Friday, 16 February 2024

বহরানের রাজনন্দিনী

                                      বহরানের রাজনন্দিনী

                                                 ( সিংহ ভিলার সরস্বতী )

                                                                                সুমন্ত বড়াল



Amazon prime এর পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজ টা মনে আছে,  যেখানে গ্রামের অধিবাসী রা নতুন গ্রামে আসা পঞ্চায়েত সচিব কে বারবার বলছেন, গ্রামের জলের ট্যাঙ্কের উপর থেকে গ্রাম টাকে দেখুন গ্রামের প্রেমে পরে যাবেন। আর এই গ্রাম সম্পর্কে বলি আপনি ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন এ পা রাখুন আপনার ভালো লাগবে আর গ্রামে পা দিলেই গ্রাম টার প্রেমে পরে যাবেন। মুর্শিবাদ জেলার সীমানা ঘেঁষা পূর্ব বর্ধমান জেলার ছোট্ট গ্রাম বহরান। যার একদিকে উদ্ধারণ পুরের ঘাট আর একপাশে শ্রীপাট ঝামটপুর। দুই এর মাঝে ছোট্ট গ্রাম বহরান। অতীতের বহিরান আজকের বহড়ান। এ গ্রামে রাজা আছেন আছেন গ্রামের বাবু রা। তবে রাজত্ব বা বাবুয়ানি নেই কিন্তু তাঁরা আছেন যেমন রয়ে গেছে হাটতলা বড় কালী তলা।

সুপরিচিত গবেষক শ্রী স্বপন ঠাকুর, ওনার গবেষণা লব্ধ মতানুসারে এই গ্রামেই শুরু হয় বর্ধমান জেলার দ্বিতীয় বারোয়ারী পুজো। দ্বিশতাব্দী প্রাচীন সে পুজো ছিল সরস্বতী পুজো। কিন্তু কালক্রমে সেই পুজো পরিবর্তন হয়ে আজ পূজিত হন এই গ্রামের দেবী জয় দূর্গা। দেবী সরস্বতী জয় দূর্গা তে রূপান্তরিত হয়েছে বটে কিন্তু আজও এই গ্রামে পুজিত হন এক শতাব্দি প্রাচীন দেবী সরস্বতী।



বহরান গ্রামের সুপরিচিত বর্ধিষ্ণু পরিবার সিংহ পরিবার । শ্রী বিকাশ চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের " সিংহ ভিলা " র সরস্বতী পুজো। যার মূল  বয়স প্রায় শতাব্দী পেরিয়েছে। যে পুজো সিনহা বাড়ি তে হয় বটে কিন্তু যে পুজো নিয়ে মেতে ওঠে গোটা বহরান গ্রাম।   এই সিংহ পরিবারের আদি নিবাস ছিল মুর্শিবাদ জেলার কাঁন্দি তে । কাঁন্দি তেই শুরু হয় দেবীর আরাধনা,  কালক্রমে এই পরিবার বহরানে চলে এলে এই বিগত পনেরো বছর যাবত সাড়ম্বরে এই গ্রামেই হয় সরস্বতী আরাধনা। সিংহ ভিলার ভিতরে রয়েছে দেবীর মন্দির। সারা বছর সেখানে দেবীর কাঠামো পূজিত হয়। আর এই কাঠামো তেই প্রত্যেক বছর তৈরী হয় মাতৃ মূর্তি। আর এই মূর্তি নির্মানেই রয়েছে এক বিচিত্র ব্যাপার। সিংহ বাড়ির পুজোতে যিনি পৈরহিত্য করেন তিনিই এই বাড়ির দেবী মূর্তি নির্মাণ করেন। যিনি মূর্তি গড়েন তিনি ই প্রাণ প্রতিষ্টা করেন এমন দৃষ্টান্ত সত্যি বিরল।  শিল্পী পুরোহিত রামব্রম্ভ ভট্টাচার্য্য যিনি এই গ্রামে ঝুলন ভট্টাচার্য্য নামে বিশেষ পরিচিত। তার কথায় সিং হ পরিবারের পুজো যতটা নিষ্ঠা ও আচার রীতি মেনে পালিত হয় তাদের মূর্তি নির্মাণ ও নিষ্ঠা ও রীতি মেনে। স্নান করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে শুরু হয় মূর্তি নির্মান। তবে মূর্তি টি বৈচিত্র কিছু না থাকলেও দেবীর সাজ সজ্জা ও পুজোর আয়োজন সত্যি নজর কাড়া। এই বাড়ির কর্তি শ্রীমতি ছন্দা সিংহ এর কথায় মা সরস্বতী যেন দেবী নয় সে এ ঘরের মেয়ে।  দেব মাহাত্ম্য আর স্নেহ বাৎসল্য মিলেমিশে একাকার এই বাড়ির পুজোতে।



সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে এমন আয়োজন সত্যি নজর কারে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই সিং হ পরিবারের একটি প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির ও রয়েছে যে মন্দিরে নিত্য সেবা দেওয়া হয়। এই পরিবারের নারায়ণ শিলা রয়েছে, পুজো শুরু আগে সানাই বাদ্য সহকারে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে শিব মন্দির থেকে নারায়ণ শিলা আনা হয় "সিংহ ভিলা " র মন্দিরে। নারায়ণ পুজো আর পুরোহিত বরণের পর শুরু হয় মূল পুজো। আর যে পুজোর শুরুর সাথে সাথে গ্রাম বাসি দের আনাগোনা চোখে পরে। সরস্বতী পুজো মানেই পুষ্পাঞ্জলী। সিংহ বাড়ি র পুজো তে এই পর্ব চলে দীর্ঘক্ষণ । কারণ তখন এই পুজো গ্রামের সর্বজনের। এই পরিবারের নব প্রজন্মের প্রতিনিধি শুভঙ্কর। শুভঙ্কর পড়াশোনার সূত্রে বাইরে থাকে কম্পিটার এর বিষয় নিয়ে পাঠরত শুভঙ্করের বন্ধুরা ভিডিও কলেও এই বাড়ির পুজোতে পুষ্পাঞ্জলী দিতে দেখা যায়। এই পুজোর এমন মাহাত্ম্য। ফুল মালা ধুপ ধুনা র গন্ধে যখন ভরপুর সিনহা বাড়ির উঠোন। তখন উনানে আচ গনগনে ভোগের আয়োজন তার চরম পর্যায়ে। যদির সূচনা হয় আগের রাতেই। রাত থেকেই চলে সবজীর কাটাকুটি। মিষ্টির ভিয়ানে তৈরী হয় রসালো বোঁদে। 




সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই উঠান জুড়ে মানুষের ঢল। চেয়ার টেবিলে বসে ভোগ খাওয়া। সিং হ বাড়ির আতিথিয়তা এই বিষয়ে দেখার মত। এই বাড়ির কণিষ্ঠ সদস্য সারমেয় বাঘা সেও অতিথি পরায়ণ। দুপুর গড়িয়ে বিকাল মানুষে মানুষে ছয়লাপ উঠান। ভোগ পেয়ে সবাই খুশি সন্ধ্যে নামে বেজে ওঠে সাঝের সানাই। আরতির প্রদীপে আর রঙিন আলোয় সেজে ওঠে সিংহ ভিলা । 




পরদিন দধিকর্মা শেষে সন্ধ্যের শোভাযাত্রা তোড়জোড়। সন্ধ্যে হলেই সারা গ্রাম প্রদক্ষিণের পর স্থানীয় দীঘিতে বিসর্জন। সিংহ পরিবার সহ পুরো গ্রাম বিদায় জানায় দেবী কে আর অপেক্ষা শুরু হয় তাদের আদরের " বহরানের রাজনন্দিনীর " জন্য ...



1 comment:

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...