মন সারাতে পায়ে পায়ে বৈদ্যপুর
এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে ইদানিং জীবনযাপন। এখন খবর মানে আক্রান্ত র লাশেদের পরিসংখ্যান। অতিমারীরর এই সময়ে মন মস্তিষ্ক স্বভাবতই ভারাক্রান্ত কিন্তু বাঁচতে হবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে তাই মনটাকে ভালো রাখতে হবে। আর মনকে ভালো রাখতে মনের খোরাক এর ভীষন প্রয়োজন। দীর্ঘ লকডাউন এর সময় কাটিয়ে এখন আমরা আনলক পিরিয়ডে। একদিকে বাড়তে থাকা অতিমারীরর পরিস্থিতি আর অন্যদিকে প্রতিনিয়ত জীবনটাকে স্বাভাবিক ছন্দে আনার প্রচেষ্টা। এই দুইয়ে মিলে আমাদের নিউ নরমাল লাইফ। তাই মনের খোরাক খুঁজতে একটু বেরিয়ে পড়তেই হয়। হোক চেনা রাস্তা হোক চেনা মানুষজন। তবু বেরিয়ে পড়া অন্যরকম স্বাদের আশায়। তাই বেরিয়ে পড়লাম । ভরসা নিজের গ্লামার বাইক টা। পরিস্থিতি যেমন হোক না কেন সঙ্গী ঠিকই জুটে যায়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। এবারের গন্তব্য আমার জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে অন্য এক জেলায়। সময় যখন রোগমুক্তির উপায় খুঁজছে তখন গন্তব্য যদি হয় বৈদ্যপুরে। না বর্তমানে এই বৈদ্যপুরে শুধু যে ডাক্তার বদ্দি দেরই বাস তা একেবারেই না । হয়তো কোন এক সময় এই বৈদ্যপুরে বহু বৈদ্য থাকতেন তবে সেকথা ইতিহাসে জানা যায় না। ইতিহাসে জানা যায় প্রাচীন জোড়দেউল , বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির, রাজবাড়ি, পুজোবাড়ি, নন্দী বংশের কথা। এক কথায় ইতিহাস স্থাপত্য এর মেলবন্ধন। ইতিহাস এর টানেই মনের খোরাক জুটে যায়। তাই পৌঁছে গেলাম বৈদ্যপুরে।
পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার ছোট্ট মফস্বল
বৈদ্যপুর। হাওড়া বর্ধমান মেল শাখার বৈচি স্টেশন থেকে কিংবা হাওড়া কাটোয়া শাখার কালনা থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় বৈদ্যপুরে। ছোট এই মফস্বলে জাঁকজমক যা কিছুই সবই হয়েছে অতীতের এই অঞ্চলের জমিদার নন্দীদের আনুকূল্যে। সবুজে ঘেরা রাস্তা, ডি ভি সি র লকগেট পেরিয়ে অলিগলি ঘুরে বৈদ্যপুরের রাসতলায় পৌঁছলেই চোখ আটকাবে এক ঐতিহাসিক সৌধে।
জোড়দেউল
ঠিক পঞ্চায়েত
অফিসের উল্টোদিকে সবুজ ঘেরা মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এক প্রাচীন দেউল। তবে দেউলটি জোড়া। বর্তমানে ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ অধিকৃত
দেউল টি জোড়দেউল নামে খ্যাত। বড়টির উচ্চতা ৩০ ফুট আর ছোটটির প্রায় ২০ ফুট। এই দেউলের ভিতর কোনো বিগ্রহ নেই। পূর্ব দিকের দরজা দিয়ে দেউল এর ভিতর ঢুকলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আধ অন্ধকার পরিবেশ র ওপর দিকে তাকালে ভিতর থেকে
দেখা শিখরের উচ্চতা কোথায় যেন আলো আধারীতে মিশে গেছে। বাইরের তাপমাত্রার সাথে ভিতরের তাপমাত্রার বেশ
কিছুটা ফারাক। এই দেউলের ভিতরেই
আলাপ হলো মদন বাবুর সাথে এক প্রান্তিক মানুষ। তিনি জানালেন তিনি এই দেউলের ভিতরেই থাকেন। দেউলের বাইরে বেরিয়ে চোখ আটকে যায় দেউলটির গঠনশৈলী ও এখনো থেকে যাওয়া কিছু টেরাকোটা কাজে। বিশেষজ্ঞদের মতে এটি পালযুগের দেউল। তবে ডেভিড ম্যাক্কাচন এই দেউল পরিদর্শন করেছিলেন, তিনি এই দেউল টিকে ষোড়শ শতাব্দীর দেউল বলে মত দিয়েছেন। তবে কারো মতে এই দেউল ছিল কৃষ্ণের মন্দির আবার কারো মতে বৌদ্ধ মন্দির। প্রাচীনতা আর ইতিহাস নিয়ে বৈদ্যপুরের খুব জমজমাট একটি জায়গায় দেউলটি আজও স্বমহিমায় বিরাজ করছে। কিন্তু দেউলের আশপাশের পরিবেশ দেউল টির ঐতিহ্য ও দর্শনের ক্ষেত্রে বেঘাত ঘটায়। কিছুটা খামতি নিয়েই দেউলের কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। হাত পথে কয়েক পা গেলেই চোখে পড়বে বৈদ্যপুরের আরেক আকর্ষণ, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির ও রাসমঞ্চ।
বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির ও রাসমঞ্চ
রাসমঞ্চটির কাছে গিয়ে দেখা গেল তার গেটে তালা এবং গেট ও আশপাশ জুড়ে আগাছায় ভরা। অগত্যা বাইরে থেকে দেখেই খুশি হতে হলো। স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে জানা গেল রাসের সময় এই জায়গাটি সুন্দর করে সাজানো ও পরিস্কার করা হয়। তবে গেটের বাইরে থেকেই এই মঞ্চটির বিশালতা কারুকাজ ও সৌন্দর্য চোখে পড়ে যা বেশ মনোমুগ্ধকর। রাসমঞ্চ থেকে ডানদিকে চোখ ঘোড়ালেই চোখে পড়ে এক নবরত্ন মন্দিরের চূড়া। মন্দিরের রঙটা খুব একটা দৃষ্টিসুখ দেয় না। প্রাচীন নবরত্ন মন্দির যার রঙ নীল। সে রং ও কিছুটা বিবর্ণ। দূর থেকেই এই মন্দির টির রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবটি চোখে পড়ছে। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপি থেকে জানা যায় শিশুরাম নন্দী বাংলা ১২৫২, ইংরেজি ১৮৪৫ সালে এই মন্দির নির্মাণ করে। প্রাচীনতার দিক থেকে এই মন্দির সত্যিই অন্যতম।
মন্দিরের প্রবেশপথে রয়েছে বিশাল এক দরজা। দোলমঞ্চ , রাসমঞ্চ, নবরত্ন মন্দির সব মিলিয়ে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির চত্বর বেশ জমজমাট। রাসতলা থেকে যখন পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছি তখন সূর্য দেব মধ্য গগনে। মেঘ আর রোদের খেলায় পরিবেশ বেশ গুমোট। তাই স্বাস্থ্য বিধির তোয়াক্কা না করে ঠান্ডা পানীয়তে গলা ভিজিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম। যাত্রা পথে চোখে পড়লো এক সুউচ্চ নোহবৎখানা আর ঠিক তার উল্টো দিকে বিশাল এক ঠাকুরদালান সম্বলিত একটি বাড়ির। ফেরার পথে সেখানে এসব এটা মাথায় রেখে এগিয়ে গেলাম। গাড়ি থামলো নন্দীদের প্রাসাদসম বাড়ির দরজায়। যার উল্টো দিকে রয়েছে দুটি ভগ্নপ্রায় শিব মন্দির, একটি আটচালা ও একটি নবরত্ন। স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, নন্দী বংশের জয়দেব নন্দী তার মায়ের স্মৃতিতে এই মন্দির নির্মাণ করেন। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মিত হয়। তবে বর্তমানে মন্দিরটি জরাজীর্ণ। নন্দীদের প্রাসাদসম অট্টালিকার দরজায় তো পৌঁছে যাওয়া গিয়েছিল কিন্তু তার দরজায় বড়ো বড়ো তালা ঝুলছে, তাই কিছুটা নিরাশ হতেই হলো। ছোট্ট কুঠুরি দিয়ে উকি মরলে বাড়ি টির বিশালতা চোখে পরে। তবে এটাও
