Thursday, 31 October 2024

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

 

          ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "



গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে গিয়ে তুলল সেই মোড়ের পথের ধারে বিশাল আকারে চরাচর ঝলমলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শ্যামা মা  । ভিড় এড়িয়ে বাইক টা দাড় করাতেই এই ছোট্ট জনপদ আমার মন জিতে নিলো যখন বছর চোদ্দর বাচ্চা টা আমার বাইকে লাগানো স্টিকার টা ছুঁয়ে আমায় বলল জয় মা কালী জয় মোহনবাগান বাগান ।

কিন্তু হঠাৎ এই জনপদে কেন । আর এই বিশাল আকার শ্যামা মূর্তি ? হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকের ছোট্ট জনপদ মন্ডলাই । পান্ডুয়ার দামোদর বাঁধ পেরিয়ে কালনা পাণ্ডুয়া রোড ধরে চারকিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ছোট্ট জনপদ । এমনি তে পাণ্ডুয়া শহর বিখ্যাত তার কালী পুজোর জন্য কিন্তু পান্ডুয়ার অদূরে এই ছোট্ট গ্রামে বিরাজ করেন এক দেবী । যার অবস্থান এই মন্ডলাই গ্রামের রাস্তার ধারে তাই তিনি পথের কালী । ভক্তের পথের মা।  প্রতি দীপান্তিতা কালীপুজো মহাসমারহে পূজিতা হন মা । মেতে ওঠে মন্ডলাই গ্রাম তো বটেই তার সাথে দূর দুরান্ত থেকে আসা ভক্তের দল । পথের ধারে স্বমহিমায় বিরাজ করেন মা । ভক্ত রা দন্ডী কাটে কেউ কেউ আবার মনস্কামনা পূর্ণ হলে বুক চিরে রক্ত ও দেয় । স্থানীয় মানুষ এর বক্তব্য অনুযায়ী এ পুজোর কাল নির্নয় সম্ভব নয় , আনুমানিক চারশো বছরের প্রাচীন এই পুজো । তবে পথের মা এর প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে আছে এক লোকশ্রুতি ।

অতীতে এই গ্রামের পাস দিয়ে বয়ে যেত কঙ্ক নামের এক নদী । সে নদীর তিরে ছিলো এক শশ্মান ভূমি । শাপদ সঙ্কুল জঙ্গল ঘেরা সেই ভূমি তে ছিলো কাপালিক দের আস্তানা তন্ত্রভূমি ।

সেখানেই এক তন্ত্রসাধকের হাত ধরে এই কালীপুজোর শুরু হয় । জনশ্রুতি এমন, ওই তান্ত্রিক এক রাতের মধ্যে দীর্ঘাঙ্গি কালীমূর্তি তৈরির পর পুজো করতেন। সেই রাতেই বিসর্জন দিতেন। সবটাই করতেন লোক চক্ষুর আড়ালে। তবে এক গ্রামবাসীর চোখে পরে যায় কাপালিকের এই ক্রিয়াকলাপ । তারপর তার হাতেই পুজোর সমস্ত কিছু সমর্পণ করে নিখোঁজ হয়ে যান সেই তন্ত্রসাধক । সেই থেকে 

শশ্মানের সেই মা লোক মাঝে বিরাজ পথের ধারে পথের মা রূপে । লোক শ্রুতি এও সেই তন্ত্রসাধকের সমাধী পথের মা এর বেদী । 




বর্তমানে এই পুজো সর্বজনীন । সোনা রূপার বহু মূল্য অংলকারে সুসজ্জিতা হন মা । কমিটির হিসাব অনুযায়ী প্রায় পঁচিশ ভরি সোনা ও প্রায় ষাট ভরি রূপার অংকারে মাকে সাজানো হয় । পথের মা পুজো পরিচালন কমিটির তথ্য অনুয়ায়ী মা এর অলংকারের হিসাব বেস চোখে পরার মত । সব ই কিন্তু মা এর ভক্ত দের দেওয়া। 


সোনার গহনা

১। টায়রা


২। নথ (চেন সহ)


৩। নাকছবি


৪। সোনার হার (বড়)


৫। 'মা' লেখা লকেট সহ চেন


৬  সোনার টিপ ১৬টি 

৭। সোনার জিভ ২টি




৬। রূপার চোখ (৩টি)


৩। সোনার চোখ ২টি


৪। সোনার নাকছবি (১টি)

রূপার গহনা


১। বড় মুকুট


১২। কোমড় ঝাপটা


২। গলার চিক


১৩। মুণ্ডুমালা ১৪। মল (চারটি)


৩। গলার চিক (পুঁতি সহ)


৪। পুষ্পহার


৫। সীতাহার


১৫। বিছা (একটি)


১৬। ধুতরা ফুল (দুটি)


৬। জবা ফুলের মুণ্ডমালা


১৭। পায়ের সাজ (একটি) ১৮। আউট (একটি)


৬। বড় টিপ


৭। টিকলি


৮। নোয়া (চারটি)


১৯। চাঁদমালা


৯। বালা (এক জোড়া)


 ত্রিশূল ,মানতাষা (চারটি), লোহার নোয়া, আর্ম লেট (চারটি)

, কানের ঝুমকো, রূপার খাঁড়া




সুসজ্জিতা দীর্ঘাঙ্গী কালী মাতা সত্যিই মনমুগ্ধ কর । যে রূপ দেখলে ভক্তিভাব জেগে ওঠে । আর সেই টানেই বোধহয় ভক্ত সমাগম । অচেনা রাস্তায় গুগুল ম্যাপ এর সাহায্য নেওয়া অভ্যাস তাই না হলে হাতে পুজো র ডালা নিয়ে নতুন জামায় সেজে যে পথ দিয়ে শয়ে শয়ে মানুষ চলছিল সেই রাস্তায় পা বাড়লে অবশ্যই দেখা পেতাম পথের মা এর ।

Friday, 16 February 2024

বহরানের রাজনন্দিনী

                                      বহরানের রাজনন্দিনী

                                                 ( সিংহ ভিলার সরস্বতী )

                                                                                সুমন্ত বড়াল



Amazon prime এর পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজ টা মনে আছে,  যেখানে গ্রামের অধিবাসী রা নতুন গ্রামে আসা পঞ্চায়েত সচিব কে বারবার বলছেন, গ্রামের জলের ট্যাঙ্কের উপর থেকে গ্রাম টাকে দেখুন গ্রামের প্রেমে পরে যাবেন। আর এই গ্রাম সম্পর্কে বলি আপনি ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন এ পা রাখুন আপনার ভালো লাগবে আর গ্রামে পা দিলেই গ্রাম টার প্রেমে পরে যাবেন। মুর্শিবাদ জেলার সীমানা ঘেঁষা পূর্ব বর্ধমান জেলার ছোট্ট গ্রাম বহরান। যার একদিকে উদ্ধারণ পুরের ঘাট আর একপাশে শ্রীপাট ঝামটপুর। দুই এর মাঝে ছোট্ট গ্রাম বহরান। অতীতের বহিরান আজকের বহড়ান। এ গ্রামে রাজা আছেন আছেন গ্রামের বাবু রা। তবে রাজত্ব বা বাবুয়ানি নেই কিন্তু তাঁরা আছেন যেমন রয়ে গেছে হাটতলা বড় কালী তলা।

সুপরিচিত গবেষক শ্রী স্বপন ঠাকুর, ওনার গবেষণা লব্ধ মতানুসারে এই গ্রামেই শুরু হয় বর্ধমান জেলার দ্বিতীয় বারোয়ারী পুজো। দ্বিশতাব্দী প্রাচীন সে পুজো ছিল সরস্বতী পুজো। কিন্তু কালক্রমে সেই পুজো পরিবর্তন হয়ে আজ পূজিত হন এই গ্রামের দেবী জয় দূর্গা। দেবী সরস্বতী জয় দূর্গা তে রূপান্তরিত হয়েছে বটে কিন্তু আজও এই গ্রামে পুজিত হন এক শতাব্দি প্রাচীন দেবী সরস্বতী।



