Tuesday, 7 September 2021

কিংবদন্তীর এক সেতু

 

                                  কিংবদন্তীর এক সেতু 

                                                                                         সুমন্ত বড়াল

বেনারসের মাতৃ ঋণ মন্দির এর কথা তো সকলের জানা। মণিকর্ণিকা ঘাটে , গঙ্গা বক্ষে অর্ধেক ডুবে থাকা সেই মন্দির খানা। জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, প্রায় ৫০০ বছর আগে রাজা মান সিংহের মা রত্না বাইয়ের জন্য এক নামহীন ব্যক্তি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি তৈরি করার পরে, সেই ব্যক্তি গর্ব করেছিলেন যে তিনি তার মাতৃঋণ শোধ করেছেন। যেহেতু নিজের মায়ের প্রতি ঋণ কখনও শোধ করা যায় না, তাই মায়ের অভিশাপের কারণে মন্দিরটি হেলতে শুরু করেছিল। একারণে মন্দিরটি মাতৃঋণ মন্দির নামেও পরিচিত এই কীংবদন্তী উপর নির্ভর করেই বেনারস এর রত্নেশ্বর মন্দির হয়ে উঠেছে মাতৃ ঋণ মন্দির। তবে সে তো সুদূর উত্তর প্রদেশের কথা, এই বাংলা তেও রয়েছে এক কীংবদন্তী নির্ভর কাহিনী। তবে সেটা কোন মন্দির নিয়ে নয় অবশ্য, সে কাহিনী এক সেতু কে ঘিরে আর এই কাহিনী তে মা নয় মাসির কথা।


মাসি সেতু


তাহলে আগে গল্প টা বলে নি,  তারপর ঘুরে আসা যাবে সেই সেতু তে , যে সেতু পরিচিত মাসি সেতু নামে

গল্প টা সেই মোঘল আমলে, বর্ধমান এর সিংহাসনে তখন রাজা নিত্যানন্দ দালাল ওরফে দানিশমন্দ। যুবক বয়সেই বনওয়ারিবাদ এর দায়িত্বে রাজা দানিশমন্দ। যিনি ছোট বয়স থেকেই তার মাসির কাছে লালিত পালিত। রাজার মনে বহুদিনের ইচ্ছে, এই যে মাসি তাকে এত যত্ন করেন তাই তিনি মাসির ঋণ শোধ করবেন। ভাবনা মতই কাজ,  রাজা মাসির কাছে জানতে চান তার মনের ইচ্ছে।

বৃ দ্ধা মাসি,  রাজা কে জানালেন যে তার নৌকা করে গঙ্গাস্নানে যেতে খুব অসুবিধা হয় তাই সে যদি সেতু বেধে দেয় তাহলে তার এবং বাকি সকলের গঙ্গা স্নানে যেতে খুব সুবিধা হয়।

মাসির ইচ্ছে জানার সাথে সাথেই , রাজা কোষাগারে দুজন কর্মচারী কে নিযুক্ত করলেন সেতু নির্মাণের কাজে। এক বছর দুই মাস সময় ধরে,  প্রায় তেইশ হাজার টাকা ব্যায় করে দুই খিলানের উপর এক মজবুত সেতু নির্মিত হয়। আসলে রাজার কাছে মাসির ইচ্ছের থেকেও বড় ছিল তার মনের ইচ্ছা অর্থাৎ মাসির ঋণ শোধ। তাই রাজা সেই সেতুর নাম দেন মাসি সেতু।

কাহিনীর ঠিক এখানে এসেই মিল খুজেঁ পাওয়া যায় বেনারসের রত্নেশ্বর মন্দির বা মাতৃ  ঋণ মন্দিরের সাথে । রত্নেশ্বর মন্দির যেমন কিছুটা গঙ্গা বক্ষে ডুবে গিয়েছিল তেমনই এক অজানা কারণে মাসি সেতুও একরাতে মধ্যেই ভেঙে পড়ল। মাসি সেতুর উপর দিয়ে গঙ্গা স্নানে যাওয়া হলনা। আর শোধ হলনা রাজার মনের ইচ্ছে, আদতে স্নেহের , ঋণ কি শোধ করা যায় ?  তবে এই সেতু নির্মাণে কোন গাফিলতি কিন্তু ছিলনা পরবর্তীতে শোনা যায় পার্শ্ববর্তী রাস্তা নির্মাণের জন্য ওই সেতু থেকে ইট খোলার চেষ্টা হলে শ্রমিক রা সমর্থ হয়না।

বহরানের গাজনের সেই রাত এর স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল। সেই স্মৃতি কে উস্কে আবার হাজির বহারানে বন্ধু শুভঙ্কর এর বাড়ি। উপলক্ষে প্রয়োজন নেই তবু একদিনের বর্ষা উজ্জাপন। বলাবাহুল্য বর্ষা নিরাস করেনি। বৃষ্টি বাদল ভরা নদী সবই ছিলো এই মন মেরামতির সফরে। সফর শেষের দিকে চোখে পড়ল মাসি সেতু। আসলে গতবার যখন এসেছিলাম তখন চোখে পড়েছিল এই সেতু তবে গল্প টা অজানা ছিলো। এবার আমাদের টোটো সারথী মিঠুন এর উদ্যোগে এই অজানা কাহিনী জানতে পারা গেল যদিও কাহিনী টা গুছিয়ে দিল শুভঙ্কর। যখন এই গল্প হচ্ছেমেঘ রোদ এর জমাটি আড্ডা আকাশ জুড়ে। আমরা দাড়িয়ে গঙ্গাটিকুরি থেকে উদ্ধারণপুর বাস রাস্তা উপর ছোট্ট সাঁকো তে , সাঁকো একপাশে ঈশাণী নদীআর একপাশে শিবাই নদী। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই ঈশাণী নদীর দুই তীরে দুই সতী পীঠ। তবে এই উদ্ধারণপুরের রাস্তায় ঈশানী মিশেছে শিবাই এর সাথে। আর এই মিলন স্থলে দাড়িয়ে পশ্চিম দিকে তাকালেই চোখে পরে কিংবদন্তী সেই মাসি সেতু। সেবার শেষ বসন্তে এই দুই নদীর শীর্ণ চেহারা চোখে পড়েছিল বর্ষার ছোয়া পেয়ে ভরে উঠেছে এই দুই নদী। মিলনস্থল টইটম্বুর স্থানীয় রা যে স্থান কে বলে কান্দর , কিন্তু সেই সেতু খানি  একঝলক দেখলে মনে হয় কেউ যেন কথা দিয়ে কথা রাখেনি। কেউ বলেছিল তুমিই হবে যোগসূত্র, তুমি মিলিয়ে দেবে দুই পারের সব সুখ দুঃখ। কিন্তু অসমাপ্ত থেকে গেছে সে কথা। দুপারের গল্প শোনা হয়নি। কথা না রাখা আর না পারার অভিমানে সে যেন নিজেকে ঢেকেছে কঠিন আগাছা তে।

বর্ষায় শিবাই নদী ও মাসি সেতু 


একটা নদীর মাঝে দুটো খিলান। ঘোর বর্ষা তে ছবিওয়ালা দের কাছে সাবজেক্ট হিসাবে যা মন্দ না।

শুভঙ্কর আর মিঠুনের কাছে কীংবদন্তীর কথা শুনে প্রথমেই মনে এসেছে বেনারসের মাতৃ ঋণ মন্দিরের কথা। যে গল্প দিয়ে শুরু করলাম।

আসলে বহারান নিরাস করে না কিছুনা কিছু উপহার রেখেই যায় সেবার গাজনের রাত আর এবারের ঝটিকা সফরে এক কীংবদন্তী। দূরে দাড়িয়ে থাকা প্রাচীন দুই খিলান আর এক অসমাপ্ত সেতু। এত গল্প কাহিনী যাকে ঘিরে। এসব কাহিনীর প্রামাণ্য সত্যতা আছে কিনা জানা নেই,  তবে কালের আগাছায় ভরে যাওয়া মাসি সেতু যে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী তা বলা ই যায়।

এসব নানা ভাবনার মাঝে হাজির টোটো সারথী মিঠুন আসলে তার ওপর দায়িত্ব ট্রেন ধরানোর। এখনও দুটো নদী পেরনো বাকি। কাজের মাসি সেতু ভালো থেকো আবার ফিরব আমার প্রিয় পল্লী, তখন নতুন গল্প শুনিও আবার।

Tuesday, 27 July 2021

চন্দননগরের তিনপক্ষ কালের বারোয়ারী পুজো

 

         চন্দননগরের তিনপক্ষ কালের বারোয়ারী পুজো

 

২০২১ সালের মাতৃ মূর্তি 


একসময় যেখানে ছিল কুস্তিগীর দের আখড়া এখন সেই খানে ব্যস্ত রাস্তার পাশে দাড়িয়ে এক বারোয়ারি  মন্দির। আর যে মন্দিরে সারা বছরই চলে নানা পুজা অর্চনা। তবে এই মন্দির পরিচিত তার বিশেষ একটি পুজোর কারণে। যে বারোয়ারি পুজো চলে দেড়মাস ধরে। তিন পক্ষকাল সময় ধরে কোন বারোয়ারি পুজো যেমন বিরল তেমনি বিরল পুজিত দেবী। আমাদের আজকের গল্প শহর চন্দননগর এর ভুবনেশ্বরী তলার ভুবেনেশবরী পুজো নিয়ে। দেড় মাস ধরে চলা এমন পুজো সত্যিই বিরল। এই চন্দননগর এর চালকে পাড়াতেই ভুবেনেশবরীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির থাকলে বারোয়ারি পুজো দেখা যায়না।

এই পুজো কে কেন্দ্র করেই এই এলাকার নামকরণ।



তবে প্রাচীন এই পুজো নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী ও নানা লোকশ্রুতি ।।

লোকশ্রুতি আছে, এক দিন গঙ্গার ঘাট সংলগ্ন আখড়ায়, হঠাৎ ই এক বয়ষ্ক মহিলা এসে উপস্থিত হন। আখড়ার সদস্য রা স্বভাবতই কিছুটা অবাক হন এবং সেই মহিলার কাছে জানতে চান যে তিনি তাদের মুগড় ভাজার আখড়ায় কি করছেন? বৃদ্ধা তখন তাদের জানায় যে দস্যু রা তার সব সম্পতি লুঠ করেছে তিনি তাই আশ্রয় চাইছেন। আখড়ার সদস্য রা সব শুনে বয়ষ্কা কে সেখানে আশ্রয় দেন। সেই রাতেই তাদের স্বপ্নে আসেন দেবী ভুবনেশ্বরী , এবং বলেন তার মন্দিরে দস্যু রা লুটপাট চালিয়েছে তাই তিনি এখানে আশ্রয় চান। তিনি বৃদ্ধার রূপ ধরে তাদের আখড়া তে এসেছেন।

এরপর থেকেই স্থানীয় মানুষ দের উদ্যোগে শুরু হয় ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো। তবে নাম ভুবনেশ্বরী তলা হলেও এই মন্দিরে বর্তমানে সব দেবদেবীর পুজোই জাকজমক সহকারে হয়ে থাকে। তবে মূল উৎসব এই  ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো। যা চলে তিন পক্ষ কাল অর্থাৎ দেড় মাস ধরে।

সোজা রথের দিন শুরু হয়ে পুজো চলে দেড়মাস। আগে স্নানযাত্রা তে এই পুজো শুরু হত কিন্তু বর্তমানে তিথি পরিবর্তিত হয়ে সোজা রথের দিন থেকে পুজো শুরু হয়।



এই রীতি মেনেই প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই পুজো। ঠিক কবে থেকে এই পুজো র সূচনা তার হিসাব নেই, তবে এই পুজোর প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাস ও নেই।

চন্দননগর এর ভুবনেশ্বরী তলার ভুবনেশ্বরী মাতার সাথে এক সুতোয় বাধা এই জেলার ই সেনেটের প্রাচীন বিশালাক্ষী মাতা। যে বিশালাক্ষী মাতার ফাল্গুন সংক্রান্তির বার্ষিক উৎসব “রান্না খাওয়া মেলা” মেলা বিখ্যাত।

আদতে ভুবনেশ্বরী তলার ভুবনেশ্বরী মাতা সেনেটের বিশালাক্ষী মাতার ই আর এক রূপ।

অতীতে আষাঢ় মাস থেকে তিনপক্ষ কাল সেনেটের মন্দির বন্ধ থাকত , সেই সময় এই ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো আয়োজিত হত। তবে সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু তে বদল এসেছে। বর্তমান এ সেনেটের মন্দির বন্ধ  থাকেনা ঠিকই , তবে সেনেটের বিশালাক্ষী মাতার নিত্য পুজো সম্পন্ন হলে ,তারপর ভুবনেশ্বরী পুজো শুরু হয়।

সবমিলিয়ে ইতিহাস, লোকশ্রুতি র মিলমিশে আধুনিক এই শহরের মধ্যে প্রাচীন এই পুজো জমজমাট।

শুধু যে এই পুজো দেব মাহাত্ম্য বা ইতিহাস বৈচিত্র্য পূর্ণ তা নয়। মাতা ভুবনেশ্বরীর যে মূর্তি তাতে ও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। মূল দেবী মূর্তির ডান পাশে রয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব, বাম পাশে নারদ মুনি, নীচে উপবিষ্ট রয়েছেন বম্ভ্রা, বিষ্ণু। দেবীর সাথে রয়েছে জয়া, বিজয়া , নন্দী, ভৃঙ্গি, আর সখী গণ। সবমিলিয়ে বহু মূর্তির মিল মিশে এক অন্যরকম মাধুর্য এর সৃষ্টি হয়।

চন্দননগর ভুবনেশ্বরী তলার দেড় মাস ধরে চলা এই পুজো সম্পূর্ণ ভাবে মানুষের ভক্তির উপর টিকে আছে। স্থানীয় মানুষ শুধু নন, দূর দুরান্ত থেকে মানুষ জন দেবীর কাছে মানসিক করেন এবং তারা এক এক দিনের পুজোর ভার নিয়ে নেন। প্রত্যেহ পুজো দানে মানুষের উত্সাহ এতটাই যে এক এক দিনে দু তিনজনের নামে পুজো উত্সর্গ করতে হয়। তাতেও সামাল দেওয়া যায়না।

পুজোর কর্মকর্তা দের কথায় “সবই মা এর কৃপা, মা এর মনের ইচ্ছা মা নিজেই পূরণ করেন”। আর ভক্তরাও পরম আনন্দ পান।



এককথায় ভুবনেশ্বরী মাতার পুজো যেন দেড় মাস ধরে চলা ভক্ত ও ভগবান এর মিলন উৎসব ।

তিনপক্ষ কাল ধরে চলা এই পুজো তে প্রত্যহ ভোগ হলেও বিসর্জন এর দিন ভুবনেশ্বরী তলায় নরনারায়ণ সেবা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ভুবনেশ্বরী তলার খুব কাছেই চালকেপাড়া তে রয়েছে ভুবনেশ্বরীর প্রাচীন মন্দির, সেখানে মাতা বারোমাস পুজীত হন ,কিন্তু ভুবনেশ্বরী তলায় এই দেড় মাস ব্যপী এই পুজোর জৌলুস অন্যরকম, ভক্ত দের আনাগোনা, সুবিশাল মূর্তি, ঢাকের বাদ্য, আলো ঝলমলে নবনির্মিত নাট মন্দির সবমিলিয়ে এ এক ব্যাতিক্রমী উৎসব । এই বঙ্গে তিনপক্ষ কাল ধরে চলা এমন বারোয়াঁরি উত্সব সত্যি ই বিরল।

