Wednesday, 1 October 2025

চন্দননগরের কুণ্ডু বাড়ির বিসর্জনহীন দুর্গোৎসব

 “চন্দননগরের কুণ্ডু বাড়ির বিসর্জনহীন দুর্গোৎসব”

সুমন্ত বড়াল




চন্দননগরের শহরকে ঘিরে যত গল্প, কাহিনি, ইতিহাস জমে আছে, তার মধ্যে কুন্ডু বাড়ির দুর্গাপুজো যেন এক বিশেষ আলোকরেখা। বনেদি ঘরের পুজোর গন্ধ, পুরনো বাড়ির ইট-কাঠের দেয়ালে লেগে থাকা শঙ্খধ্বনি, ধূপের ধোঁয়া আর ভক্তির আবেশে এই বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দুই শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে। কেবল একটি পারিবারিক পূজা নয়, এ যেন এক জীবন্ত ইতিহাস, যা গড়ে উঠেছে অলৌকিক ঘটনা, রীতি-নীতি আর পারিবারিক ঐতিহ্যের ওপর।

এই পুজোর কাহিনি শুরু হয় এক বিস্ময়কর উপাখ্যান দিয়ে। পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য স্বপ্নে দেখেন, বাড়ির পাশের ছোট্ট পুকুরের ধারে আছে এক দেবমূর্তি। স্বপ্নকে তিনি অগ্রাহ্য করেননি, বরং খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। অবশেষে পুকুরের ধারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসে মাত্র ছয় ইঞ্চি উচ্চতার এক অষ্টধাতুর প্রতিমা। আট ধাতুর সংকর দিয়ে তৈরি সেই প্রতিমা যেন অলৌকিক দীপ্তিতে ভরে ওঠে। তখন থেকেই কুন্ডু পরিবারের পূজার কেন্দ্রে আসীন হয় এই ছোট্ট প্রতিমাটি। বলা হয়, পরিবারের এক নারী—জলদময়ী দাসী—প্রথম প্রতিষ্টা করেছিলেন এই দেবীর। পরিবারের বিশ্বাস, মা দুর্গা এখানে কেবল দেবী নন, তিনি তাঁদের কুলদেবী, যাঁর আশীর্বাদে বাড়ির প্রতিটি প্রজন্ম রক্ষা পায়।

প্রতিমার স্থায়ী প্রতিষ্ঠার কারণে এখানকার পূজার আচার অনন্য। অন্যত্র দশমীতে বিসর্জন মানেই পূজার সমাপ্তি, কিন্তু কুন্ডু বাড়িতে তা হয় না। এখানে দশভূজা দুর্গা চিরকালীন, তাই বিসর্জনের প্রশ্নই ওঠে না। সপ্তমীর দিন প্রতিমাকে দোতলার ঠাকুরঘর থেকে নিচে দলানে আনা হয়। পূজার সমগ্র আচার-বিধি সেখানেই সম্পন্ন হয়। দশমীর শেষে আবার প্রতিমা তাঁর আসন ফিরে পান ঠাকুরঘরে। একেই তো স্থানীয়রা বলেন, মা যেন নিজের বাড়িতে এসেছেন, তাই তাঁর যাত্রা নেই, গমন নেই, কেবল আগমন আর বিরাজ।

এই পূজার আচার-বিধি অন্য বনেদি বাড়ির থেকে খানিকটা ভিন্ন। মহাষ্টমীতে হয় কুমারী পূজা, ধুনো পোড়ানোও হয় যথারীতি। তবে সন্ধিপূজা হয় না—এটাই এই পুজোর এক বিশেষ ব্যতিক্রম। যদিও সেই সময়ে ১০৮ প্রদীপ জ্বালানো হয়, যা এক অন্য আবহ তৈরি করে। আরেকটি বিশেষ রীতি হলো, এখানে বোধন হয় না। মহালয়ার পর দ্বিতীয় দিনে একটি বিশেষ পূজা এবং অভিষেকের মাধ্যমে দেবীর আরাধনা শুরু হয়। এ যেন একান্ত কুন্ডু পরিবারের নিজস্ব নিয়ম, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে।

ভোগের আচারেও রয়েছে পার্থক্য। এখানে অন্নভোগ হয় না, কেবল লুচি ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীর কাছে। পরিবারের ধারণা, দেবী লুচিকেই ভোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। ভক্তদের জন্যও সেই লুচি-ভোগ হয়ে ওঠে পবিত্র প্রসাদ।

এই বাড়ির ঠাকুরঘর দোতলায় অবস্থিত। দেবী আসীন থাকেন সেখানেই। তবে পূজার দিনগুলোয় দলান হয় প্রধান কেন্দ্র। বাড়ির যাবতীয় মঙ্গল অনুষ্ঠান—বিয়ে, অন্নপ্রাশন, নামকরণ—সবকিছু হয় এই ঠাকুরদালানেই। ফলে এই দালান কেবল পূজার স্থান নয়, পরিবারের ইতিহাস ও স্মৃতির ভাণ্ডার। এর প্রতিটি ইটে লেগে আছে কত বিয়ের আনন্দ, অন্নপ্রাশনের কোলাহল, আর দেবীর আশীর্বাদের ছাপ।