বহরান গ্রামের সুপরিচিত বর্ধিষ্ণু পরিবার সিংহ পরিবার । শ্রী বিকাশ চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের " সিংহ ভিলা " র সরস্বতী পুজো। যার মূল  বয়স প্রায় শতাব্দী পেরিয়েছে। যে পুজো সিনহা বাড়ি তে হয় বটে কিন্তু যে পুজো নিয়ে মেতে ওঠে গোটা বহরান গ্রাম।   এই সিংহ পরিবারের আদি নিবাস ছিল মুর্শিবাদ জেলার কাঁন্দি তে । কাঁন্দি তেই শুরু হয় দেবীর আরাধনা,  কালক্রমে এই পরিবার বহরানে চলে এলে এই বিগত পনেরো বছর যাবত সাড়ম্বরে এই গ্রামেই হয় সরস্বতী আরাধনা। সিংহ ভিলার ভিতরে রয়েছে দেবীর মন্দির। সারা বছর সেখানে দেবীর কাঠামো পূজিত হয়। আর এই কাঠামো তেই প্রত্যেক বছর তৈরী হয় মাতৃ মূর্তি। আর এই মূর্তি নির্মানেই রয়েছে এক বিচিত্র ব্যাপার। সিংহ বাড়ির পুজোতে যিনি পৈরহিত্য করেন তিনিই এই বাড়ির দেবী মূর্তি নির্মাণ করেন। যিনি মূর্তি গড়েন তিনি ই প্রাণ প্রতিষ্টা করেন এমন দৃষ্টান্ত সত্যি বিরল।  শিল্পী পুরোহিত রামব্রম্ভ ভট্টাচার্য্য যিনি এই গ্রামে ঝুলন ভট্টাচার্য্য নামে বিশেষ পরিচিত। তার কথায় সিং হ পরিবারের পুজো যতটা নিষ্ঠা ও আচার রীতি মেনে পালিত হয় তাদের মূর্তি নির্মাণ ও নিষ্ঠা ও রীতি মেনে। স্নান করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে শুরু হয় মূর্তি নির্মান। তবে মূর্তি টি বৈচিত্র কিছু না থাকলেও দেবীর সাজ সজ্জা ও পুজোর আয়োজন সত্যি নজর কাড়া। এই বাড়ির কর্তি শ্রীমতি ছন্দা সিংহ এর কথায় মা সরস্বতী যেন দেবী নয় সে এ ঘরের মেয়ে।  দেব মাহাত্ম্য আর স্নেহ বাৎসল্য মিলেমিশে একাকার এই বাড়ির পুজোতে।



সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে এমন আয়োজন সত্যি নজর কারে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই সিং হ পরিবারের একটি প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির ও রয়েছে যে মন্দিরে নিত্য সেবা দেওয়া হয়। এই পরিবারের নারায়ণ শিলা রয়েছে, পুজো শুরু আগে সানাই বাদ্য সহকারে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে শিব মন্দির থেকে নারায়ণ শিলা আনা হয় "সিংহ ভিলা " র মন্দিরে। নারায়ণ পুজো আর পুরোহিত বরণের পর শুরু হয় মূল পুজো। আর যে পুজোর শুরুর সাথে সাথে গ্রাম বাসি দের আনাগোনা চোখে পরে। সরস্বতী পুজো মানেই পুষ্পাঞ্জলী। সিংহ বাড়ি র পুজো তে এই পর্ব চলে দীর্ঘক্ষণ । কারণ তখন এই পুজো গ্রামের সর্বজনের। এই পরিবারের নব প্রজন্মের প্রতিনিধি শুভঙ্কর। শুভঙ্কর পড়াশোনার সূত্রে বাইরে থাকে কম্পিটার এর বিষয় নিয়ে পাঠরত শুভঙ্করের বন্ধুরা ভিডিও কলেও এই বাড়ির পুজোতে পুষ্পাঞ্জলী দিতে দেখা যায়। এই পুজোর এমন মাহাত্ম্য। ফুল মালা ধুপ ধুনা র গন্ধে যখন ভরপুর সিনহা বাড়ির উঠোন। তখন উনানে আচ গনগনে ভোগের আয়োজন তার চরম পর্যায়ে। যদির সূচনা হয় আগের রাতেই। রাত থেকেই চলে সবজীর কাটাকুটি। মিষ্টির ভিয়ানে তৈরী হয় রসালো বোঁদে। 




সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই উঠান জুড়ে মানুষের ঢল। চেয়ার টেবিলে বসে ভোগ খাওয়া। সিং হ বাড়ির আতিথিয়তা এই বিষয়ে দেখার মত। এই বাড়ির কণিষ্ঠ সদস্য সারমেয় বাঘা সেও অতিথি পরায়ণ। দুপুর গড়িয়ে বিকাল মানুষে মানুষে ছয়লাপ উঠান। ভোগ পেয়ে সবাই খুশি সন্ধ্যে নামে বেজে ওঠে সাঝের সানাই। আরতির প্রদীপে আর রঙিন আলোয় সেজে ওঠে সিংহ ভিলা । 




পরদিন দধিকর্মা শেষে সন্ধ্যের শোভাযাত্রা তোড়জোড়। সন্ধ্যে হলেই সারা গ্রাম প্রদক্ষিণের পর স্থানীয় দীঘিতে বিসর্জন। সিংহ পরিবার সহ পুরো গ্রাম বিদায় জানায় দেবী কে আর অপেক্ষা শুরু হয় তাদের আদরের " বহরানের রাজনন্দিনীর " জন্য ...



Thursday, 18 January 2024

শতাব্দী পেরিয়ে অগ্নি দেবতা রূপে ব্রম্ভাপুজো

 

   শতাব্দী পেরিয়ে অগ্নি দেবতা রূপে ব্রম্ভাপুজো  

 



অগ্নিদেব নন আগুনের হাত থেকে বাঁচতে আরাধনা করা হয় অগ্নি দেবতা ব্রম্ভার। ১৬০ বছর ধরে এই রীতি পালন হচ্ছে হুগলী জেলার রিষড়ায়। শতাব্দী পেরিয়ে যে পুজো আজও পুরানো সকল রীতি মেনে পালিত হয়ে চলেছে।

জনশ্রুতি বলছে বহু বছর আগে রিষড়া অঞ্চলের গঙ্গার ধারে  হাট বসত, শ্যামপুরের হাট নামে পরিচিত সেই হাট ছিল পান গুড়ের জন্য প্রসিদ্ধ  একবার ভয়াবহ আগুনে সেই হাট ভস্মীভূত হয়ে যায়। হাট পুড়ে যাওয়ায় এক গভীর সমস্যার সম্মুখীন হয় হাটুরেরা। এই রকম সময় এক সাধক পুরুষ স্থানীয় সাধুখাঁ পরিবার কে প্রজাপতি ব্রম্ভার আরাধনা করতে বলেন ,  সেই আদেশ অনুসারে শুরু হয় ব্রম্ভা পুজোর। যা আজও চলছে। প্রথম যেদিন পুজো সূচনা হয় সে দিন টি ছিল পয়লা মাঘ,  সেই থেকে প্রতি বছর পয়লা মাঘ ব্রম্ভা পুজোর আয়োজন হয় রিষড়ার গঙ্গার ধারের ব্রম্ভাতলায়। তবে এই পুজো আজ সর্বজনীন কিন্তু প্রাচীন রীতি নীতির কোন হেরফের হয়নি। আজও রীতি মেনে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে ব্রম্ভা মন্দিরে ধ্বজা উড়িয়ে উৎসবের সূচনা হয় ,  পৌষের পয়লা তারিখে কাঠামো তৈরি করে মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়। একমাসে মূর্তি গড়ার কাজ সম্পন্ন হলে   পৌষ সংক্রান্তির দিন দেবতার ঘট স্থাপন হয়। পয়লা মাঘ হয় মহাপুজো। কাঠামোতে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ত্রিদেব  থাকেন। অগ্নিবর্ণের ব্রহ্মার মাঝে থাকে তাঁর বাহন হাঁস। ব্রহ্মার হাতে কমুণ্ডল। ডান পাশে থাকেন মহেশ্বর। বাম দিকে বিষ্ণু।



এই পুজো সার্বজনীন হলেও স্থানীয় সাধুখাঁ পরিবারের নাম এই পুজোর সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, সাধুখাঁ পরিবারের শ্রী জগ্নেশ্বর সাধুখাঁ এক চালার উপর দেবতা স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে শ্রী বটকৃষ্ণ সাধুখাঁ শ্রী জীবন কৃষ্ণ সাধুখাঁ ১৩৩৪ সালে চালাঘরকে মন্দিরের রূপ দেন।

শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো তে রিষড়া তথা পার্শ্ববর্তি অঞ্চল এমন কী রিষড়ার উল্টো পাড়ে অবস্থিত খড়দহ থেকে মানুষ এই পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। পয়লা মাঘ সারাদিন মানুষের আনাগোনায় জমজমাট থাকে মন্দির চত্বর , চলে মানতের পুজো।  পুজো উপলক্ষে ভোগের আয়োজন হয়। শেষ দিন অনুষ্ঠিত সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। ব্যতক্রমী ভাবে বিসর্জনের সময় স্থানীয় ছেলেরা ধুতি পরে দেবতা কে বরণ করেন।




পুজো উপলক্ষে ব্রম্ভা মন্দির চত্বরে বসা মেলায় নানা জিনিষ তো চোখে পড়বেই , তবে এই পুজোয় এলে অবশ্যই চাক্ষুস করে স্বাদ নিতে হবে এই পুজোর আরেক আকর্ষণ নারকেলের সন্দেশের।

Monday, 20 November 2023

গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো

 

                

                           গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো

( প্রথম বারোয়ারী বাংলার প্রথম জগদ্ধাত্রীমন্দিরের কথা )

                                                                        সুমন্ত বড়াল

বাংলার প্রথম জগদ্ধাত্রী মন্দির এর বিগ্রহ 










রোজ কার জীবন যাপনের একঘেঁয়েমি থেকে একটু অন্যরকম স্বাদ এনে দেয় উৎসব। উৎসব মানেই চেনা ব্যস্ততা ভুলে অন্যরকম ব্যস্ততা যাতে বাধ্যবাধকতা নেই কিন্ত মনের আনন্দ আছে। এই আনন্দ মুখর দিন গুলোর জন্য মানুষ অপেক্ষায় থাকে বছরভর , আসলে উৎসব মানে একরাশ আনন্দ মানুষে মানুষে মিলমিশ। আর আমরা সকলেই তো উৎসব প্রিয়।

তেমনই এক উৎসব এর ইতিহাস,  কাহিনী কিংবা লোকশ্রুতি এইসব নিয়ে গল্প হোক।  হুগলী জেলার প্রান্তিক এক জনপদের  এর কথা। আচ্ছা হুগলী জেলার জগদ্ধাত্রীপূজা বলতেই কি মনে আসে?  চন্দননগর, আলোর খেলা আর বিশাল দেবী মূর্তি , তাই তো?  কিন্তু চন্দননগর ছাড়াও হুগলী জেলার জগদ্ধাত্রীপূজা ইতিহাস রয়েছে  জেলার প্রান্তিক জনপদ গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রীপূজা তে এলে আপনি খোঁজ পাবেন সেই ইতিহাসে গুপ্তিপাড়ার সেই গল্পই  বলব। আসলে গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রীপূজা সাথে জড়িয়ে রয়েছে বারোঁয়ারি পুজোর ইতিহাস। যে বারোঁয়ারি পুজো নিয়ে আজ এত মাতামাতি তা প্রথম শুরু হয় এই গুপ্তিপাড়ায়।

আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে ২৬৩ বছর আগের এক দুর্গাপুজোর সময়। সে বছর  গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের কিছু মহিলা স্থানীয় জমিদার বাড়িতে দূর্গাপুজা দেখতে গিয়ে অপমানিত হন, বাড়ি ফিরে তারা সে কথা জানালে , সেই বাড়ির ছেলেরা নিজেদের উদ্যোগে পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দুর্গাপূজা তো তখন হয়ে গেছে তাই কার্ত্তিক মাসের শুক্ল নবমী  তারা পূজা আয়োজন করে। শুরু হয় অবিভক্ত বাঙলার প্রথম যৌথ উদ্যোগে পুজো যা রাজবাড়ির আঙিনায় নয় বরং সাধারণ এর উঠানে যার লৌকিক নাম বারোয়ারী পুজা।


বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী


দেবীর নাম হয় বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী সেই থেকে আজও গুপ্তিপাড়ার বিন্ধ্যবাসিনী তলা তে সাড়ম্বরে পালিত হয় এই পুজো গুপ্তিপাড়া ১২ জন ব্রাহ্মণ যুবক মিলে প্রথম রাজবাড়ীর ঠাকুর দালান থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে এলো উৎসব কে। উৎসব তো সকলের রাজা বা জমিদারের আঙিনায় তা বন্দী থাকবে কেন? আজ থেকে ২৬৩ বছর আগে যেন এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই বারো ইয়ার।

তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় এই ঘটনার উল্লেখ করা হয়।

সেই সময় স্থানীয় ব্রাহ্মণরা  বারোজন কে নির্বাচিত করে একটি কমিটি গঠন করেন ।যারা বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কাছ থেকে সেই সময় ৭০০০ হাজার টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে।

এই বিষয়ে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত "ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া " পত্রিকায় ১৮২০ সালে একটি খবর প্রকাশিত হয়। যাতে লেখা হয়।

"  A new species of puja which has been introduced into Bengal within the last thirty years called barowaree, About thirty year's ago at Guptipara near Santipoora a twon celebrated in Bengal for it's numerous colleges a number Brahmans formed on association for the celebration of puja independently of the rules of shastra "

অর্থাৎ এই পত্রিকার প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এই পুজা শুরু ১৭৯০ সালে , ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকা এই মত গ্রহণ করেছে তবে সাল নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। বিন্ধ্যবাসীনি তলা নিবাসী উষানাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয় এই পুজোর দ্বিতীয় বর্ষের পুজোর একটি ফর্দ খুঁজে পান। যে ফর্দের কথা শ্রী বিনয় ঘোষ তার পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (পাতা ৪৭৭ ২য় সংষ্করন) যে ফর্দের উল্লেখিত সাল বাংলার ১১৬৭ সন অর্থাৎ ১৭৬০। বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী মূর্তিটিও বৈশিষ্ঠ পূর্ণ সিংহ বাহিনী দেবীর ডান পাশে থাকেন মহাদেব বাম পাশে নারায়ণ। 

পুজোর রীতি নীতি তে রয়েছে নানা বৈশিষ্ঠ। শক্তির আরাধনা হলেও এই পুজোতে বলি প্রথার চল নেই। মূলক শুক্ল নবমী তিথিতে চারপ্রহরের এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পুজো দিন সকাল থেকেই বহুমানুষের সমাগমে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর। ঢাক , ঢোল , করতাল , সানাই এর সম্মিলিত সুরে মুখরিত হয়ে হয় বিন্ধ্যবাসিনী তলা। তবে এই পুজোর আরেক আকর্ষণ তার ভোগ আচারে , মূলত খিচুরি ভোগের আয়োজন করা হয় বটে কিন্তু এই ভোগ গ্রহন করে সারা গুপ্তিপাড়ার মানুষ শয়ে শয়ে মালসা আয়োজন করা হয়। দুপুরে চলে মালসা ভোগ বিতরণ সাথে চলে পংক্তি ভোজন। এই পুজোর আরো এক বৈশিষ্ঠ তার বিসর্জনে। পুজোর পরদিন বিসর্জনের দিন সন্ধ্যেবেলা আয়োজন হয় বাজি প্রদর্শনীর। প্রাচীন এই রীতির আজো বদল ঘটেনি তবে সরকারী নির্দেশ মেনে পরিবেশ বান্ধব বাজীই পোড়ানো হয় এই প্রদর্শনী তে। স্থানীয় রথ তলায় আয়োজন করা হয় এই বাজী খেলার যা চলে সন্ধ্যেথেকে রাত পর্যন্ত। এই বাজী উৎসব শেষে মায়ের নিরঞ্জন সম্পন্ন হয়।

কাঁঠালেশ্বরী

এবার আসি গুপ্তিপাড়ার আর এক প্রাচীন বারোয়ারির কথায় তেলিপাড়া কাঁঠালেশ্বরী বারোয়ারি এই পুজো শুরু হয় বাংলা ১২১৭ সালে। যেখানে বিন্ধ্যাবাসিনী পুজোর প্রচলন হয়, সেখান থেকে অনেকটাই দূর তেলিপাড়ার এই পুজোমণ্ডপ৷ এই এলাকার বাসিন্দা, বিশেষত মহিলাদের পক্ষে অতদূরের প্রতিমা দর্শন সহজ ছিল না। তাই এই এলাকার বারোয়ারি।

কাঁঠালতলায় শুরু হয় পুজো। এটিই গুপ্তিপাড়ার দ্বিতীয় জগদ্ধাত্রী পুজো বাংলা ১২১৭ অর্থাৎ ইংরাজি ১৮১০ খ্রী এই পুজো সম্ভবত বাংলার দ্বিতীয় বারোয়ারী পুজো কাঠালেশ্বরী বারোয়ারির ৩১ বছর পরে শুরু হয় আর এক বারোয়ারির  যে পুজোর সাথে জড়িয়ে ভবাণীচরণ দাস, দ্বারিকানাথ ভট্টাচার্য, সাতকড়ি কর মজুমদার, কালীচরণ প্রামাণিক কালাচাঁদ মুখোপাধ্যায় নামে পাঁচজন বালক এর নাম এই পাঁচ বালক মিলে ১২৪৮ সালে গুপ্তিপাড়ার পাঠমহলা অঞ্চলে আর এক পূজো শুরু করেন পাঁচ বালকের হাতে সৃষ্টি এই পুজোর নাম হয় বালকেশ্বরী জগদ্ধাত্রী গুপ্তিপাড়ায় পাটমহল এলাকায় রয়েছে  রঘুনাথতলায় রঘুনাথজির মন্দির এই রঘুনাথজির মূর্তি  নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা যায় সেই কথা থাক আবার প্রসঙ্গে ফিরি এই  মন্দিরকে কেন্দ্র করেই বালকেশ্বরী  বারোয়ারি পুজোর চল শুরু আজও এখানে সংকল্প করা হয় রঘুনাথের নামে। পুজোর সময় শিলা রাখা হয় মণ্ডপে। এই পুজোর এটি বিশেষ  বৈশিষ্ট্য

বালকেশ্বরী



এই তিনটি পুজো ছাড়াও গুপ্তিপাড়ার দাস বাড়ির পুজো বেস প্রাচীন সেখানে পঞ্চমুণ্ডী আসনে দেবী আরাধনা হয়। তবে সে প্রসঙ্গে যাবো না বরং গুপ্তি পাড়ার অন্তর্গত সোমড়া বাজারে এসে শেষ করব এই উৎসব আখ্যান। সোমড়ার মিত্র মুস্তাফী বাড়ি কিংবা আনন্দময়ীর মন্দিরের কথা বহুল প্রচলিত, লোকশ্রুতি আছে রাণীরাসমণী এই মন্দিরের আদলেই নাকি দক্ষিণেশ্বএ এর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু সোমড়া কেন?  আসলে এই সোমড়া বাজার গ্রামেই রয়েছে বাংলার প্রথম জগদ্ধাত্রী মন্দির। আর এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে মুঘল সম্রাট শাহ আলম এর নাম। সোমড়া ২৫৭ বছরের প্রাচীন দেওয়ানজি মন্দির।

এই মন্দির বিগ্রহ পুজো নিয়ে বিস্তারিত ইতিহাস জানান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এই পরিবারের বর্ষিয়ান সদস্য  রীতেন্দ্রনারায়ণ রায় ।তিনি জানান তাঁদের পারিবারিক এই পুজো বছর ২৫৭তম বর্ষে পদার্পণ করেছে তাঁদের পূর্বপুরুষ রামশঙ্কর রায় ১১৭২ বঙ্গাব্দে শেষ মোঘল সম্রাট শাহ আলমের দেওয়ান ছিলেন। সেই সময় মোঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন এরকম ১০ থেকে ১২ জন বিদ্রোহীকে সম্রাট ধরার জন্য রামশঙ্কর রায়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশ পাওয়ার পরই রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন রামশঙ্কর রায়। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন রাতে তাঁকে স্বপ্নে মা দেখা দিয়ে বলেন তুই আমাকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠা কর। সোমড়ার মাটি খুঁড়ে জগদ্ধাত্রী মাতার একটি অষ্টধাতুর মূর্তি উদ্ধার করে মাকে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেই বছরই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৬১ সালে এই প্রাচীন মূর্তি টি চুরি হয়ে গেলে

 পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে রায় পরিবারের  সকলে মিলে মায়ের নতুন একটি অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করে পুনরায় মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। জগদ্ধাত্রী মন্দিরে পঞ্চানন শিবের মূর্তি রয়েছে। মূর্তি কোন সময়কার আজ পর্যন্ত সেই সম্পর্কে কেউ আলোকপাত করতে পারেননি। এখানে লক্ষ্যণীয়  শিবের কোলে লক্ষ্মী গণেশ এবং মাথার কাছে সরস্বতী কার্তিক বিরাজ করছেন। শিবমূর্তির বিশেষত্ব হল শিবের দাড়ি রয়েছে যা বিরল। অনুমান করা যায় যেহেতু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের দাড়ি থাকে তাই বলা যেতে পারে ধারণা সেই সময় মোঘল স্থাপত্য হিন্দু স্থাপত্যের একটা মেলবন্ধন হয়েছিল ওই শিবমূর্তির মধ্য দিয়ে।

হুগলী জেলা বরাবই উৎসব মুখর। সে রথ,  দূর্গোৎসব,  জগদ্ধাত্রী যাইহোক না কেন,  এই জেলার লৌকিক দেবদেবী কিংবা মন্দিরের প্রাচুর্য কিছু কম নয়। আর এসবের সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। তাই হুগলীর কথা উঠলেই উৎসবের কথা মনে আসে,  আসলে এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের চর্চা হয়ে যায়।

 

 

বিশেষ ধন্যবাদ -

সুদেষ্ণা মুখার্জ্জী

. স্বপন ঠাকুর

সুব্রত মন্ডল

শুভঙ্কর সিংহ

তথ্য সূত্র -

হুগলী জেলা বঙ্গ সমাজ ( সুধীর চক্রবর্তী)

হুগলী দর্শন - ( ফেসবুক পেজ) 

সংবাদ প্রতিদিন

বর্তমান পত্রিকা।

উনিশ শতকের সংবাদ পত্র

( স্পন্দন মুখার্জী)

 

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...