গুপ্তিপাড়ায় “রস” যাত্রা
শীতকাল মানেই লেপ কম্বলের উষ্ণ পরস , আর কুয়াশার শীতল হাতছানি। আসলে শীত মানেই এক আদুরে মরশুম , উজ্জাপনের মরশুম , বোহেমিয়ান হওয়ার উৎসব। আর শুধু আবহাওয়া আর ঘোরাঘুরি নয় শীত মানেই খাওয়া – দাওয়া ; নতুন সব্জি , নতুন পদ , অবশ্যই শীতের স্পেশালিটি নলেন গুড় আর খেজুর রস। খেজুর রস এই মরশুমের প্রকৃতির এক অমুল্য দান। কিন্তু শহরে মানুষের এর স্বাদ পাওয়া বেশ কষ্ট সাধ্য , স্বাদ পেলেও তাতে ভেজালের আধিক্য থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাদ চেখে না দেখলে মরশুমটাই কেমন জানি বৃথা। আর লকডাউনের সরণী পেরিয়ে মানুষ যখন বাহির মুখী, রোগ বালাইয়ের চোখ রাঙানি ভুলে মনের আনন্দে বেরিয়ে পড়েছে তখনই এই পিকনিকের মরশুম। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই মরশুমি ফসলের জন্য মন আনচান করা শুরু।
কোন এক সকালে খেজুর রস চোখে দেখা , আর রস থেকে গুড় তৈরি চাক্ষুষ করা এই হল মনের বায়েনাক্কা। কিন্তু আশেপাশে কোথাও খোঁজ মিলছে না। আর যেখানে খোঁজ মিলছে দুরত্বের কারণে বার বার বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি আর মন চাইছে গাছি দের সাথে আড্ডা দিতে দিতে রস থেকে গুড় তৈরির সেই দারুণ দৃশ্য চাক্ষুষ করা। কিছুতেই যখন কোন উপায় হচ্ছে না, তখন মুশকিল আসান হয়ে হাজির হলেন সেই সিধু কাকা। হ্যাঁ ফেলুদার সেই সিধু জ্যাঠার মত আমারও সিধু কাকা আছেন। এনার কথা ছোট করে বলে নি , সিধু কাকু অর্থাৎ সুব্রত মণ্ডল নিবাস গুপ্তিপাড়া, আগের বিভিন্ন লেখায় এনার কথা এসছে। প্রানশক্তিতে ভরপুর একজন দারুণ মানুষ , আর গুপ্তিপাড়ার ভীষণ চেনা মুখ । এনার দৌলতে গুপ্তিপাড়া আমার কাছে পড়শী মফস্বল। মনের চাহিদা মেটাতে বার বার ছুটে যাই , যা পাই তাতে মন ভরে যায় ; এক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হলনা। সিধুকাকু কে এই খেজুর রস এর ইচ্ছেটা জানাতেই তিনি বললেন চিন্তা নেই চলে এসো হয়ে যাবে। এইভাবে ভরসা কাকুই দিতে পারেন, সে ভরসা বাণী পেয়ে মনও শান্ত , এবার অপেক্ষা আর একটু জমিয়ে শীত আর শুভদিনের ।
অবশেষে সেই দিন এসে পড়লো মঙ্গলবার ২৯ /১২/২০২০ , কাকুর নির্দেশ সকাল ৭ : ৩০ টার মধ্যে গুপ্তিপাড়া। বাড়ি থেকে দূরত্ব কমবেশি ৬২ কিমি। ট্রেনে যাওয়া যেতেই পারে কিন্তু ভোরের হাইওয়ে তে আমার প্রিয় আসাম রোড , তার ওপর আসাম রোড লাগোয়া জনপদ গুলো সদ্য সকালে ঠিক কেমন লাগে তা দেখার লভ কি ছাড়া যায়। কাজেই ভরসা আমার বাহন যান। ভোর পাঁচটা পনেরো তে যখন রওনা হলাম আমার শহর এর তখন শীতের ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভাঙার আগে এপাশ ওপাশ বলা যেতে পারে। হাইওয়ে ধরতেই দেখা হল ভীষণ প্রিয় কুয়াশার সাথে।
মাঠ পাড় হয়ে সেও রাস্তায়, শীতও জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। ইচ্ছে বলছে দাড়িয়ে পড়ি কারণ চারিদিক টা যেন ছবি। আর এই চারপাশ যেন আমায় হাতছানি দিচ্ছে লেন্স বন্দী করার জন্য। কিন্তু সময়ে পৌছতে হবে অভীষ্ট লক্ষ্যে তাই না থেমে এগিয়ে যাওয়া মিশন খেজুর রস, খেজুর গুড়। বাধ সাধল কুন্তিঘাটে এসে, প্রকৃতির হাতছানি আর উপেক্ষা করা গেল না। গাড়ি থামাতেই হল। কুয়াশা তখন লালচে-হলুদ, সর্ষে ক্ষেতে ঝলমলে শিশির জানাচ্ছে সুপ্রভাত, হিমেল হাওয়া নিয়ে চলেছে দিকশুন্যপুরের দিকে। লেন্স বন্দী করতে শুরু করলাম মুহূর্ত গুলো। ঘোর কাটল ধাতব এক শব্দে, ওভার হেড তারের বিদ্যুৎ প্রবাহের শব্দ। প্রকৃতির মোহ কাটিয়ে আবার রওনা হলাম প্রকৃতির আর এক অপূর্ব সৃষ্টি চাক্ষুষ করতে। কুয়াশার ছাদর মুড়ি দেওয়া জবুথবু আসাম রোড আর ঘুম ভাঙা সূর্য, মন বলছে –
দিগন্ত জুড়ে স্পষ্ট যেখানে কুয়াশা
দৃশ্যমানতা সেখানে ভীষণ রকম ঝাপসা ।।
আসলে খুব ভালো লাগার মধ্যে কোথাও যেন মন কেমন থাকেই।
আগেই বলেছি গুপ্তিপাড়া আমার কাছে কিছুটা দিকশুন্যপুরের মত, পড়শী মফস্বল। সেখানে তাই মন কেমনের জায়গা নেই। বেহুলা মোড় পেরিয়ে গুপ্তিপাড়া আসতেই সব মনকেমন উধাও, বাজার এলাকাতেই নিজের “শ্রী হরি গেস্ট হাউসের” সামনে দাড়িয়ে অপেক্ষারত সিধু কাকু। আমাকে দেখেই এগিয়ে দিলেন এক ভাঁড় গরম চা , আসলে প্রিয়জন রা মনের কথা বোঝে। এবার অভীষ্ট পূরণে বেরিয়ে পড়া। রথের সড়ক ধরে আমরা চলা শুরু করলাম কিছুটা এগোলেই গুপ্তিপাড়ার সেন বাড়ি। অতীতে ঘেরা সেন বাড়ির পিছন দিকটায় আলাপ হল তাপস সর্দার এর সাথে। তাপস বাবু একজন দিউলি , তিনি খেজুর রস থেকে গুড় তৈরি করেন। ছন্দ কাটল এইবার, তাহলে কিএই পুরো জার্নিটাই বৃথা ? কারন তাপস বাবু আজ রস পারেননি , গুড় তৈরি আজ হবেনা। পুকুরের পাশে ফাকা কলসি আর উনুন চোখে পড়ল। উনি জানালেন আজ গাছের “জিরণ” , অর্থাৎ আজ গাছ কেটে রস আনা বন্ধ। আসলে তিনদিন পর পর রস আনার পর গাছ কে রেস্ট দেওয়া হয়।
যাকে বলে “জিরণ” আসলে গাছেরও রেস্টের দরকার, গাছি দের ও রেস্টের দরকার সর্বোপরি এর ফলে খেজুর রসে মিষ্টত্ব ও বাড়ে। যখন দুশ্চিন্তা বাড়ছে বোধহয় এবারও মিস, তখন কাকু আবার ভরসা দিলেন, ভরসার সাথে বললেন আশেপাশে আরও অনেক গাছি আছে। তুমি ওপরের দিকে দেখ। উপরের দিকে তাকাতে সে এক দারুণ ছবি, সারদিয়ে দাড়িয়ে থাকা খেজুর গাছ, সূর্যের আলোয় রস কাটা অংশ গুলো ঝলমল করছে যেন তরল সোনা। আর গাছগুলতে বসে বসন্তবৌরির দল, জারা রসিক জনের মত রস্বাদনে ব্যস্ত। রসের নেশায় মশগুল হয়ে জগত সংসার ভুলেছে তারা।
![]() |
গুড় তৈরি করছেন শিউলি বিন্টু সর্দার |
কথা মত পরের গন্তব্যে পৌঁছলাম আমরা। দূর থেকে চোখে পড়ল জমাট বাধা ধোঁয়া চিরে সূর্যের আলোর ঝলকানি, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অভীষ্ট পুরণ। বিন্টু সর্দার রস জাল দিচ্ছেন অর্থাৎ খেজুর রস থেকে গুড় বানানোর প্রক্রিয়া শুরু। বিন্টু সর্দারকে আগেও দেখেছি রথের সময়ে, তবে শিউলির ভুমিকায় এই প্রথম। তাকে যোগ্য সাথ দিচ্ছে তার কিশোর নাতিটি, সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এক পারিবারিক মেলবন্ধনের ছবি। কথায় কথায় বিন্টু সর্দার জানালেন এই পুরো প্রক্রিয়ার কথা। ঐ যে বলেছিলাম গাছির সাথে আড্ডা। দুপুরে সূর্য ডোবার আগে খেজুর গাছ কেটে হাড়ি বাধা হয়, তারপর সারা রাত রসে ভরে যায় হাড়ি। পরদিন ভোরে সেই হাড়ি গাছ থেকে নামিয়ে এনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা।
![]() |
শ্রী সুব্রত মন্ডল (সিধু কাকু ) র সাথে গাছি আনন্দ বারুই |
মোটামুটি রস গুড় তৈরি হতে সময় লাগে ঘণ্টা দুই। বেশ কষ্ট সাধ্য কাজ, তবে মরশুমি এই কাজের বাজার মন্দ না। বিন্টু বাবু জানালেন গুড় বিক্রি হয়ে যায়, খাঁটি জিনিস বলে কথা। তবে খেজুর গুড় শুধু নয় খেজুর রস কিংবা রস কিছুটা জ্বাল দেবার পরের লাল রস ও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু রস খাওয়াতে না পারার জন্য আক্ষেপ করলেন বিন্টু বাবু। আমাদেরও আফসোস হল কিন্তু আফসোস টা পূরণ হল পরের গন্তব্য কার্তিক বারুইয়ের বাড়িতে। গুপ্তিপাড়া মঠের কাছেই তার বাড়ি আর বাড়িতে চলছে গুড় তৈরির কাজ। তবে এইখানে এসে কিছু অবাক করা ঘটনা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। কার্তিক বাবু গুড় তৈরি বা রস পাড়ার কাজ করেন না। শিউলি বা গাছির কাজ করে তার ছেলে আনন্দ এবং তার স্ত্রী। আনন্দের বয়স চল্লিশের কোটায়। অতিমারী পরিস্থিতি লকডাউন মানুষের জীবনে কি পরিবর্তন এনেছে তার প্রমান আনন্দ। ভিন রাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের কথা আমরা শুনেছি, আনন্দ বারুই তেমনই একজন। করোনা পরিস্থিতি তার কাজ ছিনিয়ে নিয়েছে বটে তবে এখন সে নিজের গ্রামে নিজের বাড়িতে একজন দক্ষ গাছি । পঞ্চাশের ওপর খেজুর গাছের দায়িত্ব তার, ব্যস্ত মানুষ সে, তার ব্যস্ততার প্রমান মেলে আরেক দৃশ্যে, সেও বড় অবাক করা। গোয়ালার বাড়িতে দুধ নিতে যাওয়ার ছবি দেখেছি কিংবা গোয়ালা কে দুধ দিতে যেতে দেখেছি, কিন্তু আনন্দ শিউলির বাড়িতে মানুষ লাইন দিয়ে রস নিতে আসে, সে লোকের বাড়িতে রসের হোম ডেলিভারি দেয়।
বারুই পরিবারের উঠোনে দাড়িয়ে রস থেকে গুড় তৈরি প্রক্রিয়ার প্রথম থেকে দেখার সুযোগ হল। সাথে ইচ্ছে পূরণ, ঠাণ্ডা ঠান্ডা খেজুর রস এল গ্লাস ভর্তি করে। আনন্দ তার সুনিপুণ হাতে তার কাজ শুরু করলে তাকে যোগ্য সাথ দিয়ে চলল তার স্ত্রী তার সংসার সন্তান সামলে , এখানেও সেই মেল্বন্ধন। সবকিছু ক্যামেরা বন্দী হয়ে রইল। বলা ভালো ইচ্ছে পুরণের মুহূর্ত বন্দী। ইচ্ছে পূরণের খুশি নিয়ে এবার ফেরার পালা। কাকুর আতিথিয়তা জলখাবার, আর গুপ্তিপাড়ার স্পেশাল জোড়া সন্দেশ নিয়ে এবার ফেরার রাস্তা ধরা। রেল গেট পেড়িয়ে আবার আসাম রোড ধরতেই দেখি কুয়াশা সরিয়ে ঝলমল করছে রোদ আমার ইচ্ছে পুরণ হওয়া মনের মতো।তবে গুড় তৈরি হল কিন্তু গুড় চেখে দেখা হলনা যে ; সে হবে পরের বার আসলে আবার দিকশুন্যপুরে যাওয়ার বাহানা। সে হবে অন্য গল্প , বছর শেষে শীতের ভোরের গুপ্তিপাড়ার রসযাত্রার গল্প জমজমাট।
সুমন্ত বড়াল ।।
No comments:
Post a Comment