বোঝা যায় যে এই বাড়িতে মানুষের পা পড়েনি অনেকদিন তাই এই বাড়ি আগাছায় পরিপূর্ণ। তবে এই বাড়ির বাইরের দিকে অংশের দেয়াল ধরে একটি টেরাকোটা কাজ সম্বলিত আটচালা শিব মন্দির রয়েছে, মন্দিরটির অবস্থান, মন্দিরটির প্রাচীনতা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মন্দিরের গায়ে অবশিষ্ট টেরাকোটার কাজ মন ভালো করে দেয়। এবার বৈদ্যপুরকে বিদায় জানবার পালা, কারণ বৈদ্যপুর থেকে যেতে হবে আরেক গন্তব্যে।
পুজোবাড়ি
ফেরার পথে থামলাম সেই সুউচ্চ নোহবৎখানা আর তার উল্টোদিকে সেই বাড়িটির সামনে। বাড়ির বিশাল চৌকাঠ আর দরজা পেরোতেই মনের মধ্যে বুদবুদের মতো হতে থাকে হতাশাটা উবে গেল। আলো আধারির পথ পেরিয়ে যেখানে প্রবেশ করলাম সেটা এক বিশাল ঠাকুরদালান। চারিদিকে বারান্দা ঘেরা একটি বাড়ি আর বারান্দায় রয়েছে নানান ধরণের কাঠামো। সিঁড়ি ভাঙতেই চোখে পড়বে দুর্গাবেদী আর দুর্গা কাঠামো। বাড়িটির বিশালতা, বাড়িটির গাম্ভীর্য এবং বাড়িটির নৈশব্দ মুগ্ধ করছিল। একের পর এক ক্যামেরায় ক্লিক করছিলাম, আসলে সুখ স্মৃতিকে ধরে রাখার কৌশল আর কি। আলাপ হলো ধীরেন চক্রবর্তী মহাশয়ের সাথে, অমায়িক মানুষ। তিনি জানালেন এই বাড়ি প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো। স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি পুজোবাড়ি নামে পরিচিত। দোল, দুর্গোৎসব, রাস, রথ, কালিপুজো, বার মাসে টের পার্বনই এই বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। জমিদার নৃসিংহচরণ নন্দী চৌধুরী এই বাড়ি নির্মাণ করে শুধু মাত্র পুজো অর্চনার জন্য। বিস্ময় জাগে এই এত্ত বড়ো একটি বাড়ি শুধু পূজা অর্চনার জন্যই নির্মিত। এ বাড়িতে কোনো জনবসতি নেই। পুজোর জন্য এই বাড়ি ব্যাবহার করা হয়।
সাড়ে তিনশো বছর ধরে চলা রীতি যা আজও অক্ষুন্ন। বাড়িটি এত পুরোনো হলেও খুব সুন্দর ও খুব সুচারু ভাবে এর দেখভাল করা হয়, তাই বোধ হয় বাড়িটির একটি অংশকেও মলিনতা স্পর্শ করতে পারেনি। ধীরেন বাবু জানালেন এই বাড়িতেই রয়েছে নন্দীদের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর। ধীরেন চক্রবর্তী এই মুহূর্তে এই বংশের কুলপুরোহিত। তিনি খুব যত্ন করে আমাদের মন্দিরে নিয়ে গেলেন এবং রাজরাজেশ্বর শিলাটি দর্শন করালেন। তখন ভোগ আরতির সময়। ধীরেন বাবুকে বিদায় জানিয়ে যখন ফিরছি চোখে পড়লো নন্দী বাড়ির প্রবেশপথে বিশাল এক ঘন্টার দিকে যা যাবার সময়েও চোখে পড়েছিল, ধীরেন বাবু জানালেন এই ঘন্টা টি সম্প্রতি লাগানো।
পুজোবাড়ি থেকে যখন বেড়ালাম তখন দুপুরবেলা, কাজেই রাস্তাঘাট পুরোপুরী ফাঁকা দোকান পাট ও বন্ধ। সকালের জল খাবারের মেয়াদ ফুরিয়েছে সে কথা জানান দিচ্ছে খিদে খিদে ভাব। সঙ্গে থাকা শিঙাপুরী কলা দিয়ে সেই মুহূর্তের খিদে মেটানো হলো, মেটাতেই হতো কারণ আগেই বলেছি আরেক গন্তব্যে যেতে হবে। সে গন্তব্য খুব কাছেই, প্রাচীন রাখাল রাজা তলা। কাজেই আবার বেরিয়ে পড়া আর সেই একই রাসতলার রাস্তা ধরে ফিরতে ফিরতে বিদায় জানানো, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির, জোড়দেউল আর বৈদ্যপুরকে যা তখন স্মৃতির হার্ডডিস্ক এ পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে।