Wednesday, 19 November 2025

কার্তিকের লড়াই-শহর কাটোয়া : লোকবিশ্বাসের গোপন সরণি

কার্তিকের লড়াই-শহর কাটোয়া : লোকবিশ্বাসের গোপন সরণি

                                                                                                                               



 কাটোয়া শহরটার প্রতি একটা আলগা টান বহুদিনের। তার কারণ অবশ্যই শুভঙ্কর—এই শহরের রাস্তাঘাট নিয়ে যার অসীম গর্ব, আর স্বপন স্যার—যার কথায় ইতিহাস যেন বইয়ের পাতা ছেড়ে মানুষের মুখে নেমে আসে। কাটোয়া মানেই আমার মনে এই দু’জন মানুষ। কতবার যে ওদের মুখে শুনেছি কাটোয়ার কার্তিকের গল্প, হিসেব নেই। চুচড়ায় লড়াই কার্তিকের নিদর্শন মিললেও কার্তিকের লড়াই যে শুধু কাটোয়াতেই, তা তাদের মুখে শোনাই যেন বিশ্বাসের সীলমোহর। এত জায়গায় যাই, এত কিছু দেখি—আর এটা দেখব না! শেষমেশ ইচ্ছে প্রকাশ করলাম সুদেষ্ণার কাছে। সারাদিন আমার মুখে কার্তিক-কার্তিক শুনে তার রাজি না হয়ে উপায় কোথায়!

অগ্রহায়ণের প্রথম দিন। ভোরের কুয়াশা তখনও রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। ঘুমঘুম অন্ধকারে চায়ের দোকানের প্রথম ধোঁয়া উঠছে, দূরে রেলের লাইন ধরে শব্দ কাঁপছে। আমরা বেরিয়ে পড়েছি—আজ লড়াই দেখব। সেই বহু কালের শোনা ‘কার্তিক লড়াই’-এর সঙ্গে দেখা হবে অবশেষে। মনে যেন পুজোর চেয়ে কম উত্তেজনা নেই।

দেবসেনাপতি কার্তিকের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক আশ্চর্য প্রতিমা—সুঠাম শরীর, বাবরি চুল, সরু গোঁফ, দুধে-আলতা মেশানো দীপ্তিময় গাত্রবর্ণ। তাঁর হাতে যুদ্ধাস্ত্র তীর-ধনুক, যেন উন্মুখ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছেন এক বীর যোদ্ধা। অথচ আশ্চর্য—ঋগ্বেদে এই দেবতার নামই নেই! অথর্ববেদে পাওয়া যায় ‘কুমার’ নামে এক অগ্নিদেবতার উল্লেখ, যিনি বৈদিক যুগের শেষ পর্বে ক্রমে শৈবসাধনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওঠেন। আর সেই যোগসূত্রেই কুমার পরিণত হন শিবপুত্র স্কন্দে—বিশাখে—অবশেষে আমাদের পরিচিত কার্তিকে।



মহাভারতে কার্তিকের আরও এক রূপ দেখা যায়। বলা হয়, ছয় ঋষিপত্নীকে তিনি মা বলে গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা কৃত্তিকা নামে পরিচিত। তাই তাঁর নাম হয় কার্তিক। গবেষকদের অনেকেই মনে করেন, কার্তিক মূলত লোকজ স্তর থেকে উঠে আসা দেবতা। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে তাঁকে বলা হয়েছে ‘ভয়ংকর লৌকিক দেবতা’। যুদ্ধদেবতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি বহুল পরিচিত, কিন্তু তাঁর নামের মূলেই আছে কৃষি-সংস্কৃতির আদল—সংস্কৃত ‘স্কন্ন’ শব্দ থেকে আসা স্কন্দ, যার অর্থ বীজ বা বীর্য, অর্থাৎ শক্তি, সাহস, উদ্যম। একসময়ে চোর-ডাকাতদের রক্ষাকর্তা হিসেবেও কার্তিকের পূজা হতো, যা তাঁর বহুবর্ণ চরিত্রকে আরও স্পষ্ট করে।

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে পুন্ড্রবর্ধন—আধুনিক উত্তরবঙ্গ—ঘরে ঘরে কার্তিকপুজোর প্রচলন ছিল বলে কহলনের রাজতরঙ্গিণী থেকে জানা যায়। বাংলার প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি মালদহেও এর গুরুত্ব ছিল প্রবল। সাহাবাড়ির চতুর্ভুজ বাঁকিবিহারিলালের কার্তিকপুজো তারই অন্যতম নিদর্শন। এই পরিবারের এক আকর্ষণীয় প্রথা হলো—পরিবারে প্রথম পুত্রসন্তান জন্মালে দেবপ্রতিমায় একটি অতিরিক্ত কার্তিক সংযোজন। যেন আনন্দের পরিমাণ প্রতিমাতেই লিপিবদ্ধ থাকে।

মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি ও বেলডাঙা, বাঁকুড়ার সোনামুখি, হুগলির বাঁশবেড়িয়া—এ সব অঞ্চলেও কার্তিকপুজো আজও উচ্ছ্বাসমুখর। বাঁশবেড়িয়া-ত্রিবেণীতে বহু গৃহস্থবাড়িতে পূজার দিন শিশু-রূপে কার্তিকের উপাসনা চলে। কার্তিক সেখানে দেবতার চেয়েও বেশি—সে পরিবারের ছেলে, ঘরের সন্তান।