কুন্ডু বাড়ি একসময় ছিল শহরের অন্যতম বনেদি পরিবার। বাড়ির স্থাপত্যে আজও তার ছাপ দেখা যায়। দলানের ভেতরে আজও টিকে আছে অপূর্ব ফুলের নকশা। পুজোর সময় অঙ্গন ভরে ওঠে মানুষের ভিড়ে। ভক্তরা আসেন দূরদূরান্ত থেকে। বিশেষ করে নবমীর দিন, যখন বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, তখন বাড়িটি যেন উৎসবের মেলায় পরিণত হয়।



আগেকার দিনে এখানে তিন দিন ধরে পশুবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। মহাষ্টমী, নবমী এবং দশমী—তিন দিনই মায়ের পায়ের তলায় বলি দেওয়া হতো। কিন্তু প্রায় চার দশক আগে সেই প্রথার ইতি ঘটে। পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, যুগের পরিবর্তনে বলির পরিবর্তে ভোগ আর ভক্তিই যথেষ্ট। তবু প্রৌঢ়দের মুখে শোনা যায়, কীভাবে ভোরবেলায় কাঁসার শব্দে আর বলির রক্তে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হতো। এখন সে সব কেবল স্মৃতির মধ্যে।

কুন্ডু বাড়ির পূজার আরেকটি দিক হলো, এখানে মূর্তি পূজা প্রায় হয় না। মা দুর্গা ছাড়া অন্য কোনও দেবদেবীর প্রতিমা নেই। দেবীই তাঁদের কুলদেবী, তিনি-ই সর্বশক্তি। একসময় এই বাড়িতে কালীপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজাও অনুষ্ঠিত হতো, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এখন দুর্গাপুজোই হয়ে উঠেছে একমাত্র বৃহৎ উৎসব।

চন্দননগরের অন্যান্য বনেদি পুজোর সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়, কুন্ডু বাড়ির পুজোর আচার নিছক ধর্মীয় আচার নয়, এটি এক ঐতিহ্য, যা পরিবারকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে মানুষ একত্রিত হচ্ছে, গল্প করছে, সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করছে এই পূজাকে কেন্দ্র করে। যে কারণে পুজো কেবল ভক্তির জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি হয়ে উঠেছে পারিবারিক ও সামাজিক মিলনের স্থান।



শহরের মানুষ জানেন, দুর্গাপুজোর ক’দিন কুন্ডু বাড়ি মানেই ভিড়। অঙ্গনে ধূপের গন্ধ, শঙ্খের ধ্বনি, ঢাকের বাজনা, আলো-আঁধারির খেলা—সব মিলিয়ে এক অনন্য আবহ। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় যখন ১০৮টি প্রদীপ জ্বলে ওঠে, তখন দলানের ভেতর যেন অন্য জগতের ছবি আঁকে।


প্রতিটি বনেদি বাড়িরই একটি আভিজাত্য থাকে, কুন্ডু বাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এ বাড়ির আসল মহিমা এর আচার-অনুষ্ঠানে, এর অলৌকিক প্রতিমায়, আর এর দীর্ঘ ইতিহাসে। প্রায় দুই শতাব্দীর পুরোনো এই পুজো আজও সমান ভক্তি আর উৎসাহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সময় বদলেছে, প্রথা বদলেছে, পশুবলি বন্ধ হয়েছে, অনেক আয়োজন কমে এসেছে, কিন্তু দেবীর প্রতি ভক্তি কমেনি।

কুন্ডু বাড়ির মানুষদের কাছে মা দুর্গা কেবল দেবী নন, তিনি পরিবারের রক্ষাকর্ত্রী। তাঁদের বিশ্বাস, জীবনের প্রতিটি শুভ কাজে দেবীর আশীর্বাদ অপরিহার্য। তাই বিয়ের মণ্ডপ থেকে শুরু করে অন্নপ্রাশনের প্রথম ভাত—সব কিছুই হয় ঠাকুরদালানের ছত্রছায়ায়। দেবী যেন পরিবারের প্রতিটি আনন্দ-বেদনার সঙ্গিনী।

চন্দননগরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই পুজোর নাম। বনেদি বাড়িগুলোর মধ্যে কুন্ডু বাড়ির নাম উচ্চারণ করা হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে। কারণ এখানে উৎসব মানে কেবল বাইরের চাকচিক্য নয়, এখানে উৎসব মানে ঐতিহ্য, ভক্তি আর পারিবারিক ঐক্যের প্রকাশ।

দুই শতাব্দী আগে জলদময়ী দাসী যে পূজার সূচনা করেছিলেন, তা আজও একই ভক্তি আর মর্যাদায় চলছে। দেবী এখনও সেই ছয় ইঞ্চির অষ্টধাতুর প্রতিমায় আসীন, ঠাকুরঘরের শান্ত পরিবেশে, আর পূজোর দিনগুলোয় ভরে ওঠেন ভক্ত-সমাগমে। প্রতিমার চিরন্তন উপস্থিতি প্রমাণ করে দেন, দেবী বিসর্জনহীন, তিনি নিত্য, তিনি অনন্ত।

এইভাবেই কুন্ডু বাড়ির দুর্গাপুজো হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক অংশ, লোককথার এক উপাখ্যান, আর ভক্তির এক অবিনশ্বর প্রতীক।

No comments:

Post a Comment

তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি

                            তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো...