ইটাচুনার
ঘুমন্ত শিব: হুগলির এক
অলৌকিক নিদর্শন
হুগলি
জেলা যদি শৈবতীর্থ হিসেবে
চিহ্নিত হয়, তা অত্যুক্তি
হবে না। এই জেলার
বুকে অধিষ্ঠিত স্বয়ং তারকেশ্বরের তারকনাথ, ভদ্রেশ্বরের শিব, মহানাদের জটেশ্বর,
স্বয়ম্ভু বেনিমাধব বা ঘণ্টেশ্বর—সবই মিলিয়ে শিব
আর ভক্তির নিবিড় যোগ। শ্রাবণ এলেই
এই সব মন্দিরে জনস্রোত
নামে, চারদিকে ধ্বনিত হয় “হর হর
মহাদেব”।
কিন্তু
এই ভক্তির জোয়ারেও হুগলি জেলার একটি মন্দিরে শিবপূজা
হয় না। মন্দির আছে,
শিব আছেন, অর্থ আছে, লোকবলও
আছে—তবু তিনি যেন
ঘুমিয়ে রয়েছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। ইটাচুনার
এই "ঘুমন্ত শিব" এক অলৌকিক কাহিনির
কেন্দ্রবিন্দু।
ইটাচুনা
রাজবাড়ির বিপরীতে, রাস্তাটির ওপারে, রয়েছে এই অনন্য শিবমূর্তি।
সময়টা ১৮৭১ সাল। ব্রিটিশ
সরকারের পক্ষ থেকে গিরিডি
অঞ্চলে রেললাইন বসাবার দায়িত্ব পান কুণ্ডু পরিবারের
কর্তা বিজয় নারায়ণ কুণ্ডু।
কাজের সূত্রে তিনি গিরিডির এক
গভীর জঙ্গলে গিয়ে খুঁজে পান
এক আশ্চর্য শিবমূর্তি। মূর্তিটি যেন দাওয়ায় বসে
থাকা একজন গম্ভীর, ত্যাগী
সাধক—যিনি দেবাদিদেব মহাদেব
ছাড়া আর কেউ নন।
তিনি
মূর্তিটি হুগলি জেলার মহানাদে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন, এবং
রাজবাড়ির বিপরীতে এক চমৎকার মন্দির
নির্মাণ করেন। কিন্তু মূর্তির স্থাপনের পরপরই ঘটে অঘটন—পরিবারের এক সদস্য মৃত্যুবরণ
করেন। তখনও শাস্ত্রীয় মতে
মূর্তির মন্ত্রপূত প্রতিষ্ঠা হয়নি। এরপর যতবারই মন্ত্রপাঠ
করে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, ততবারই
নানা রকম বাধা এসেছে—হঠাৎ
মৃত্যু, দুর্ঘটনা, রোগ-ব্যাধি।
শেষমেশ,
পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়—আর কোনোদিন এই
মূর্তির প্রতিষ্ঠা হবে না। সম্ভবত
এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। সেই ধারাবাহিকতা আজও
চলছে। আজও শ্বেতপাথরের মহাদেব
বসে আছেন মন্দিরে—কিন্তু পূজা পান না।
অনেকে
বলেন, শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গা বা
কালী ছাড়া মূর্তিমান শিবের
পূজা হয় না, বিশেষ
করে এমন বসা ভঙ্গিমার।
শুধুমাত্র শিবলিঙ্গই পূজার যোগ্য। হয়তো এই কারণেই
এই মহেশ্বর আর কোনোদিন পূজিত
হননি।
তবে
মন্দির ও মূর্তির পরিচর্যা
হয় খুব যত্নে। নিয়ম
করে পরিষ্কার করা হয় তাঁর
চারপাশ, ধুপ-ধুনো জ্বালানো
হয়, কিন্তু পূজার নিয়ম মানা হয়
না। তিনি রয়ে গেছেন
‘অপূজ্য’ হয়েও
লোকবিশ্বাসের শীর্ষে।
শ্বেতপাথরের
চার ফুট উচ্চতার এই
মহাদেব সত্যিই আশ্চর্য। মাথার জটা সুশোভিত চূড়ায়
রূপান্তরিত, গলায় উপবিত, কাঁধে
ফনা তুলে থাকা শ্বেত
সর্প, কোমরে ব্যাঘ্রচর্ম, বাম পা মাটিতে
এবং ডান পা হাঁটু
মুড়ে ওপরে তোলা—হাঁটুর উপর হাত রেখে
অসীম বেদনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে।
যেন অমোঘ আকুলতা—পুজো পাওয়ার, স্বীকৃতি
পাওয়ার, জাগ্রত হওয়ার।
লোকবিশ্বাস
বলে—রাত গভীর হলে
সেই মন্দিরে “তেনারা” উপস্থিত হন। কেউ কেউ
বলেন, অমাবস্যার রাতে ঝড়ো হাওয়ার
মতো শব্দ, ঘণ্টার ধ্বনি, অদ্ভুত আলো-ছায়া দেখা
যায় সেখানে। যেন অলক্ষ্যে শুরু
হয় এক গোপন পূজা—নির্জনতার
মধ্যে জেগে ওঠে ত্রিনয়ন।
এইভাবেই
ইটাচুনার এই ঘুমন্ত শিব
হয়ে উঠেছেন হুগলির এক অনন্য দেবতা।
তিনি পূজিত না হলেও পূর্ণ,
জাগ্রত না হয়েও জাগ্রত।
তাঁকে ঘিরে রয়েছে ভয়,
ভক্তি ও বিস্ময়ের এক
অভিন্ন আখ্যান।


No comments:
Post a Comment