তবে দক্ষিণবঙ্গে কার্তিকপুজোর যে রূপ সবচেয়ে আলাদা, সবচেয়ে নাটকীয়—তা কাটোয়াতেই। ‘কার্তিক লড়াই’ নামে তার পরিচিতি। লোকশ্রুতি বলে, এক সময় বারবিলাসিনীদের পুজো আর শহরের জমিদারদের পুজোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। ন্যাঙটো কার্তিকের উপাসনা থেকেই নাকি এই লড়াইয়ের উৎপত্তি। যদিও কাটোয়ার খ্রিস্টান মিশনারিদের লেখায় কিংবা নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাটোয়ার ইতিহাস-এ এ নিয়ে কোনও প্রাচীন তথ্য নেই। ক্ষেত্রসমীক্ষা ও লোকগবেষণা বরং নির্দেশ করে ভিন্ন উৎসের দিকে—কাটোয়ার ‘থাকা পুজো’র দিকে।

কাটোয়ার প্রাচীনতম জনপদগুলির মধ্যে অন্যতম তাঁতিপাড়া। এখানে আজও ধর্মরাজের থান, বর্গি হাঙ্গামার স্মৃতিবাহী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দির—আর সাতভাই রাজার ‘থাকা’ কার্তিক আছে। কাটোয়ার লোকসংস্কৃতিকে বুঝতে হলে ‘থাকা’ শব্দটির গভীরে ঢুকতেই হয়। কারণ এই ‘থাকা’—বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশাল ত্রিভুজাকৃতি এক কাঠামো—কার্তিকপুজোর প্রাণ।

সাধারণত বহু প্রতিমা এক সঙ্গে স্থাপন করতে হলে ‘চালি’ লাগে। দুর্গার একচালিমূর্তি তার উদাহরণ। কিন্তু যখন প্রতিমার সংখ্যা ত্রিশের কাছাকাছি হয়, তখন ছোট পরিসরে চালিতে ফিট করানো অসম্ভব। তখনই কাজে লাগে এই বিশেষ প্রযুক্তিতে নির্মিত বাঁশের ‘থাকা’—যা দেখতে অনেকটা সিঁড়ির মতো। উচ্চতা পনেরো থেকে কুড়ি ফুট, চওড়া মাত্র ছয়-সাত ফুট, কিন্তু স্তর ধরে ত্রিশেরও বেশি পুতুল এতে সহজেই সাজানো যায়।



আনুমানিক আঠারো শতকের দিকে থাকার উদ্ভব। প্রথম দিকে কাঠামো ছিল ছোট, পরে ধীরে ধীরে রূপান্তর ঘটে। যাত্রাশিল্পের প্রভাবও পড়ে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ মিলিয়ে বিশাল নাট্যবুনন তৈরি হয় এই বাঁশের গ্যালারিতে। বকাসুর বধ, সীতার বিবাহ, রামের বনবাস, কৃষ্ণের জন্ম, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ—সব ফুটে ওঠে মৃৎপুতুলের শরীরে। একজন কাঠামোশিল্পী, একজন পোশাকশিল্পী, একজন নির্দেশক মিলে তৈরি হয় থাকা মঞ্চ। আর সবার উপরে দেবী জগদ্ধাত্রী—কাত্যায়নী—কোলে শিশু কার্তিক। দু’পাশে নৃত্যরত সখীরা। নিচে ধাপে ধাপে সাজানো নাট্যকাহিনি।



এ এক অনন্য লোকপ্রযুক্তি, যা সারাবাংলায় একমাত্র কাটোয়া-দাঁইহাট অঞ্চলে টিকে আছে। তাঁতিপাড়ার সাতভাই কার্তিকের সাত পুতুলের বিন্যাসে তার আদিম রূপও দেখা যায়।

বিশ শতকের গোড়ায় জমিদার ও ব্যবসাদাররা এই থাকা কেন্দ্র করে পুজোয় প্রতিযোগিতা শুরু করেন। কার থাকার পোশাক ভালো, কার কাঠামো চমকপ্রদ, কার নাট্যরূপক বেশি দর্শক টানবে—এই নিয়ে শুরু হয় ‘লড়াই’। এবং ধীরে ধীরে তা শহরের উৎসবে পরিণত হয়। সন্ধ্যা নামলেই চার দিক আলোয় ভরে যেত। পাড়ার ছেলেদের দল দলে থাকা দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা এমন ছিল যে ফাল্গুনের দোলের মতো আলোড়ন শহরের গলিপথে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকা কমে এসেছে। বাঁশের কাঠামো তৈরির শ্রম কমে গেছে, শিল্পীদের অভাব, থিমের ক্রমবর্ধমান প্রভাব—সব মিলিয়ে নতুন যুগ কাটোয়ার কার্তিককে অন্য রূপে সাজিয়েছে। ফাইবার, আলো, সাউন্ড—এসব মিলিয়ে থিম আজ জনপ্রিয়। তবুও যে ক’টি থাকা এখনো টিকে আছে, তারা যেন পুরনো কাটোয়ার স্মৃতিস্তম্ভ—নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের বিজড়িত নিদর্শন।

সেদিন কাটোয়ার পথে যেতে-যেতে মনে হচ্ছিল, কত যুগের লোকবিশ্বাস, কত মানুষের অপেক্ষা, কত শিল্পীর ঘাম, মাটি আর বাঁশের স্পর্শ মিলেমিশে গড়ে উঠেছে এই লড়াই। ট্রেনের কেবিনে কুয়াশার ভেতর ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল শহরের আলো। মনে হচ্ছিল, কার্তিক যেন কোথাও থেকে হাত নেড়ে বলছেন—

“এসো, আজ লড়াই দেখবে তো?”

সু.ব ... 

No comments:

Post a Comment

তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি

                            তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো...