“কুচিয়াকোলের মল্লরাজবাড়ি : প্রতিমাহীন দুর্গাপুজোর চারশো বছরের ইতিহাস”
সুমন্ত বড়াল
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়। বিষ্ণুপুর তখন শিল্প-সংস্কৃতি, সঙ্গীত, নৃত্য আর মন্দিরনির্মাণে এক অনন্য অধ্যায়ের সাক্ষী। মল্লরাজারা তাঁদের সামরিক শক্তি ও শিল্পপ্রীতি মিলিয়ে বিষ্ণুপুরকে গড়ে তুলেছিলেন বাংলার অন্যতম গৌরবময় জনপদে। সেই সময়ে রাজপরিবারের এক শাখা পুরুষ, বসন্ত সিংহ দেব, হঠাৎ করেই রাজনগর ছাড়লেন। পরিবারের প্রবীণরা বলেন, হয়তো প্রশাসনিক ভারসাম্যের জন্য, আবার কেউ বলেন শিকড় ছড়িয়ে নতুন ভূমিকে গড়ে তোলার বাসনায়—যে কারণই হোক, তিনি একদল পরিবার ও ভৃত্য-পরিজন নিয়ে রওনা দিলেন বিষ্ণুপুর থেকে দূরে, জয়পুর অরণ্যের দিকে। গন্তব্য ছিল কুচিয়াকোল, ঘন জঙ্গল আর জনমানবশূন্যতার আবরণে ঢাকা একটি জনপদ।
সেই কুচিয়াকোল আজও তার প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করে। তবে চারশো বছরেরও আগে যখন বসন্ত সিংহ দেব এখানে এলেন, তখন গোটা অঞ্চল জঙ্গলে ভরা। ঘন অরণ্যের ভেতর সাঁঝ নামলে কেবল পাখির ডাক আর বুনো জন্তুর হুঙ্কার শোনা যেত। মানুষজনের বসবাস তখনও তেমন হয়নি। কিন্তু মল্লরাজপুত্র ভীত হলেন না। তিনি জানতেন—জঙ্গল কেটে, জমি চাষযোগ্য করে, ঘর-বাড়ি বানিয়ে, মন্দির-ঠাকুরদালান গড়ে তুললেই এই অরণ্য বসতিতে রূপ নেবে। তাঁর সঙ্গে থাকা মানুষদের নিয়ে তিনি জঙ্গল কেটে ধানক্ষেত বানালেন, বাঁশবাগান লাগালেন, ছোটো ছোটো ঘর তুললেন। এরই মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল এক রাজপ্রাসাদ—চওড়া লাল ইটের দেয়াল, উঁচু প্রাচীর, এবং রাজপাটের জৌলুশ বোঝানোর মতো স্থাপত্য।
আজ সেই রাজপ্রাসাদ ভেঙে পড়েছে। পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপ, দেয়ালের টুকরো, লালচে ইটের স্তূপ, ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা এক গৌরবময় ইতিহাস। কিন্তু একটি স্থাপনা আজও অটুট—ঠাকুরদালান। আর সেই ঠাকুরদালানই সাক্ষী হয়ে আছে চারশো বছরের একটানা দুর্গাপুজোর।
এই পুজোকে আলাদা করে তোলে বহু বিশেষত্ব। প্রথমত, এখানে কখনও মাটির প্রতিমা তৈরি হয়নি। চারশো বছর ধরে দুর্গাপুজো হয় এক আয়তাকার পটে আঁকা দুর্গার। পটটির উচ্চতা প্রায় চার ফুট, প্রস্থ তিন ফুট। ছবির প্রতিটি রেখা আজও তাজা মনে হয়। অসুরদলনী দশভুজা মা দুর্গা লাল শাড়ি পরে, মাথায় মুকুট, হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক, ত্রিশূলসহ নানা অস্ত্র। মায়ের ডান দিকে গণেশ-লক্ষ্মী, বাঁ দিকে কার্তিক-সরস্বতী, আর সবার ওপরে মহাদেব, পাশে নন্দী-ভৃঙ্গী। প্রতিটি চরিত্রের অভিব্যক্তি, গহনা, ভঙ্গিমা—সবই রঙ-তুলির নিপুণতায় প্রাণ পেয়েছে।
এই দুর্গাপট আঁকেন বিষ্ণুপুরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এই দায়িত্ব পালন করছে। এ পরিবারই মল্লরাজাদের জন্য বানাতো বিখ্যাত “দশঅবতারের তাস”—যা একসময়ে বাংলার শিল্পকলা ও বিনোদনের অমূল্য নিদর্শন। আজও দুর্গাপট এঁকে চলেছেন তাঁদের উত্তরসূরিরা।
পুজোর সূচনা হয় দেবীপক্ষের পঞ্চমীতে গন্ধ অধিবাস দিয়ে। বেলতলায় তখন গ্রামের মানুষদের ভিড় জমে। সপ্তমীর সকালটিই আসল উৎসব। কাপড়ের দোলায় চেপে নবপত্রিকাকে স্নানে নিয়ে যাওয়া হয়। স্নান শেষে নবপত্রিকা পূজা হয়, আর তখনই বাজে তোপ। সেই বজ্রনিনাদ কেঁপে তোলে গোটা গ্রাম। অন্নভোগ দেওয়া হয়, তারপর ঢোল বাজিয়ে নবপত্রিকাকে আনা হয় ঠাকুরদালানে। এখানে ঢাক বাজানো হয় না—তার বদলে বাজে ঢোল। ঢোলের গম্ভীর ধ্বনি চারিদিক ভরে দেয়, যেন অরণ্য-আবৃত প্রাচীন কুচিয়াকোল নতুন করে জেগে ওঠে।
এই পুজোয় আরেকটি অভিনব রীতি মানা হয়। তিথি অনুসারে দেবীর গমন যেমন বলা হয়, তার প্রতীক এখানে নির্মাণ করা হয়। যেমন, এ বছর যদি দেবীর গমন দোলায় হয়, তবে ঠাকুরদালানের পাশে প্রতীকী দোলা সাজানো হয়। যেন মায়ের আগমন ও গমন লোকচক্ষুর সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। গ্রামবাসী বিশ্বাস করে—এ প্রতীক নির্মাণ দেবীকে সন্তুষ্ট করে, আর তাঁর আশীর্বাদে গ্রামে সুখ-শান্তি বজায় থাকে।
অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণও এখানে বিশেষ তাৎপর্যের। মায়ের পাশে রাখা থাকে একটি তরবারি আর একটি ছোট কামান—রাজবাড়ির পুরনো গৌরবের স্মৃতিচিহ্ন। ঠিক সেই সন্ধিক্ষণেই কামান থেকে গর্জে ওঠে তোপধ্বনি। তবে নিয়ম আছে—প্রথমে বিষ্ণুপুর মল্লরাজবাড়িতে কামান দাগা হয়, তারপর কুচিয়াকোলে। যেন ছোট ভাই বড় ভাইকে মান্যতা দিয়ে পরে নিজের কথা বলে। তোপের শব্দে গ্রামের মানুষ জানে—সন্ধিক্ষণের পূজা শুরু হয়েছে।
তরবারি পাশে থাকলেও এ বাড়ির পুজোয় কোনও বলির প্রথা নেই। প্রতিদিন মাকে দেওয়া হয় অন্নভোগ, ফল-মিষ্টি। রাতে নিবেদন করা হয় বিশেষ ভোগ—দুধ চুলি। এই ভোগকে ঘিরে বহু লোককথা আছে। প্রবীণরা বলেন, মা দুর্গা যেন এই দুধ চুলির স্বাদ না পেলে তাঁর পুজো সম্পূর্ণ হয় না। অষ্টমী, নবমী ও দশমীতে ভোগের আয়োজন আরও সমৃদ্ধ হয়।
এই ক’দিন গৃহদেবতা রাধাবিনোদকে এনে ঠাকুরদালানে বসানো হয়। মায়ের সঙ্গে রাধাবিনোদ থাকেন, যেন দুই দেবতার মিলনে পুজোর মাহাত্ম্য দ্বিগুণ হয়ে যায়। দশমীর সকালটাও অনন্য। মা দুর্গাকে ভোগ দেওয়া হয় চ্যাং মাছের সঙ্গে পান্তাভাত। গ্রামীণ লোকাচারের সঙ্গে মিশে থাকা এ ভোগ কুচিয়াকোলের পুজোকে আরও বিশেষ করে তোলে।
তবে এখানকার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য—দুর্গাপট বিসর্জন হয় না। নবপত্রিকাকেই বিসর্জন দেওয়া হয়। পট থেকে মা দুর্গা সারা বছর ঠাকুরদালানেই বিরাজ করেন। দশমীর দিনে আরও একটি বিশেষ রীতি পালিত হয়—রামচন্দ্রপূজা। মানকচু পাতা, কলাপাতা আর বেলপাতায় লেখা হয় রামের নাম, আর তার পূজা করা হয়। এরপর সবাই যান মঠবাড়িতে, যেখানে পূর্বপুরুষদের সমাধি আছে। তাঁদের প্রণাম জানিয়ে তবে পুজোর সমাপ্তি ঘটে।
আজ আর জমিদারি নেই, রাজাও নেই। তবু পুজো বেঁচে আছে গ্রামের মানুষদের টানে। পদ্ম আসে মাঝি পরিবার থেকে। পুরোহিত, তোপদ্বার, পরিচারিকা—সব দায়িত্ব বহন করে আসছে সেইসব পরিবার, যাদের হাতে চারশো বছর আগে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের প্রতিটি মানুষ আজও ভাবে—এ শুধু রাজবাড়ির পুজো নয়, এ তো পুরো গ্রামের দুর্গোৎসব।
পুজোর সময় কুচিয়াকোলে যেন অন্য আবহ তৈরি হয়। ভোরবেলা ধূপের গন্ধ মিশে যায় সকালের কুয়াশায়। ঠাকুরদালানের সামনে বসে প্রবীণরা গল্প করেন—“যখন আমরা ছোট ছিলাম, তখনও মা এসেছেন এইভাবেই। ক’জনেই বা ভেবেছিল, রাজা চলে যাবেন, রাজপাট ভেঙে যাবে, কিন্তু মায়ের পুজো থেকে যাবে!” ছোটোরা বিস্ময়ে শুনে, কল্পনা করে সেই রাজাদের দিন।
গ্রামের মহিলারা অঞ্জলি দিতে এসে গুনগুনিয়ে গান ধরেন—শক্তির আহ্বান, আশীর্বাদের প্রার্থনা। ঢোলের শব্দে কেঁপে ওঠে মাটি। সন্ধ্যাবেলায় যখন ঠাকুরদালান আলোকসজ্জায় ভরে ওঠে, তখন মনে হয়—ভাঙা প্রাসাদ আর ধ্বংসস্তূপের মাঝেও যেন এক আলোকিত ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে।
কুচিয়াকোল মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপুজো তাই শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়। এটি ইতিহাসের সেতুবন্ধন, লোকসংস্কৃতির অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রতিমাহীন পুজো, তোপধ্বনি, তরবারি, দুধ চুলি, চ্যাং মাছের ভোগ, রামচন্দ্রপূজা, গমনের প্রতীকী নির্মাণ—সব মিলিয়ে এই পুজো এক জীবন্ত কাব্য। রাজা নেই, প্রাসাদ ভেঙে পড়েছে, তবুও মা দুর্গা আসেন প্রতিবছর, আসেন গ্রামের মানুষের আহ্বানে।
আর সেই আহ্বান যেন আজও কানে বাজে—ঢোলের গম্ভীর শব্দের সঙ্গে মিশে থাকা মায়ের ডাক।
No comments:
Post a Comment