“বিষহরি থেকে পদ্মাবতী: মা জগৎগৌরীর লোককথা”
মনসা বাংলার লোকবিশ্বাসের আদি দেবী। পদ্মপুরাণে তাঁর জন্মকথা বর্ণিত হয়েছে—শিবকন্যা, ব্রহ্মা যাঁর নাম রাখেন ‘বিষমুখ’। অনেকে তাঁকে বলেন ‘বিষহরি’, কারণ তিনি বিষকে প্রশমিত করেন। আবার জগতের মঙ্গলসাধনের জন্য তাঁর আরেক নাম হয় ‘জগৎগৌরী’। পদ্মপত্রে জন্ম নেওয়ায় তিনি ‘পদ্মাবতী’, আর নাগলোকে পূজিতা হন ‘মনসা’ নামে। বাংলার লোকজ বিশ্বাসে এই দেবী কখনো সর্পদেবী, কখনো দুর্গারই আরেক রূপ। তাই লোকমুখে প্রচলিত—
“মনসার পূজা যার ঘরে, তার সর্বসুখ ভরে ঘরে।”
রাঢ় বাংলার পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কালনা দু-নম্বর ব্লকের বৈদ্যপুর একটি প্রাচীন জনপদ, যার চারপাশ ছড়িয়ে আছে অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর মন্দির। বৈদ্যপুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত নারকেলডাঙ্গা গ্রামটির উল্লেখ মেলে মনসা-মঙ্গল কাব্যে। এই গ্রামেই আজও পূজিতা হন মা জগৎগৌরী। লাল রঙের মন্দিরটির চূড়া তার গায়ে আঁকা রয়েছে সাপের প্রতীক। শীর্ষে শোভা পাচ্ছে ত্রিশূল ও ‘ওঁ’। মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলে ডানদিকে দক্ষিণমুখী মায়ের গর্ভগৃহ। সামনে ছয়টি থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে টিন-ছাওয়া আটচালা, যার শেষে বলির হাঁড়িকাঠ। দক্ষিণ দিকে রয়েছে ভোগ রান্নার ঘর এবং পশ্চিমে বিশ্রামাগার। সব মিলিয়ে এটি এক ঐতিহাসিক পূজাঙ্গন।
নারকেলডাঙ্গার মা জগৎগৌরীর পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি বিশেষ ইতিহাস। বৈদ্যপুরের জমিদার নন্দী বংশের মেজ তরফের এক বাল্যবিধবা এক রাতে স্বপ্নে দেবীকে দেখেন কচুবনে। স্বপ্নবাস্তবের মিলনে সেখান থেকে আনা হয় দেবীমূর্তি, শুরু হয় পূজা দুর্গামণ্ডপে। পরে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় স্থানীয় তান্ত্রিক শ্রী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তিনিই ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান মন্দির নির্মাণ করেন। আজও তাঁর বংশধরেরাই নিয়মিত পূজা করে আসছেন। ফাল্গুন মাস থেকে শ্রাবণ পর্যন্ত গ্রামমঙ্গলের জন্য দেবীকে গ্রামভ্রমণে বের করা হয়।
মন্দির থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত ঝাঁপান তলা, যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে নারকেলডাঙ্গার সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রতিবছর জৈষ্ঠ্য মাসের কৃষ্ণা পঞ্চমীতে এবং আষাঢ় মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে দেবীর বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ও এই পূজায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। উৎসবটির নাম ঝাঁপান উৎসব। ‘ঝাঁপান’ শব্দের অর্থ ডুলি—দেবীকে ডুলিতে বসিয়ে শোভাযাত্রায় গ্রাম ঘোরানো হয় বলেই এই নামকরণ। উৎসব উপলক্ষে ঝাঁপান তলায় বসে বিরাট মেলা, যার রঙিন আবহে মুখরিত হয় গোটা গ্রাম।
ঝাঁপান উৎসব চলে টানা তিন দিন। প্রথম দিন রাজবেশ ও অধিবাসের অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় দিন ভোরে দেবীকে কচুদহের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়, রাতে ফিরিয়ে আনা হয়। সারাদিন ভক্তদের ঢল নামে, চলে পূজা-পাঠ, অর্ঘ্য নিবেদন। মনস্কামনা পূরণের আশায় বহু ভক্ত ছাগবলি দেন, একসঙ্গে বহু বলির প্রচলনও দেখা যায়। এদিন রাস্তায় বের হয় নাচ-ঘর—গরুর গাড়িতে সাজানো মঞ্চে নাচগান, নাটক, সামাজিক ব্যঙ্গ কিংবা পৌরাণিক কাহিনি মিশে যায় একসঙ্গে।
উৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘থাকা’। বাঁশ ও কঞ্চি দিয়ে সিঁড়ির মতো কাঠামো বানিয়ে সাজানো হয় পৌরাণিক দৃশ্য। রঙিন পুতুল, গান-বাজনা ও নাচের সঙ্গে প্রতিটি পাড়া থেকে আলাদা ‘থাকা’ ঝাঁপান তলায় এসে জমা হয়। দুপুরে সারিবদ্ধভাবে সেগুলো সাজানো হয়, আর সাধারণ মানুষের রায়েই ঠিক হয় কোন ‘থাকা’ সবচেয়ে সুন্দর। গ্রামবাংলার লোকশিল্প ও সামষ্টিক সৃজনশীলতার এক অভিনব প্রকাশ এই অনুষ্ঠান। মনসা-মঙ্গলের ছন্দও এই আনন্দের আভাস দেয়—
“মনসা দেবী ভাসে গ্রামে, ডুলি ঘিরে বাজে বাঁশি,
ভক্তের সনে মাগো তুই, করিস সংসারবাসি।”
তৃতীয় দিনে পাল্টা পূজার মাধ্যমে মেলার পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে এই উৎসবের রেশ থেকে যায় দীর্ঘদিন। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবীর আশীর্বাদে গ্রাম অকল্যাণ থেকে রক্ষা পায়, ফসল হয় সোনালি, সংসারে শান্তি ও মঙ্গল বিরাজ করে।
নারকেলডাঙ্গার মা জগৎগৌরীর পূজা তাই শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং গ্রামীণ ঐতিহ্য, লোকবিশ্বাস ও সামষ্টিক আনন্দের এক অনন্য উৎসব। এটি প্রমাণ করে, বাংলার মাটিতে দেবী-আরাধনা শুধু মন্দিরের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে মিশে আছে। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পূজা কেবল ভক্তির নয়, বরং বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল হয়ে আছে।
No comments:
Post a Comment