Friday, 30 October 2020

সাজি বাড়ির ঠাকুর দালানে শক্তির আরাধনা

                         সাজি বাড়ির ঠাকুর দালানে শক্তির আরাধনা 



পুজো পরিক্রমা ব্যাপার টা বেশ মজার, তবে এ পরিক্রমা প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখা নয়। এই পরিক্রমায় প্যান্ডেলের বদলে বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালান। এক একটা ঠাকুর দালান যেন এক একটা উপন্যাস। কত চরিত্র, কত কাহিনী আর সবার মধ্যমণি দূগ্গা ঠাকুর আরও কত রূপ বৈচিত্র্য, আর মানুষজন। আসলে পরিক্রমা তো অজুহাত মাত্র। পূজোর ছুতোয় আলাপ পরিচয় আর নিজেকে  সমৃদ্ধ করে নেওয়া। পুজো আসছে মানেই যেমন কুমোর পাড়ায় নিত্য যাতায়াত তেমনি খোঁজ নেওয়া আশেপাশের বনেদি বাড়ি গুলির। চেনা বাড়ির ভিড়ে অচেনা অজানার খোঁজ ঠিক মিলে যায়। কিংবা পথ চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় কোন সিংহদুয়ার পেরিয়ে ঠাকুরদালান। নতুন নতুন গন্তব্য আর নতুন নতুন কাহিনী , এবারের শারদ উৎসব ব্যতিক্রমী হলেও এই বনেদি বাড়ি পরিক্রমায় ভাটা পড়েনি একইভাবে ভাটা পড়েনি বাড়ির মানুষের আদর আপ্যায়নে।  তবে ওই যে বলছিলাম হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া। এই বছর ও সেই রকমই ঘটলো। আসি তাহলে সেই গল্পে।



এবছর সপ্তমীর দুপুর পেটে খিদে খিদে ভাব তখন জানান দিচ্ছে বেলা বেশ খানিকটা হলো। আসলে আবহাওয়া মেঘলা থাকলে বোঝা যায় না। সঙ্গীর অনুরোধে নির্দিষ্ট রাস্তাটা  বদলে অন্য রাস্তা দিয়ে ফেরার পালা। বলতে বাঁধা নেই রাস্তা পরিবর্তন না করলে এই হঠাৎ প্রাপ্তিটা ঘটতো না। সারা দিনের ঘোরাঘুরি ক্লান্তি নিয়ে চলছি আমরা। হঠাৎই রাস্তার ধারে চোখ আটকালো একটা বড় দরজার দিকে। দরজা ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা গলি পথ জুড়ে আলপনা আর গলি পথের দু’ধারে পুরনো ইট খসা দেওয়াল।  গলি পথটা মিশেছে একটা থামওয়ালা ঠাকুরদালানে যে দালান আলো করে রয়েছে দুর্গা মূর্তি। পুরো পরিবেশটা দূর থেকে দেখেই চমক লাগলো। খিদে, তেষ্টা , ক্লান্তি উধাও ভিতরে যেতেই হবে। আর ছবি তোলার শখ যখন এমন ছবি কি মিস করা যায়। দরজা পেরিয়ে  বলা ভালো সিংহদুয়ার পেরিয়ে ঠাকুরদালান, লম্বা থামের মাঝে তখন দেবী মূর্তি ঢাকের আওয়াজ আর মন্ত্রোচ্চারণে মাতোয়ারা ঠাকুরদালান চত্বর।  চমকালাম আবার, এই বাড়ির দেবীমূর্তি অন্যরকম এখানে মহিষাসুরমর্দিনী দেবী মা সপরিবারের রূপে নয়। অর্থাৎ দেবীর সাথে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক নেই। কিন্তু কাদের বাড়ি এইটা, কি বা এর ইতিহাস।  কিছুই জানি না আমরা শুধু জানি আমরা রয়েছি হুগলির বাঁশবেড়িয়ার একটি প্রাচীন বাড়ির ঠাকুরদালানে ।

চোখে কৌতূহল নিয়ে ঠাকুর দালানের এক কোনায় আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়া। আলাপ পরিচয় সারা হলে তিনি জানালেন তিনি এই বাড়িরই প্রবীণ সদস্যা। ওনার ব্যাস্ততার কারণে ওনার নাম জানা না হলেও এই টুকু আমরা জানতে পেরেছি , আমরা রয়েছি বাঁশবেড়িয়ার বিখ্যাত সাধু পরিবারের ঠাকুর দালানে। স্থানীয় মানুষের কাছে যে বাড়ি সাজিবাড়ি নামে পরিচিত। 



বাঁশবেড়িয়ার সাজিবাড়ির এই দুর্গাপুজোর সাথে জড়িয়ে রয়েছে তিনশো বছরের ইতিহাস। তখন বাংলায় সপ্তগ্রাম বন্দরের নাম জগৎ বিখ্যাত। এক দিকে সরস্বতী নদী অন্য দিকে ভাগীরথী নদী কে কেন্দ্র করে পূর্ব ভারতের নদীপথে ব্যাবসা বাণিজ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু এই সপ্তগ্রাম বন্দর। এই সময় বিহারের মুঙ্গের থেকে ব্যাবসা বাণিজ্য করার জন্য বাংলায় এলেন রামময় সাধু। তিনি শুরু করলেন সাজি মাটির ব্যাবসা। তখনও সাধু পরিবার মুঙ্গেরেই বসবাস করে। পরবর্তীতে সপ্তগ্রাম বন্দর কৌলিন্য হারালেও রামময় সাধুর সাজি মাটির ব্যাবসা ততদিনে বিস্তার লাভ করেছে। ওপর দিকে তখন ইংরেজ সরকারের জমি বন্টন নীতি শুরু হয়েছে। ঠিক এই সময় রামময় সাধু তৎকালীন বাঁশবেড়িয়ার রাজ পরিবারের সিংহাসনে রয়েছে রাজা ধ্রুব দেবরায়। সরকারি জমি বন্টননামায় এই ধ্রুব দেবরায়ের থেকে জমি ইজারা নেন রামময় সাধু। তারপর থেকেই সাধু পরিবার বিহারের মুঙ্গের থেকে বাংলার বংশবাটি, এখনকার বাঁশবেড়িয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। এই সাধু পরিবারের প্রধান ব্যাবসা ছিল সাজিমাটির। সেই কারণে সাধু পরিবারের এই বাড়ি সাজিবাড়ি নামেই পরিচিত।


 

সাধু পরিবারের সদস্য অতনু সাধুর কাছে তাদের পরিবারের ইতিহাস জানতে জানতে চোখের সামনে যেন সেই সপ্তগ্রাম বন্দর, সেই পুরোনো আমলের ছবি ভেসে উঠছিল। সাধুদের ঠাকুর দালান তখন যেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপট। সম্বিৎ ফিরলো ঢাকের আওয়াজে, অতীত থেকে একেবারে বর্তমানে অতনু বাবু হাসিমুখে তখনও বলে চলেছেন তাদের পারিবারিক ইতিহাসের কথা। আগেই বলেছি সাধু পরিবারের এই দুর্গা মূর্তি অন্য রকম। আসলে এই শরৎকালে দুর্গাপূজা তো অকাল বোধন। সেই অকাল বোধনের শ্রীরামচন্দ্রের পূজিত দেবী মূর্তির রূপই এই সাধু পরিবারের ঠাকুর দালানে বিদ্যমান। এখানে মূলত শক্তির আরাধনাই হয়। তবে সাধু পরিবারে বলি প্রথার চল নেই। দেবীর মহিসমর্দিনী রূপ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। কথায় গল্পে ঢাকের বোলে আশেপাশের মানুষের হৈ হুল্লোড়ের সাথে সাথে দুপুর গড়িয়ে তখন বিকাল। আগে থেকে তৈরি তালিকা জানান দিচ্ছে এখনো কয়েকটা বাড়িতে যাওয়া বাকি। কাজেই বিদায় জানাতে হবে সাধু পরিবারকে। তবে রাস্তা ভুলে তিনশো বছরের ইতিহাসের মুখোমুখি হয়ে যে অনন্য অভিজ্ঞতা হলো তা নস্টালজিয়া হয়ে থেকে যাবে। 

সুমন্ত বড়াল 

Monday, 12 October 2020

আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ির দুর্গাপূজা (বেগমপুরের শতবর্ষ পুরানো গুপ্তবাড়ির পুজো )

 

                   আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ি দুর্গাপূজা                          

        বেগমপুরের শতবর্ষ পুরানো গুপ্তবাড়ির পুজো 


প্রাক্‌ শারদীয় এই মরশুম টা ভীষণ ই সুন্দর। মহৎসবের প্রস্তুতি তে প্রকৃতি নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে। আর প্রকৃতির এই বাহারের স্বাদ নিতে বাইরে বেড়িয়ে পড়তেই হবে।

প্রাক্‌ শারদীয় এই মরশুমে খুব কমন গন্তব্য কুমোর পাড়া, আর সেখানে দেখা পটুয়া দের শিল্প কর্ম, কিংবা কাশ ফুলে ঢাকা নদীর পাড়।

এসব কিছু বাদ দিয়ে আর এক গন্তব্যে পৌঁছে যেতে মন চায়। যদিও বছরের যেকোন সময় ই সেই জায়গা ভীষণ আকর্ষণীয় তবু এই সময় সেই জায়গার এক আলাদা আকর্ষণ আছে। হ্যাঁ, আমি বনেদি বাড়ির অন্দর এর কথা বলছি। সেই বাড়ি গুলো, যেখানে আজও দূর্গাপুজো হয়। এই প্রাক্‌ পুজো মরশুমে যে বাড়ি গুলোর ঠাকুর দালানে চোখে পড়ে ঠাকুর গড়ার ছবি,যে দালানের দেওয়ালে কান পাতলে অতীত থেকে ভেসে আসে উৎসব এর হাজার কলরব। সেই সব বাড়ি গুলোর জৌলুষ এ ভাটা পড়লেও আসন্ন উৎসব এর মেজাজ সেখানে অন্যরকম। 

ঘুরতে ফিরতে এমনই এক বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া,হুগলী র বেগমপুর অঞ্চলের গুপ্ত বাড়ি।

এখানে একটা মজার কথা বলি, এমন ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে যায়।  



আসলে কোন পূর্ব প্রস্তুতি বা হিসাব কষে ঘোরাঘুরি করার স্বভাব আমার নয়,যখন যেখানে যা চোখে পরে দাঁড়িয়ে পড়ি।আর হঠাৎ ই কোন গুপ্তধন পাওয়ার মতো পেয়ে যাই কোন দারুন তথ্য।

বেগমপুরের গুপ্ত বাড়ির ক্ষেত্রে ও তাই হল, একটা পুরানো ঠাকুর দালান দেখে ভিতরে ঢুকে তো পড়ি কিন্তু আলাপ পরিচয়ে জানতে পারি গুপ্ত বাড়ি র মেয়ে স্বনামধন্য লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী।

অর্থাৎ এককথায় যে বাড়ির দুর্গাপূজা নিয়ে কথা বলছি তা লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ির দুর্গাপূজা।

গুপ্ত বাড়ির ঠাকুর দালান পেড়িয়ে গুপ্ত বাড়ির ভিতর ঢুকতেই আলাপ হল উজ্জ্বল গুপ্ত-র সাথে, উজ্জ্বল বাবু শিক্ষক ছিলেন, বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত। আলাপ হল ওনার দাদা নিশীথ গুপ্ত মহাশয়ের সাথে। গুপ্ত বাড়ির এই দুজন মানুষের সম্পর্কে প্রথমেই যে কথাটি মাথায় আসে, এনারা এনাদের বয়স কে হারিয়ে দিয়েছেন। নিশীথ বাবুর বয়স আশি পেরলেও ষাট বলে ভুল হয় আর দ্বিতীয় ওনাদের আতিথেয়তা ও ব্যবহার যা মনমুগ্ধকর।

ওনাদের থেকে বয়েসে অনেকটা কাঁচা হলেও গল্প আড্ডা জমে উঠল। প্রসঙ্গতই এলো গুপ্ত বাড়ির পুজোর কথা, আশাপূর্ণা দেবীর কথা। উজ্জ্বল বাবু জানালেন, আশাপূর্ণা দেবী এই বাড়িরই মেয়ে। ওনাদের জ্ঞাতি সম্পর্কে। তবে গুপ্ত বাড়ির দূর্গাপুজোর থেকেও কালী পুজো আরও প্রাচীন, এবং আমরা যে ঠাকুর দালান দেখছি সেই দালান আসলে পঞ্চমুন্ডির আসন এবং তাদের কালী পুজো আড়াইশো বছরের পুরানো। তবে গুপ্ত বাড়ির এই দুর্গাপূজোও শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। যে পুজো আজও চলছে। গুপ্ত বাড়ির পুজোর জৌলুষ এখনো একই রকম ভাবে বজায় রেখে চলেছেন শ্রী নির্মল চন্দ্র গুপ্তের পরিবারের মানুষজন। 

শ্রী উজ্জ্বল গুপ্ত 

তবে পুজোর কথা জানতে গেলে একটু অতীত চর্চা প্রয়োজন। বেগমপুর গ্রামে তখন দুর্গাপুজো হয়না বললেই চলে,পুজো বলতে বেশ কিছুটা দূরে বাকসা কিম্বা জনাই এর জমিদার বাড়ির পুজোগুলো। কাজেই উৎসবের দিনে এই অঞ্চলের মানুষের বেশ মন খারাপ। বেগমপুর অঞ্চলের মানুষের এই মন খারাপ চোখ এড়ালোনা সেই সময়ের এই অঞ্চলের সমাজসেবী, ওরিয়েন্টাল কোম্পানিতে কর্মরত এবং বেগমপুর অঞ্চলের “দি ক্লাব” – এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী নির্মল চন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের। এই মফস্বল এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। কাজেই এই কথা বলাই যায় নির্মল চন্দ্র ছিলেন খুব পরিচিত মুখ। এই নির্মল চন্দ্র ঠিক করলেন এই অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে দূর্গাপূজা শুরু করবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ কিন্তু সেই গুপ্ত বাড়ির মানুষজন চাইল পুজো যখন হবে তখন সেটি গুপ্ত বাড়ির ঠাকুর দালানে কেন নয়। কিন্তু পঞ্চমুন্ডির আসনে কি দুর্গাপূজা সম্ভব।

আসলে মানুষের ইচ্ছে-খুশীর কাছে নিয়ম তুচ্ছ। আর মায়ের আবির্ভাবই তো হবে, তাই সব বাঁধা পেড়িয়ে শ্রী নির্মল চন্দ্র গুপ্ত প্রথম শুরু করলেন এই গুপ্ত বাড়ির দূর্গাপূজা।



উজ্জ্বল বাবু তার বাবার কথা বলতে বলতে নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলেন, আর ওনার কথা বলা ধরন একটা দারুণ গল্প শোনার অনুভূতি যেন। তবে এই দুর্গাপূজা নিয়ে একটি ছোট কাহিনী শোনালেন নিশীথ গুপ্ত মহাশয়। তার কথায়, কোন এক সন্ধ্যাবেলা ওনাদের ঠাকুমা দেখেন তাদের ঠাকুর ঘর থেকে এক কিশোরী মেয়ে হঠাৎ ঠাকুর দালানের দিকে গিয়ে মিলিয়ে যায়, ঠিকই একই রকম দৃশ্য নির্মল চন্দ্র ও দেখেন। এই ঘটনা কোন দৈব ঘটনা নাকি নিছক চোখের ভুল সেটা নিয়ে দ্বন্দের অবকাশ নেই।

এককথায় মানুষের জন্য কিংবা দৈব আদেশেই হোক গুপ্ত বাড়িতে যে দুর্গাপূজা শুরু হয় টা আজও মহাসমারোহে পালিত হয়ে চলেছে। সেই শত বর্ষ আগে যে সংকল্প নিয়ে শুরু হয়েছিল আজও সেই ভাবে হয়ে চলেছে। পুজোর পাঁচদিন গুপ্ত বাড়ির ঠাকুর দালান শুধু গুপ্ত বাড়ির থাকেনা, সারা বেগমপুরের মানুষ এই গুপ্ত বাড়ির পুজোয় অংশগ্রহণ করে। সব মিলিয়ে পুজোর পাঁচদিন মেতে ওঠে গুপ্ত ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এই গুপ্ত বাড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে। 

গুপ্ত বাড়ির পুজো হয় শাক্তমতে। পুরানো রীতি মেনে প্রতিমার দলার সাজ ও তার সাদা রঙ শতবর্ষ পার করেও অপরিবর্তিত। সাদা রঙের ডাকের সাজের প্রতিমা বেশ মনমুগ্ধকর। গুপ্ত বাড়িতে বলি প্রথা প্রচলন রয়েছে। স্থানীয় মানুষ জন মানসিকের বলি উৎসর্গ ও করে থাকেন। তবে এই বাড়ির পুজোর আকর্ষণীয় বিষয় দশমীর নরনারায়ণ ভোজন। দশমীর দিন দুপুরে স্থানীয় অঞ্চলের সকল ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ গুপ্ত বাড়িতে আসেন ভোগ গ্রহন করতে। সন্ধ্যেতে সরস্বতী নদীতে বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি হয় শারদ উৎসবের। আর প্রস্তুতি শুরু হয় কালীপুজোর। আগেই জানিয়েছি গুপ্ত বাড়ির কালীপূজো বহু প্রাচীন।


প্রাক পুজো ভ্রমণে বেগমপুরের গুপ্ত বাড়ি মন ছুঁয়ে গেল। বাড়ির সদস্যদের আতিথেয়তা যেমন মন ছুঁয়ে গেল তেমনি এই বাড়ির সাথে আশাপূর্ণা দেবীর সূত্র ও কোথাও যেন অন্য একটা আকর্ষণ এনে দেয় এই বাড়ির প্রতি। কাজেই যে পুজোয় একসময় আশাপূর্ণা দেবী অংশগ্রহণ করেছেন, সেই শতবর্ষ পেরোনো গুপ্ত বাড়ির পুজোয় আপনিও ঘুরে যেতে পারেন। আশা করি মন্দ লাগবেনা।

সুমন্ত বড়াল 

Sunday, 13 September 2020

মেরিয়া গ্রামে একবেলা

                                                     মেরিয়া গ্রামে একবেলা  




উদ্দেশ্য বিহীন বেরিয়ে পড়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে। একটা হাইওয়ে ধরে কিছুটা গিয়ে তারপর ম্যাপে খুজতে থাকা গন্তব্য। এবার ও তার ব্যতিক্রম হলনা। দিল্লী রোড ধরে পৌঁছে গেলাম ব্যান্ডেল রাজহাট মোড়। সেখানে দাড়িয়ে আমেদের প্রথম বিরতি আর ঠিক করে নেওয়া গন্তব্য । ম্যাপ খুজে চোখে পড়ল একটা নাম। মেরিয়া। পোলবা দাদপুর ব্লক এর অন্তর্গত একটা ছোট্ট গ্রাম, মনে পড়ল এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম এই মেরিয়া গ্রামের কথা। মেরিয়া গ্রামে র পালিত বাড়ির কথা।

সময় নষ্ট না করে রওনা হলাম,  রাজহাট থেকে সাত কিলোমিটার মতো, আসলে শেষ ভাদ্রের চড়া রোদ আর মেঘ মুক্ত নীল আকাশ একটু কম দূরত্বের কথা বলছিল।

সরস্বতী নদী কুন্তি নদীর ওপরের ব্রীজ পেরিয়ে গ্রামে রাস্তা,  মাটির বাড়ির নিকোন উঠোন,  সবুজ ধান খেত পেরিয়ে পৌঁছলাম মেরিয়া তে।

একটা তিনমাথা মোড় একটা দিক চলে গেছে রথতলা , একদিক ঝাঁপান তলা আর একদিক মগরার দিকে। আর তিন মাথার মোড়ে রয়েছে বেশ প্রাচীন এক কালী মন্দির।




ম্যাপ বলছে পালিত বাড়ি রথ তলার রাস্তায়, কিন্তু তিন মাথার মোড়ের সেই প্রাচীন মন্দিরে কিছুটা সময় কাটাতে মন চাইল। একবারে বৈচিত্র্য হীন এক কালী মন্দির, কিন্তু ভিতরের বিগ্রহ টি বেশ বড় আর সুন্দর ও। আলাপ হলো অমরনাথ চ্যাটার্জী র সাথে। সাদা কোঁচকানো চুল,  খালি গা, আর ধুতি পড়া পুরোহিত মহাশয়।

কথায় কথায় উনি যে কখন আকর্ষণ এর কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠছেন বুঝতে পারিনি।

ভদ্রকালী মন্দিরের ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি শুধু এই মন্দিরের প্রাচীনতা নিয়েই কথা বলেন আসলে গ্রাম বাংলা জুড়ে এমন বহু মন্দির রয়েছে যার সাল দিনক্ষণ বলা যায়না কিন্তু মন্দির গুলির প্রাচীনতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকেনা।

কথায় কথায় এই গ্রামের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে তিনি দুটো প্রচলিত কাহিনীর কথা বললেন।



ইংরেজ আমলে আলেকজান্ডার ডাফ শিক্ষা বিস্তার এর উদ্দেশ্যে এই গ্রামে এসেছিলেন সেই সূত্রে মাতা মেরীর নাম থেকে এই গ্রামের নাম মেরিয়া, তবে এই কাহিনী সেই ভাবে মন টানে নি। কিন্তু এর পরের কাহিনীটি বেস সুন্দর। এই গ্রামের প্রাচীন পূজিত দেবী ছিলেন দেবী মিরানি। আগে একটি মন্দির ও ছিল, কিন্তু সে মন্দির কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও সেই মিরাণি দেবী র নাম অনুসারে এই এই গ্রামের নাম মেরিয়া। কথায় কথায় জানা গেল এই ছোট্ট গ্রামের কিছু টুকরো ইতিহাস আর কিছু পুরানো মন্দিরের কথা। এই গ্রামে প্রাচীন বাসিন্দা বলতে চারটে পরিবারের কথা তিনি বললেন,  অদ্ভুত ভাবে বাকি সব পরিবারই নাকি বাইরে থেকে এসে এই গ্রামে বসতি করেছে। যেমন এই গ্রামের একসময় এর জমিদার পালিতরা 



তারাও চন্দননগর এর আদি বাসিন্দা, পালিত বংশের বংশধর শ্রী গঙ্গাচরণ পালিত মহাশয় এই গ্রামে আসেন এবং তার জমিদারি স্থাপন করেন।

অমরনাথ বাবু কে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম পালিত বাড়ির দিকে। রাস্তার বাক নিয়ে বুড়ো শিবের মন্দির আর পুকুর ঘাট পেরিয়ে চোখ আটকালো একটা মন্দিরের চূড়ায়। মন্দিরের চুড়া টি সুউচ্চ আর আকর্ষণীয় বটে,  কিন্তু সামনের দরজা টা বন্ধ। একটু ইতস্ততঃ করে পাশের দরজা দিয়ে আলো আধারি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটি ঠাকুর দালান। জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালান গুলি যেমন হয় এও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবে কালের বলিরাখার ছাপ পড়েছে তাতে। হ্যাঁ আমরা এসে পড়েছি পালিত বাড়িতে।

বাড়িটাতে একটু চোখ বোলালেই বোঝা যাবে অতীতের জৌলুস আজ অস্তমিত। ভেঙে পড়া ঝুল বারান্দা কিনবা পলেস্তারা খসা কার্নিশ থেকে পায়রার উকি সে কথাই বলছে।

আমাদের দেখে ঠাকুর দালান ঝাঁটা দেওয়া থামিয়ে এগিয়ে এলো একটি মেয়ে। বয়স ২৪ এর আশেপাশে। শুএষা,  এই পালিত বাড়ির মেয়ে।  আমাদের উদ্দেশ্য ও কথা শুনে নিজে দায়িত্ব নিয়ে ঘুরিয়ে দেখতা লাগল তাদের বাড়ি আর বাড়ি লাগয়া পাশের মন্দির।

এই পালিত বংশ মেরিয়া গ্রামের আদি বাসিন্দা নয় সে কথা বলেছি। চন্দননগর থেকে গঙ্গাচরণ পালিত মহাশয় এই গ্রামে এসে জমিদারি স্থাপন করেন। আর নির্মাণ করেন এই বাড়ি ও মন্দিরের। মন্দিরের উপরে ফলকে মন্দির নির্মাণের কথা লেখা রয়েছে।“ ত্রিজগজ্জননী শ্রী শ্রী পতিত পাবণী শ্রীচরণ ধ্যান পরবস শ্রী গঙ্গাচরণ পালিত  দাসেন কৃতস্বজং দেবালয়ং ” ।





মন্দির টি স্থাপত্য রীতির দিক থেকে অভিনব। এই জেলায় যে ধরনের মন্দির রীতি দেখা যায় এটা তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । ত্রিখিলান যুক্ত মন্দিররের অলিন্দ অংশ তিনটি চূড়া বিশিষ্ট, কিন্তু গর্ত গৃহ টিতে রয়েছে সমতল ছাদ।

গর্ত গৃহে অধিষ্ঠিত দেবী পতিত পাবনী। দেবী পতিত পাবনী দেবী দূর্গা র ই রূপ। একটি অষ্ট ধাতু র দূর্গা মুর্তি। শেওড়াফুলি রাজবাড়ি র দেবী সর্বমঙ্গলার সাথে এই মূর্তির অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়।

মন্দিরের সামনের অংশে প্রসস্থ নাটদালান। তবে সবকিছুতেই জীর্ণতার ছাপ স্পষ্ট।

মন্দির দেখা শেষে যখন আবার পালিত বাড়ির ঠাকুর দালানে এলাম সেই সময় আরও কয়েক জন সদস্য এসে উপস্থিত হয়েছেন, তবে সকলেই বাড়ির মহিলা। কোন সময় এনাদের বংশের মহিলারা হয়ত অনন্তপুর বাসিনী ছিলেন। কালের সাথে নিয়ম গুলো ও বদলেছে। যেমন বদল এসেছে পালিত বাড়ির পুজো তে।

আগে এই বাড়ির পুজো তে বলি প্রথা থাকলেও এখন আর বলি হয়না। আগে দেবী পতিত পাবনীর মূর্তি ঠাকুর দালানে আনা হত এবং মাটির তৈরি কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী দিয়ে পুরো পরিবার পুজো হত। কিন্তু কয়েক বছর বাধা পড়ায় বর্তমানে পুজো বোধন থেকে বিসর্জন অষ্ট ধাতুর পতীতপাবণী দেবীর পুজা নিষ্ঠা সহকারে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পালন করে চলেছে মেরিয়া গ্রামের পালিত পরিবার।

দেবী পতিত পাবনী 

আলাপ পরিচয় গল্প গুজব শেষে এবার ফেরার পালা, ওনারা আগাম পুজোর নিমন্ত্রণ জানালেন। এবার ফেরার পালাফিরতি পথে দেখি অমরনাথ বাবু মন্দিরের দাওয়া তে তখনও বসে। ওনাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এলাম।

ফিরতি পথে কিছুটা ইচ্ছে করে ভুল রাস্তা ধরে লাল মাটির রাস্তা নদীর ভাঙা সাকো পেরিয়ে যখন দিল্লী রোডে উঠলাম ঘড়ির কাটা বলছে আবারও দেরী হয়ে গেছে।

আসলে উদ্দেশ্য বিহীন ঘুরে বেড়ানো তে সময়ে র হিসাব রাখা যে মানা। কাজেই দেরী বলে কিছু নেই।

সুমন্ত বড়াল ...

Saturday, 25 July 2020


       মন সারাতে পায়ে পায়ে বৈদ্যপুর


এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে ইদানিং জীবনযাপন এখন খবর মানে আক্রান্ত লাশেদের পরিসংখ্যান অতিমারীরর এই সময়ে মন মস্তিষ্ক স্বভাবতই ভারাক্রান্ত কিন্তু বাঁচতে হবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে তাই মনটাকে ভালো রাখতে হবে আর মনকে ভালো রাখতে মনের খোরাক এর ভীষন   প্রয়োজন দীর্ঘ কডাউন এর সময় কাটিয়ে এখন আমরা আনলক পিরিয়ডে একদিকে বাড়তে থাকা অতিমারীরর পরিস্থিতি আর অন্যদিকে প্রতিনিয়ত জীবনটাকে স্বাভাবিক ছন্দে আনার প্রচেষ্টা এই দুইয়ে মিলে আমাদের নিউ নরমাল লাইফ তাই মনের খোরাক খুঁজতে একটু বেরিয়ে পড়তেই হয় হোক চেনা রাস্তা হোক চেনা মানুষজন তবু বেরিয়ে পড়া অন্যরকম স্বাদের আশায় তাই বেরিয়ে পড়লাম ভরসা নিজের গ্লামার বাইক  টা পরিস্থিতি যেমন হোক না কেন সঙ্গী ঠিকই জুটে যায়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না এবারের গন্তব্য আমার জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে অন্য এক জেলায় সময় যখন রোগমুক্তির উপায় খুঁজছে তখন গন্তব্য যদি হয় বৈদ্যপুরে না বর্তমানে এই বৈদ্যপুরে শুধু যে ডাক্তার বদ্দি দেরই বাস তা একেবারেই না হয়তো কোন এক সময় এই বৈদ্যপুরে বহু বৈদ্য থাকতেন তবে সেকথা ইতিহাসে জানা যায় না ইতিহাসে জানা যায় প্রাচীন জোড়দেউল , বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির, রাজবাড়ি, পুজোবাড়ি, নন্দী বংশের কথা এক কথায় ইতিহাস স্থাপত্য এর মেলবন্ধন ইতিহাস এর টানেই মনের খোরাক জুটে যায় তাই পৌঁছে গেলাম বৈদ্যপুরে
পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার ছোট্ট মফস্বল  বৈদ্যপুর হাওড়া বর্ধমান মেল শাখার বৈচি স্টেশন থেকে কিংবা হাওড়া কাটোয়া শাখার কালনা থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় বৈদ্যপুরে ছোট এই মফস্বলে জাঁকজমক যা কিছুই সবই হয়েছে অতীতের এই অঞ্চলের জমিদার নন্দীদের আনুকূল্যে সবুজে ঘেরা রাস্তা, ডি ভি সি লকগেট পেরিয়ে অলিগলি ঘুরে বৈদ্যপুরের রাতলায় পৌঁছলেই চোখ আটকাবে এক ঐতিহাসিক সৌধে

জোড়দেউল




ঠিক পঞ্চায়েত অফিসের উল্টোদিকে সবুজ ঘেরা মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এক প্রাচীন দেউল তবে দেউলটি জোড়া বর্তমানে ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ অধিকৃত দেউল টি জোড়দেউল নামে খ্যাত বড়টির উচ্চতা ৩০ ফুট আর ছোটটির প্রায় ২০ ফুট এই দেউলের ভিতর কোনো বিগ্রহ নেই পূর্ব দিকের দরজা দিয়ে দেউল এর ভিতর ঢুকলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় আধ অন্ধকার পরিবেশ র ওপর দিকে তাকালে ভিতর থেকে দেখা শিখরের উচ্চতা কোথায় যেন আলো আধারীতে মিশে গেছে বাইরের তাপমাত্রার সাথে ভিতরের তাপমাত্রার বেশ কিছুটা ফারাক এই দেউলের ভিতরেই আলাপ হলো মদন বাবুর সাথে এক প্রান্তিক মানুষ তিনি জানালেন তিনি এই দেউলের ভিতরেই থাকেন দেউলের বাইরে বেরিয়ে চোখ আটকে যায় দেউলটির গঠনশৈলী এখনো থেকে যাওয়া কিছু টেরাকোটা কাজে বিশেষজ্ঞদের মতে এটি পালযুগের দেউল তবে ডেভিড ম্যাক্কাচন এই দেউল পরিদর্শন করেছিলেন, তিনি এই দেউল টিকে ষোড়শ শতাব্দীর দেউল বলে মত দিয়েছেন  তবে কারো মতে এই দেউল ছিল কৃষ্ণের মন্দির আবার কারো মতে বৌদ্ধ মন্দির প্রাচীনতা আর ইতিহাস নিয়ে বৈদ্যপুরের খুব জমজমাট একটি জায়গায় দেউলটি আজও স্বমহিমায় বিরাজ করছে কিন্তু দেউলের আশপাশের পরিবেশ দেউল টির ঐতিহ্য দর্শনের ক্ষেত্রে বেঘাত ঘটায় কিছুটা খামতি নিয়েই দেউলের কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম হাত পথে কয়েক পা গেলেই চোখে পড়বে বৈদ্যপুরের আরেক আকর্ষণ, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির রাসমঞ্চ
বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির রামঞ্চ


রাসমঞ্চটির কাছে গিয়ে দেখা গেল তার গেটে তালা এবং গেট আশপাশ জুড়ে আগাছায় ভরা অগত্যা  বাইরে থেকে দেখেই খুশি হতে হলো স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে জানা গেল রাসে সময় এই জায়গাটি সুন্দর করে সাজানো পরিস্কার করা হয় তবে গেটের বাইরে থেকেই এই মঞ্চটির বিশালতা কারুকাজ সৌন্দর্য চোখে পড়ে যা বেশ মনোমুগ্ধকর রাসমঞ্চ থেকে ডানদিকে চোখ ঘোড়ালেই চোখে পড়ে এক নবরত্ন মন্দিরের চূড়া মন্দিরের রঙটা খুব একটা দৃষ্টিসুখ দেয় না প্রাচীন নবরত্ন মন্দির যার রঙ নীল সে রং কিছুটা বিবর্ণ দূর থেকেই এই মন্দির টির রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবটি চোখে পড়ছে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপি থেকে জানা যায় শিশুরাম নন্দী বাংলা ১২৫২, ইংরেজি ১৮৪৫ সালে এই মন্দির নির্মাণ করে প্রাচীনতার দিক থেকে এই মন্দির সত্যিই অন্যতম 


মন্দিরের প্রবেশপথে রয়েছে বিশাল এক দরজা দোলমঞ্চ , রাসমঞ্চ, নবরত্ন মন্দির সব মিলিয়ে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির চত্বর বেশ জমজমাট রাসলা  থেকে যখন পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছি তখন সূর্য দেব মধ্য গগনে মেঘ আর রোদের খেলায় পরিবেশ বেশ গুমোট তাই স্বাস্থ্য বিধির তোয়াক্কা না করে ঠান্ডা পানীয়তে গলা ভিজিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম যাত্রা পথে চোখে পড়লো এক সুউচ্চ নোহবৎখানা আর ঠিক তার উল্টো দিকে বিশাল এক ঠাকুরদালান সম্বলিত একটি বাড়ির ফেরার পথে সেখানে এসব এটা মাথায় রেখে এগিয়ে গেলাম গাড়ি থামলো নন্দীদের প্রাসাদসম বাড়ির দরজায় যার উল্টো দিকে রয়েছে দুটি ভগ্নপ্রায় শিব মন্দির, একটি আটচালা একটি নবরত্ন স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, নন্দী বংশের জয়দেব নন্দী তার মায়ের স্মৃতিতে এই মন্দির নির্মাণ করেন ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মিত হয় তবে বর্তমানে মন্দিরটি জরাজীর্ণ নন্দীদের প্রাসাদসম অট্টালিকার দরজায় তো পৌঁছে যাওয়া গিয়েছিল কিন্তু তার দরজায় বড়ো বড়ো তালা ঝুলছে, তাই কিছুটা নিরাশ হতেই হলো ছোট্ট কুঠুরি দিয়ে উকি মরলে বাড়ি টির বিশালতা চোখে পরেতবে এটাও  



বোঝা যায় যে এই বাড়িতে মানুষের পা পড়েনি অনেকদিন তাই এই বাড়ি আগাছায় পরিপূর্ণ তবে এই বাড়ির বাইরের দিকে অংশের দেয়াল ধরে একটি টেরাকোটা কাজ সম্বলিত আটচালা শিব মন্দির রয়েছে, মন্দিরটির অবস্থান, মন্দিরটির প্রাচীনতা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে মন্দিরের গায়ে অবশিষ্ট টেরাকোটার কাজ মন ভালো করে দেয় এবার বৈদ্যপুরকে বিদায় জানবার পালা, কারণ বৈদ্যপুর থেকে যেতে হবে আরেক গন্তব্যে

পুজোবাড়ি


ফেরার পথে থামলাম সেই সুউচ্চ নোহবৎখানা আর তার উল্টোদিকে সেই বাড়িটির সামনে বাড়ির বিশাল চৌকাঠ আর দরজা পেরোতেই মনের মধ্যে বুদবুদের মতো হতে থাকে হতাশাটা  উবে গেল আলো আধারির পথ পেরিয়ে যেখানে প্রবেশ করলাম সেটা এক বিশাল ঠাকুরদালান চারিদিকে বারান্দা ঘেরা একটি বাড়ি আর বারান্দায় রয়েছে নানান ধরণের কাঠামো সিঁড়ি ভাঙতেই চোখে পড়বে দুর্গাবেদী আর দুর্গা কাঠামো বাড়িটির বিশালতা, বাড়িটির গাম্ভীর্য এবং বাড়িটির নৈশব্দ মুগ্ধ করছিল একের পর এক ক্যামেরায় ক্লিক করছিলাম, আসলে সুখ স্মৃতিকে ধরে রাখার কৌশল আর কি আলাপ হলো ধীরেন চক্রবর্তী মহাশয়ের সাথে, অমায়িক মানুষ তিনি জানালেন এই বাড়ি প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি পুজোবাড়ি নামে পরিচিত দোল, দুর্গোৎসব, রা, রথ, কালিপুজো, বার মাসে টের পার্বনই এই বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় জমিদার নৃসিংহচরণ নন্দী চৌধুরী এই বাড়ি নির্মাণ করে শুধু মাত্র পুজো অর্চনার জন্য বিস্ময় জাগে এই এত্ত বড়ো একটি বাড়ি শুধু পূজা অর্চনার জন্য নির্মিত বাড়িতে কোনো জনবসতি নেই পুজোর জন্য এই বাড়ি ব্যাবহার করা হয় 



সাড়ে তিনশো বছর ধরে চলা রীতি যা আজও অক্ষুন্ন বাড়িটি এত পুরোনো হলেও খুব সুন্দর খুব সুচারু ভাবে এর দেখভাল করা হয়, তাই বোধ হয় বাড়িটির একটি অংশকেও মলিনতা স্পর্শ করতে পারেনি ধীরেন বাবু জানালেন এই বাড়িতেই রয়েছে নন্দীদের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর ধীরেন চক্রবর্তী এই মুহূর্তে এই বংশের কুলপুরোহিত তিনি খুব যত্ন করে আমাদের মন্দিরে নিয়ে গেলেন এবং রাজরাজেশ্বর শিলাটি দর্শন করালেন তখন ভোগ আরতির সময় ধীরেন বাবুকে বিদায় জানিয়ে যখন ফিরছি চোখে পড়লো নন্দী বাড়ির প্রবেশপথে বিশাল এক ঘন্টার দিকে যা যাবার সময়েও চোখে পড়েছিল, ধীরেন বাবু জানালেন এই ঘন্টা টি সম্প্রতি লাগানো


পুজোবাড়ি থেকে যখন বেড়ালাম তখন দুপুরবেলা, কাজেই রাস্তাঘাট পুরোপুরী ফাঁকা দোকান পাট ও  বন্ধ সকালের জল খাবারের মেয়াদ ফুরিয়েছে সে কথা জানান দিচ্ছে খিদে খিদে ভাব সঙ্গে থাকা শিঙাপুরী কলা দিয়ে সেই মুহূর্তের খিদে মেটানো হলো, মেটাতেই হতো কারণ আগেই বলেছি আরেক গন্তব্যে যেতে হবে সে গন্তব্য খুব কাছেই, প্রাচীন রাখাল রাজা তলা কাজেই আবার বেরিয়ে পড়া আর সেই একই রাতলার রাস্তা ধরে ফিরতে ফিরতে বিদায় জানানো, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির, জোড়দেউল আর বৈদ্যপুরকে যা তখন স্মৃতির হার্ডডিস্ক পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...