Sunday, 16 November 2025

বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক ইতিহাস, লোকবিশ্বাস ও রূপবৈচিত্র্যের এক অনন্ত উৎসব

 

বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক ইতিহাস, লোকবিশ্বাস ও রূপবৈচিত্র্যের এক অনন্ত উৎসব




'কুন্ডু কাঁসারি উদেরে
তিন নিয়ে বাঁশেবেড়ে।'

হুগলি জেলার প্রাচীন জনপদ বাঁশবেড়িয়াকে ঘিরে এই লোকপ্রবাদটি আজও শোনা যায়। বিস্ময়ের বিষয়, প্রবাদে উল্লিখিত শঙ্খবণিক, কংসবণিক বা কাঁসারি, গন্ধবণিক, তিলি—এই সব বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ আজও এই মফস্বল শহরেই বসবাস করেন। ইতিহাসখ্যাত সপ্তগ্রাম বন্দরের সাত গ্রামের মধ্যে অন্যতম ছিল এই বাঁশবেড়িয়া—যাকে অতীতে বলা হত বংশবাটি। হুগলি নদীর ধার ঘেঁষে থাকা এই জনপদ শুধু ইতিহাস নয়, ধর্মীয় ও লোকবিশ্বাসের দিক থেকেও সমৃদ্ধ। এখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত হংসেশ্বরী মন্দির; আর এখানকার কার্তিক পুজো তো বহু শতাব্দীর গর্ব।

বাঁশবেড়িয়ার ধর্মজীবনে দেবসেনাপতি কার্তিকের আরাধনা প্রায় পাঁচ শতক পুরনো। শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত—যেখানে তাকানো যায়, দেখা মেলে নানা রঙের, নানা বেশের, নানা নামের কার্তিক। কোথাও তিনি রাজা, কোথাও জামাই; কোথাও ধুমো বাবা, কোথাও জ্যাংড়া। কার্তিক সংক্রান্তির দিন এই জনপদ উৎসবের আলোয় গুঞ্জরিত হয়। কার্তিকের রূপবৈচিত্র্যই যেন এখানে এক প্রাচীন লোকনাট্যের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস, পুরাণ, লোককথা, ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা—সব মিলিয়ে বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক পুজো সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে আজও অটুট।

সপ্তগ্রাম—যেখানে শুরু হয়েছিল গল্প

কার্তিক পুজোর ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় মধ্যযুগের বঙ্গদেশে। তখন বাংলার সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও ছিল দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রধান বন্দর। শুধু বন্দরই নয়—সেই যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরীও ছিল এটি। সাতটি জনপদ—বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বচোরা ও বলদঘাটি—এই সাত গ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সপ্তগ্রামের ঐশ্বর্য। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ষোড়শ বণিকের যে উল্লেখ পাওয়া যায়—জয়পতি, সোমশ্রীধর, শূলপাণি, মেঘ, রাজারাম, শ্রীপতি, কমলাকান্ত, গুণাকর, গণেশ্বর, বাণেশ্বর, হরিহর, হিরণ্য, দিবাকর, পুরন্দর, মহানন্দ—তাঁরা সকলেই সপ্তগ্রামের বণিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি।

এ থেকেই সহজেই অনুমান করা যায়, মধ্যযুগে সপ্তগ্রাম তথা বাঁশবেড়িয়ায় এক অভিজাত বণিকশ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল। বণিক সম্প্রদায়ের সেই ঐতিহাসিক প্রভাবেই বাঁশবেড়িয়ায় কার্তিক পুজোর সূচনা। "সুবর্ণ বণিক" পত্রিকায় উল্লেখ রয়েছে—প্রায় ১৬০০ সন থেকে ব্যবসায়ী ও মহাজনবর্গের উদ্যোগে এখানে কার্তিক পুজোর প্রচলন শুরু হয়।

বণিকেরা কেন পূজলেন কার্তিক দেবসেনাপতি?

এই প্রশ্ন বহুদিন ধরেই গবেষকদের ভাবিয়েছে। সুধীর কুমার মিত্র লিখেছেন—কার্তিক পূজার দুটি মূল দিক রয়েছে। প্রথমত, দেবসেনাপতি সাহসের প্রতীক—তাঁর উপাসনায় সাহস, বল ও রক্ষার আকাঙ্ক্ষা নিহিত। দ্বিতীয়ত, ‘ফার্টিলিটি’ বা প্রজননের আশীর্বাদলাভের উদ্দেশ্যে এই পূজা বাংলায় প্রচলিত হয়। চুঁচুড়ায় ওলন্দাজদের কার্তিকপূজা-প্রীতি এই প্রেক্ষাপটকে আরও সমর্থন করে। চুঁচুড়ার প্রতিবেশী বাঁশবেড়িয়ায় ব্যবসায়ী ও মহাজনদের মধ্যে বহু নিঃসন্তান পরিবার ছিল—অতএব উত্তরসূরীর আশায় তাঁরা দেবসেনাপতির আরাধনায় ব্রতী হন।

সপ্তগ্রাম বন্দর আজ ডুবে গেছে সময়ের নদীতে, কিন্তু বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক পুজো টিকে আছে। বরং আজ তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন, আড়ম্বরময় এবং লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রদর্শনী।

বাংলায় কার্তিক—লৌকিক দেবতার পথচলা

কার্তিক দক্ষিণ ভারতের মুরুগান; তাঁর স্ত্রী দেবসেনা—যিনি দেবী ষষ্ঠীর রূপ। ষষ্ঠী প্রজনন ও শিশু রক্ষার দেবী; তাই কার্তিকও প্রজনন ও সুরক্ষার দেবতা। পুরাণে কার্তিকেয়, স্কন্দ, শাখনৈগমেয়, মহাসেন—অসংখ্য নামে পরিচিত তিনি। শত্রুজয়ের দেবতা, যোদ্ধাদের ইষ্ট, শস্যদেবতা, আবার কোথাও কামুক, কোথাও যোগী। বৌধায়ন ধর্মসূত্র, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, নারায়ণ উপনিষদ, পতঞ্জলির মহাভাষ্যে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। বিষ্ণুধর্মোত্তরে তিনি ষড়ানন, লাল বস্ত্রে সজ্জিত, ময়ূরবাহনে উপবিষ্ট। কোথাও কোথাও কুক্কুট বা মোরগও তাঁর বাহন।

এই অনন্ত রূপই বাঁশবেড়িয়ার কার্তিকে নানা নামে, নানা ভঙ্গিমায় ধরা পড়ে।

 


আদি বাবা ধুমো কার্তিক—বাঁশবেড়িয়ার প্রাচীন দেব

সাহাগঞ্জ অঞ্চলের আদি বাবা বা ধুমো কার্তিক—এই জনপদের সবচেয়ে প্রাচীন ও ব্যতিক্রমী দেবরূপ।
প্রায় ১৮–২০ ফুট উচ্চতার এই মূর্তি কালীঘাটের পটচিত্রের কার্তিকের মতোই রূপায়িত। গায়ের রং হলুদ, মুখে বয়স্ক পুরুষের মতো গোফ, কাঁধে চাদর, লুঙ্গি বা ধুতি—রূপটি যেন পরিবারের প্রবীণ কর্তার। ‘ধুমো’ শব্দটি অভিধানে না থাকলেও ‘ধুম্ব মিনসে’—বড়দেহী, বয়স্ক পুরুষ—এই আঞ্চলিক উচ্চারণ মূর্তির রূপকেই স্মরণ করায়।

আদিবাবার দুই পাশে থাকেন দুই ‘সিপাহী’—মাটির দুই প্রহরী। পুলিশের মতো পোশাক, হাতে লাঠি—যেন দেবতার নিরাপত্তারক্ষী। প্রচলিত মতে, সাহাগঞ্জের নন্দীবাড়ি এই পুজোর প্রথম উদ্যোক্তা। আজ তা বারোয়ারি পুজোয় পরিণত হয়েছে, কিন্তু প্রাচীনতার গাম্ভীর্য এখনও অটুট।

 

জ্যাংড়া কার্তিক—যোদ্ধা দেবতার রণরূপ

বাঁশবেড়িয়ার সাহাগঞ্জ অঞ্চলের জ্যাংড়া কার্তিক আরও এক অনন্য অধ্যায়। ‘যৌধেয়’ জনজাতির সঙ্গে এই নাম ও রূপের যোগ রয়েছে—উত্তর ভারতের এই জনজাতি যুদ্ধশক্তির জন্য বিখ্যাত ছিল এবং তাঁদের আরাধ্য দেবতা ছিলেন রণসজ্জিত দেবসেনাপতি।

জ্যাংড়া কার্তিকের মূর্তি সত্যিই সেই রণগৌরবকে বহন করে—রাজকীয় পোশাক, বিশাল তীর-ধনুক, বিস্ফোরিত নয়ন, মোটা গোফ, ক্ষত্রিয়ের ঔজ্জ্বল্য। গায়ের রঙ হলুদ, বাহনে ময়ূর—কিন্তু তাঁর পদক্ষেপ অশ্বারোহীর ভঙ্গিমায়। অভিধান বলে—‘জাঙ্গড়া’ মানে অশ্বারোহী; তাই নামকরণ একেবারেই স্বাভাবিক।

দুই পাশে দাঁড়ানো থাকে খয়েরি রঙের দুটি দেহাতি আকৃতির মূর্তি—যেন জনজাতির প্রতিনিধি যোদ্ধারা।

প্রায় ২৯১ বছর ধরে সাহাগঞ্জের ধর্মরাজতলায় এই পুজো হয়ে আসছে। প্রসাদ হিসেবে থাকে জিলিপি; এমনকি ময়ূরের মুখেও থাকে বিশাল জিলিপি! তাই স্থানীয়দের কাছে তিনি ‘জিলিপি কার্তিক’ নামেও খ্যাত।



রাজা কার্তিক—ওলন্দাজ পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা রাজসিক দেবরূপ