Saturday, 22 May 2021

সম্প্রীতির গল্প বলা এক লৌকিক দেবীর থান

 

         সম্প্রীতির গল্প বলা এক লৌকিক দেবীর থান

                                                                                                                                সুমন্ত বড়াল



 

এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। প্রতিদিন প্রতি মূহুর্ত সুস্থ ভাবে বেচেঁ থাকাটাই যেন উৎসব। আর এই সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজ চালানো প্রায় অসম্ভব। তবুও কাছেপিঠে খোঁজ করা আর ঘুরে দেখা। এমনই ঘরের কাছে খোঁজ পাওয়া এক প্রসিদ্ধ থানের। এ থান মহামারী রোধ কারী দেবীর থান ( যদিও করোনা নামক মহামারীর প্রকোপে এই থানে বাৎসরিক উৎসব দু বছর বন্ধ) , আবার এই থান হিন্দু মুসলিম সম্প্রতির এক অনন্য নজীর সৃষ্টি কারী থান ও বটে। এককথায় পশ্চিমবঙ্গ তথা হুগলী জেলার লৌকিক দেব দেবী চর্চার ক্ষেত্রে এই থান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই জায়গা বা এই দেবী কে নিয়ে আলোচনা র শুরুতে আমাদের ফিরে দেখতে হবে

১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে র সমাচার দর্পণের একটি প্রতিবেদন এ । যেখানে বলা হয়েছে,

মহামহাবারুণী তিথিতে চাকদহ, ত্রিবেণী ও বৈদ্যবাটীতে অনেক লোক আসিয়াছিল। কিন্তু ইহার মধ্যে বৈদ্যবাটীতে ওলাউঠারোগে অধিক লোক মারা গিয়াছে। ইহাতে বোধ হয় যে, ওলাউঠাও বুঝি যোগেতে বৈদ্যবাটীতে গঙ্গাস্নান করিতে আসিয়াছিল এবং সেখানে তাহার শাসক কেহ না থাকাতে অবাধিতরূপে ঐ সকল বিদেশীয় যাত্রিকেরদের উপর আপন পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছে।

এই প্রতিবেদন এ পরিষ্কার বলা হয়েছে ওলা ওঠা অর্থাৎ কলেরা রোগে মানুষ মারা যাওয়ার কথা।

বৈদ্যবাটী র মহা বারুণী তিথির কথা। আর আমাদের প্রসঙ্গ ছিলো এক মহামারীর দেবীর থান নিয়ে। এবার তাহলে পুরো বিষয় টাকে এক সূতোয় বেঁধে ফেলা যাক।

একসময় বৈদ্য শ্রেণির মানুষ দের বাসস্থান ছিলো হুগলী জেলার এই প্রাচীন জনপদ বৈদ্যবাটী। এই অঞ্চলের গঙ্গার তীর খুবই প্রসিদ্ধ স্থান। শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বর এর জল যাত্রা পূন্যস্নান এই বৈদ্যবাটী র ঘাটেই হয়। কথিত আছে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু জলপথে ভ্রমণ কালে এই জনপদের একটি ঘাটে বিশ্রামের জন্য আসেন। তার পাদস্পর্শে ঘাট সংলগ্ন একটি নিম গাছে জবা ফুল ফুটে ওঠে , সেই থেকে এই ঘাটের নাম হয় নিমাইতীর্থ ঘাট। এই নিমাই তীর্থ ঘাটের বারুণী মেলা ও সেই মেলা কে কেন্দ্র করে লোক সমাগম ও উৎসব বহু প্রাচীন। ১৮২২ খ্রী এই বারুণী তিথি তে আয়োজিত মেলায় বহু লোক সমাগম হয় এবং পূণ্য স্নানের উদ্দেশ্যে। আর সেই বছর এই পূণ্য স্নানে বহুমানুষ ওলা ওঠা / কলেরা তে মারা যান। আর সেই কারণে এই নিমাইতীর্থ ঘাটের পাশেই যাত্রাপথের, এই মরণব্যাধি র প্রকোপ থেকে বাঁচতে ওলাওঠা মহামারী প্রতিরোধ কারী দেবী ওলাবিবি র একটি বেদী স্থাপন করা হয়। শতাব্দী প্রাচীন সেই বেদী আজও বর্তমান, ওলাবিবির থান নামেই যা পরিচিত।



