পুনঃজীবন
পাওয়া একটি সৌধের গল্প
সুমন্ত
বড়াল
একটা সৌধ কে ঘিরে কত রকম ইতিহাস থাকতে পারে? কত রকম ই বা বৈচিত্র্য থাকতে পারে? এই বৈচিত্রে ভরা ঐতিহাসিক সৌধ টিকে
দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে শহর শ্রীরামপুর এর হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কের প্রাঙ্গণে।
যার স্থানীয় নাম জলকল। ঝোপঝাড়ে ঢাকা এই অঞ্চলে মাথা উচুঁ করে রয়েছে ষষ্ঠ দশ
শতকের এক সৌধ। সরকারি হিসাবে এর নাম " হেনরী ম্যার্টিন প্যাগোডা " আর
স্থানীয় দের কাছে জলকল মাঠের ভাঙা মন্দির যা কিনা শ্রীরামপুর শহরের প্রাচীন
রাধাবল্লভ জীঊর প্রাচীন মন্দির।
আর এই খানেই সৌধ টির বিশেষত্ব।
এই সৌধের ইতিহাস জানতে আমাদের ফিরে যেতে
হবে ষোড়শ শতকে। ততকালীন সময়ে জনৈক বৈষ্ণব সাধক রুদ্র রাম পন্ডিত স্বপ্ন আদেশ পেয়ে , গৌড় এর রাজপ্রাসাদ থেকে বাদশাহ এর
হিন্দু প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় একটি শীলা খন্ড আকনা গ্রামে নিয়ে আসেন এবং পুজা
শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি এই শিলা খন্ড থেকে বিন্দাবনের
শিল্পের দের দিয়ে রাধাবল্লভ জীউর বিগ্রহ নির্মাণ করেন , এবং ১৫৭৭ খ্রীষ্টাব্দে ভক্তদের সহায়তায় একটি
আটচালা মন্দির নির্মাণ করেন। সেই থেকে অকনা গ্রামের নাম হয় বল্লভপুর।
স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী ১৫৭৭ সালে নির্মিত সেই আটচালাই এই সৌধটি।
ষোড়শ শতকে চালা স্থাপত্যের মন্দির কি ধরণের হত
তা এই সৌধ টিকে দেখলে বোঝা যায়। পোড়ামাটির পদ্ম, কল্পলতার কাজ এই মন্দিরে শোভা পেত।
কিন্তু ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মন্দির এর কিছু অংশ
ভেঙ্গে পড়লে ,
রাধাবল্লভ জিঊ বিগ্রহ নতুন মন্দিরে স্থানান্তরিত
করা হয়। অতপর এই বিশাল পরিত্যক্ত ভগ্ন
মন্দির টিকে রেভারেন্ড ডেভিড ব্রাউন ক্রয় করেন এবং স্থানীয় পাদরী হেনরী মার্টিন
১৮০৬ থেকে অবস্থান করেন। তিনি এই মন্দির কে গির্জায় রুপান্তর করেন কিন্তু এর
পরবর্তী সময় আশে পাশে অনেক গুলি গির্জা নির্মিত হওয়ায় এই স্থানের গির্জা
স্থানান্তরিত হয়। আর এই সৌধটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে। পরিত্যক্ত এই সৌধ তে
একসময় মদ তৈরী করা শুরু হয় যে মদ "
প্যাগোডা রাম " নামে খ্যাত ছিল। এই সকল ঘটনা সবই। শতাব্দী প্রাচীন।
তবে এই
মন্দির ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পুরাতত্ত্ব আইনে সংরক্ষিত বলে চিহ্নিত
এবং সেখানে লেখা
" This building
was occupied by the Missionary Henry Martyn ,
1806 "।
প্রায় পাঁচশো বছরের কাছাকাছি এই প্রাচীন সৌধটি
বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে ছিল। এই সৌধ টিকে ঘিরে এতটাই ঘন জঙ্গল আর
ঝোপঝাড় হয়েছিল যে দিনের বেলায় মানুষ জন এই যায়গায় যেতে পারতো না। গঙ্গা তীরে এই
সৌধ স্থানীয় মানুষ দের কাছে ভাঙা মন্দির হিসাবে পরিচিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই
মন্দিরের রূপ সম্পুর্ণ বদলে গেছে। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে মন্দির টিকে সম্পুর্ণ রুপে
সংষ্কার করা হচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর উদ্যোগে এই মন্দিরের
সংষ্কার শুরু হয়। আর ২০২০ তে যা সম্পূর্ণ হয়েছে।
এই সময় দাড়িয়ে এই প্রাচীন সৌধ টি তার সমস্ত
ইতিহাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে দর্শকের জন্য। এই সৌধের প্রতিটি কোণ থেকে যেন ইতিহাস গল্প
বলে চলেছে।
আর এক পরিত্যক্ত ভগ্নপ্রায় সৌধকে পুনঃজীবন দেওয়ায়
জন্য পশ্চিম বঙ্গ সরকার এর কাছে আমরা সকল শ্রীরামপুর তথা পশ্চিমবঙ্গ বাসী কৃতজ্ঞ ।।
No comments:
Post a Comment