বাঁশবেড়িয়া-সাহাগঞ্জ অঞ্চলে বহু রাজা কার্তিক থাকলেও সবচেয়ে ঐতিহাসিক হলো নতুন পোস্ট অফিস এলাকার কার্তিক। প্রায় ৩৭৮ বছরের ঐতিহ্য। একসময় এই অঞ্চল ছিল ওলন্দাজ উপনিবেশ; তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬৪৬ সালে এই পুজোর সূচনা।

এই মূর্তি রাজসিকতার প্রতিমূর্তি—সিংহাসনে উপবিষ্ট, মাথায় স্বর্ণমুকুট, কণ্ঠে অলংকার, সামনে একজোড়া ময়ূর যাদের ডানা দেবতার প্রভামণ্ডল গঠন করেছে। পাশে দণ্ডায়মান সখীরা চামর দোলাচ্ছেন। মুখের সুদৃশ্য গোফ বাংলার জমিদারদের স্মরণ করায়। কেউ কেউ তাঁকে মহারাজ নন্দকুমার বা রাজা রামমোহনের প্রতিমূর্তি বলেও ভাবেন।

স্থানীয়দের চেষ্টায় তাঁর জৌলুস বছরে বছরে বেড়েছে—এমনকি তাঁর নামে দেবোত্তর জমিও রয়েছে।

 


জামাই কার্তিক—বাঁশবেড়িয়ার নিজস্ব লোককল্পনা

রাজা কার্তিকের পাশাপাশি বাঁশবেড়িয়ার বিখ্যাত আরেক রূপ—জামাই কার্তিক। বিশেষত রথতলা ও জামাইগলির পুজো উল্লেখযোগ্য। প্রায় পঞ্চাশ বছরের নবীন পুজো হলেও সাজসজ্জার অভিনবত্বে এর জনপ্রিয়তা বিপুল।

এখানে কার্তিক সিংহাসনে বা ময়ূরবাহনে নন—ফুলসজ্জার খাটে বসে। হাতে গোলাপ। খাট সাজানো রজনীগন্ধার শয্যার মতো। ময়ূর কখনও খাটে, কখনও নীচে। রূপের এই ঘরোয়া কোমলতা তাঁকে বাকিদের থেকে আলাদা করে।

 

সিপাহী কার্তিক—হংসেশ্বরী মোড়ের প্রাচীন প্রতিচ্ছবি

হংসেশ্বরী মোড়ের সিপাহী কার্তিক প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো। আদিবাবার সঙ্গে রূপগত মিল থাকলেও এখানে উচ্চতা কিছু কম। ময়ূরের মুখে বিশাল জিলিপি—এটাই এই পুজোর বিশেষত্ব।

ষড়ানন, অর্জুন ও অন্যান্য রূপ—বাঁশবেড়িয়ার অনন্ত বৈচিত্র্য

ধোপাঘাট, সাহাগঞ্জের কেওটা অঞ্চলে অর্জুন কার্তিক, খামারপাড়ার কুণ্ডুগলর ষড়ানন কার্তিক—সব মিলে বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক উৎসব এক বিশাল লোকশিল্পের মাঠ।

কার্তিক সংক্রান্তি থেকে চার দিন ধরে শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে দেবসেনাপতির ভিন্ন ভিন্ন রূপে আরাধনা চলে। প্যান্ডেল, আলোকসজ্জা, প্রতিমা—সবই অসাধারণ। শুধু কার্তিক নন—এই সময়ে বহু বারোয়ারিতে শিব, পার্বতী, নারায়ণ, তারা, সন্তোষী মা, কমলা মাতা, অর্ধনারীশ্বর, সতীর দেহদান, এমনকি ভারত মাতা বা দশানন—বহু ব্যতিক্রমী প্রতিমার উপাসনা হয়।

বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক উৎসব তাই শুধু পুজো নয়—এক বিশাল সামষ্টিক লোকজ-ঐতিহ্যের নাট্যমঞ্চ।

শেষ কথা

বিসর্জনের শোভাযাত্রা যেমন চোখ ধাঁধায়, তেমনি মনও ভরে ওঠে এই ভাবনায়—দেবসেনাপতি হিসেবে যিনি মূলত দক্ষিণ ভারতের দেবতা, তিনি বাঙালির ঘরে এমন কত রূপে পূজিত! হয়তো বাঙালি যোদ্ধা নয়—‘দুধে-ভাতে’ থাকা তার সহজ স্বভাব। তাই কার্তিক এখানে কখনও রাজা, কখনও বাবু, কখনও জামাই—লোকজ কল্পনা, ইতিহাস আর বণিকদের স্মৃতি মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য দেবজগৎ।

হুগলির এই প্রাচীন জনপদ বাঁশবেড়িয়া তাই শুধু ইতিহাস নয়—লোকধর্ম, উৎসব, রূপকল্প আর মানুষের চিরন্তন আশা-অভিলাষের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। কার্তিকের নানা রূপ সেই গল্পই যেন বারবার ফিরে ফিরে শোনায়।

 

No comments:

Post a Comment

তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি

                            তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো...