রাখা হয় মণ্ডপে। এই পুজোর এটি বিশেষ
বৈশিষ্ট্য ।
বালকেশ্বরী |
এই তিনটি পুজো ছাড়াও গুপ্তিপাড়ার দাস বাড়ির পুজো ও বেস প্রাচীন সেখানে পঞ্চমুণ্ডী র আসনে দেবী আরাধনা হয়। তবে সে প্রসঙ্গে যাবো না বরং গুপ্তি পাড়ার অন্তর্গত সোমড়া বাজারে এসে শেষ করব এই উৎসব আখ্যান। সোমড়ার মিত্র মুস্তাফী বাড়ি কিংবা আনন্দময়ীর মন্দিরের কথা বহুল প্রচলিত, লোকশ্রুতি আছে রাণীরাসমণী এই মন্দিরের আদলেই নাকি দক্ষিণেশ্বএ এর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । কিন্তু সোমড়া কেন?
আসলে এই সোমড়া বাজার গ্রামেই রয়েছে বাংলার প্রথম জগদ্ধাত্রী মন্দির। আর এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে মুঘল সম্রাট শাহ আলম এর নাম। সোমড়া র ২৫৭ বছরের প্রাচীন দেওয়ানজি মন্দির।
এই মন্দির বিগ্রহ ও পুজো নিয়ে বিস্তারিত ইতিহাস জানান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এই পরিবারের বর্ষিয়ান সদস্য
রীতেন্দ্রনারায়ণ রায় ।তিনি জানান তাঁদের পারিবারিক এই পুজো এ বছর ২৫৭তম বর্ষে পদার্পণ করেছে তাঁদের পূর্বপুরুষ রামশঙ্কর রায় ১১৭২ বঙ্গাব্দে শেষ মোঘল সম্রাট শাহ আলমের দেওয়ান ছিলেন। সেই সময় মোঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন এরকম ১০ থেকে ১২ জন বিদ্রোহীকে সম্রাট ধরার জন্য রামশঙ্কর রায়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশ পাওয়ার পরই রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন রামশঙ্কর রায়। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন রাতে তাঁকে স্বপ্নে মা দেখা দিয়ে বলেন তুই আমাকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠা কর। সোমড়ার মাটি খুঁড়ে জগদ্ধাত্রী মাতার একটি অষ্টধাতুর মূর্তি উদ্ধার করে মাকে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেই বছরই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৬১ সালে এই প্রাচীন মূর্তি টি চুরি হয়ে গেলে
পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে রায় পরিবারের
সকলে মিলে মায়ের নতুন একটি অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করে পুনরায় মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। জগদ্ধাত্রী মন্দিরে পঞ্চানন ও শিবের মূর্তি রয়েছে। মূর্তি কোন সময়কার আজ পর্যন্ত সেই সম্পর্কে কেউ আলোকপাত করতে পারেননি। এখানে লক্ষ্যণীয়
শিবের কোলে লক্ষ্মী ও গণেশ এবং মাথার কাছে সরস্বতী ও কার্তিক বিরাজ করছেন। শিবমূর্তির বিশেষত্ব হল শিবের দাড়ি রয়েছে যা বিরল। অনুমান করা যায় যেহেতু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের দাড়ি থাকে তাই বলা যেতে পারে ধারণা সেই সময় মোঘল স্থাপত্য ও হিন্দু স্থাপত্যের একটা মেলবন্ধন হয়েছিল ওই শিবমূর্তির মধ্য দিয়ে।
হুগলী জেলা বরাবই উৎসব মুখর। সে রথ, দূর্গোৎসব,
জগদ্ধাত্রী যাইহোক না কেন,
এই জেলার লৌকিক দেবদেবী কিংবা মন্দিরের প্রাচুর্য ও কিছু কম নয়। আর এসবের সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। তাই হুগলীর কথা উঠলেই উৎসবের কথা ই মনে আসে,
আসলে এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের চর্চা হয়ে যায়।
বিশেষ ধন্যবাদ -
সুদেষ্ণা মুখার্জ্জী
ড. স্বপন ঠাকুর
সুব্রত মন্ডল
শুভঙ্কর সিংহ ।
তথ্য সূত্র -
হুগলী জেলা ও বঙ্গ সমাজ ( সুধীর চক্রবর্তী)
হুগলী দর্শন - ( ফেসবুক পেজ)
সংবাদ প্রতিদিন
বর্তমান পত্রিকা।
উনিশ শতকের সংবাদ পত্র
( স্পন্দন মুখার্জী)
No comments:
Post a Comment