ওলাবিবি এক অনার্য লৌকিক দেবী। ওলাবিবি 'ওলাওঠা' অর্থাৎ কলেরা রোগের দেবী। ওলা' শব্দের অর্থ 'দাস্ত নামা' এবং 'ওঠা' অর্থে 'কমন'অর্থাৎ সে ব্যারামে দাস্ত ও বমি হয়, তাই-ই হল ওলাউঠা' বা 'ওলাওঠা' ব্যাধি। এই ওলাওঠা রোগ নিরাময়ের একমাত্র দেবী ওলাবিবি। এছাড়া জলবসস্ত, হাম, পানবসস্ত প্রভৃতি রোগে ওলাবিবির পূজা করা হয়। ওলাবিবি' নাম থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইনি মুসলমানদের আরাধ্যা। তবে ওলাবিবির পূজারী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, এমনকি শুদ্র পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং ওলাবিবি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেবী। সেই সময় নিম্ন বর্গের হিন্দু কিংবা মুসলিম রা রাস্তার ধারে, কিংবা পাতার ছাউনি তে ওলাবিবির থান তৈরী করে এই কলেরার দেবী কে পুজো করতেন। ওলাবিবি ফুল জলেই সন্তুষ্ট। ওলাবিবির বিগ্রহ থাকলেও তা সহজলভ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ই মাটির স্তূপ বা ঢিপি করে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ ওলাবিবির পুজো করেন।

বৈদ্যবাটী র এই থানে ও দেবীর বিগ্রহ নেই ।থান বলতে লাল রঙে বাঁধানো একটি বেদী। সেই খানে পুজো চলে।

তবে বৈদ্যবাটী র এই ওলাবিবি র থান প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভিন্ন মত ও প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয় কাজী পাড়ার মুসলমান সম্প্রদায় এর মানুষের মতে, মুর্শিদাবাদ নবাবের কোন এক আত্মীয়া এই বৈদ্যবাটী তে এসে কলেরা তে মারা যান। পরবর্তীতে তার স্মৃতি রক্ষার্থে এই ওলাবিবির মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতিষ্ঠার কারণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও এই কথাও সত্য, কাজীপাড়ার কাজী আব্দুল মতিন ও তার পুর্বপুরুষ রা বহুদিন এই মাজারের দেখভাল করেছেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নানা কারণ, যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা কাজী সাহেবের বয়স জনিত কারণে ১৩৭২ বঙ্গাব্দের ১৫ ই কার্তিক খাদেম কাজী আব্দুল মতিন স্থানীয় ব্যবসায়ী শম্ভু দত্ত কে এই মাজারের দায়িত্ব সপে দেন। সেই থেকে দত্ত পরিবার এই থানের দেখভাল করে আসছে।

নানান লোক শ্রুতি, নানান কাহিনী রয়েছে এই ওলাবিবি র থান কে ঘিরে। এই থানে ভক্ত রা নিজেরা আসে বেদী ছুঁয়ে পুজো করিয়ে নিয়ে যায় কোন পুরোহিত বা মৌলবির প্রয়োজন নেই এখানে। ভক্তের ভক্তিই শেষ কথা, সে যে সম্প্রদায় এর ই হোক না কেন।



বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের দুই বৃ হস্পতিবার ওলাবিবি র বাৎসরিক উৎসব পালিত হয়। এই প্রাচীন উৎসব ঘিরে অতীতে বহু মানুষের সমাগম হত , বৈদ্যবাটী শহরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে এই ওলাবিবি র উৎসব ও মেলার কথা জানা যায়। এই থানের পাশেই রয়েছে গঙ্গা আর পাড় বাঁধানো ওলাবিবির ঘাট ।উৎসবের দিন ভক্তরা স্নান করে দন্ডি কেটে এই বেদী তে জল ঢেলে মনস্কামনা জানায়। সময়ের সাথে সাথে মেলা বিলুপ্ত হয়েছে, মানুষের রোগ ব্যাধির ক্ষেত্রে দৈব নির্ভরতা কমেছে বটে কিন্তু ওলাবিবির থানে ভক্ত দের আনাগোনা তে ভাটা পড়েনি।

বৈশাখ মাস ছাড়াও মাঘ ও ফাল্গুন মাসে র শুক্লপক্ষ এর বৃ হস্পতিবার দেবীর বিশেষ পুজো হয়। এছাড়া আতপ চাল ও বাতাসা দিয়ে দেবীর নিত্য পুজা ও চলে এই বেদীতে।

তবে এই উৎসবে আগে রান্না খাওয়া লোকাচার এর প্রচলন ছিল। ভক্তরা রান্নার সামগ্রী এনে আতপ চালের ভাত তরকারি রান্না   করে দেবীকে ভোগ দেওয়া হত। " হুগলী জেলার লৌকিক দেবতা " গ্রন্থে শ্রী কৌশিক পাল এই বিষয়ে লিখেছেন -  " বৈদ্যবাটীর ওলাবিবি শুধু ওলাওঠা রোগের দেবী নন; তিনি জ্বর-জ্বালা, ব্যথা-বেদনা ও পক্ষাঘাত উপশমের দেবীও বটে। সেই সঙ্গে তিনি পশুরক্ষক দেবী। প্রজননের দেবী। শস্য উৎপাদনের সঙ্গেও তিনি জড়িত। তাঁর মাজারচত্বরে বসে 'রান্না খাওয়া'র লোকাচার সেই ইঙ্গিতবাহী। "

লোকমুখে জানা যায় ব্যারাকপুর এর জনৈক মৌলবি এই মাজারে এসে নিরামিষ ভোগ চড়াতেন।

ওলাবিবির এই মাজার কে ঘিরে নানান লোকশ্রুতি র মধ্যে ঘোড়ার ছলনের কাহিনী বেস মনোজ্ঞ

একবার এক স্থানীয় বাসিন্দা ট্রেনে ভ্রমণ এর সময় এক দুর্ঘটনা  ঘটে। এই দুর্ঘটনা তে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর পা ভীষণ ভাবে জখম হয়, এবং তিনি দেবী র কাছে প্রার্থনা করে দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন, সেই ব্যক্তি ওলাবিবির থানে সোনার ঘোড়ার ছলন দেন। আসলে চাল, বাতাসা, চিনি সন্দেশ প্রসাদের সাথে, পক্ষাঘাত নিরাময় কল্পে ঘোড়ার ছলন দেয়ার রীতি এই থানে প্রাচীন।



প্রসঙ্গত বলা যায় এই অঞ্চলে বেশ কিছু কুমোর শ্রেণীর মানুষের বসবাস যারা সারা বছর মাটির নানা সামগ্রী র সাথে মাটির ঘোড়াও তৈরী করে।

আজ দুবছর মহামারী র প্রকোপে আর এক মহামারী র দেবীর বাৎসরিক উৎসব স্থগিত বটে, কিন্তু বহু প্রাচীন এই থানে ভক্তদের আনাগোনা লেগেই থাকে, আসলে ভক্তি মানুষ কে বেচেঁ থাকার লড়াইয়ে শক্তি জোগায়। আর বৈদ্যবাটী র এই ওলাবিবি র থান যেন ভক্তি, বিশ্বাস, ধর্ম বর্ণ, সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে এক  বহু শতাব্দী ধরে সম্প্রীতির ভার বহন করে চলেছে।

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...