শ্রীরামপুর চাতরার তপ্তকাঞ্চন বর্ণ জগদ্ধাত্রীর শত বছরের ঐতিহ্য
শ্রীরামপুর শহরটাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন এই শহর শুধু ড্যানিশ ইতিহাসের জন্য বিখ্যাত নয়—এ শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি পাড়ার মধ্যে যেন গড়ে উঠেছে একেকটা জীবন্ত লোককথা। গঙ্গার ধারে, পুরনো লাল ইটের ঘরগুলোর আড়ালে, অজস্র স্মৃতির মতো টিকে আছে এক শতাধিক বছরের ঐতিহ্য—চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজো।
আজ এই পুজো এগিয়ে চলেছে স্থানীয় বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহযোগিতায়। আশীষ ভট্টাচার্য, তাপস ব্যানার্জি, সলিল ব্যানার্জি, শ্রীকুমার ব্যানার্জি প্রমুখের নিষ্ঠা ও ভালোবাসা, এবং আশেপাশের অসংখ্য ভক্তের আত্মনিবেদন মিলেই এই দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাঁদের একাগ্রতা ছাড়া হয়তো এই শতাব্দীপ্রাচীন আয়োজন এত দীপ্ত হয়ে জ্বলত না।
আজ যখন পুজোটা একশো ছাব্বিশ বছরে পা দিয়েছে, তখনও বিস্ময় লাগে—সময় অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে, কিন্তু চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজোর রীতিতে এক বিন্দু পরিবর্তন হয়নি। এ যেন শ্রদ্ধার ভিতর দিয়ে ঐতিহ্যের প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা।
চাতরার জগদ্ধাত্রী মূর্তি কখনও চকচকে আধুনিক সাজে সজ্জিত হয় না। রঙে, আকারে, সাজে—সবেতেই অনুসৃত হয় শাস্ত্রীয় নিয়ম। এই ধারাবাহিকতা নিয়েই গর্ব করে চাতরা জগদ্ধাত্রী পাড়া। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন—“আমাদের দেবী যেমন ছিলেন দাদুর সময়, তেমনই আছেন আজও। শুধু আমরা বুড়ো হয়েছি, মা হননি।”
এই পুজোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার ভোগ নিবেদনে। অন্যত্র যেখানে একটি বড় ভোগ থালা দেবীর সামনে নিবেদন করা হয়, চাতরার নিয়ম সেখানে ভিন্ন। যাঁরা পুজো দেন, প্রত্যেক পরিবারের নাম ও গোত্র উল্লেখ করে আলাদা আলাদা ডালা সাজানো হয়। প্রত্যেকের ভোগ যেন তাঁদের নিজস্ব আহ্বান। কারও ডালায় খিচুড়ি, ভাজা, দু রকম তরকারি; কারও পোলাও-পনির; কারও ছানার পদ, মিষ্টি, পরমান্ন। যতজন ভক্ত, তত রকম ভোগ। এই বহুবিধতার মধ্যে যেন এক সামষ্টিক ঐক্য—যেন মা সবার আহার গ্রহণ করছেন নিজ হাতে।
চাতরার মানুষ বলেন, “এই ভোগেই আছে আমাদের প্রাণ। মা সবার ডালা আলাদা চেনেন,
আলাদা আশীর্বাদ দেন।” ভোগ নিবেদনের সময়ের দৃশ্য দেখার মতো—ধূপে ধোঁয়ায় ভরা পরিবেশ,
ঘণ্টা-শঙ্খের ধ্বনি, ঢাকের মৃদু তাল, আর পূজারীদের চোখে অপার ভক্তি।
নবমী তিথির সকাল থেকেই পাড়ার হাওয়ায় গাম্ভীর্য। এই দিনই চার প্রহরের পূজা হয়। প্রথম প্রহরে মন্ত্রপাঠ ও দেবীর অর্ঘ্য, দ্বিতীয় প্রহরে অন্ন নিবেদন, তৃতীয় প্রহরে সন্ধিপূজা, আর চতুর্থ প্রহরে আরতি ও প্রার্থনা। প্রতিটি প্রহরে আলাদা গন্ধ, আলাদা অনুভব—যেন সময় থমকে যায়।
রাত্রি নামলে মণ্ডপভর্তি আলোয় দেবীর মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে—কেউ পুরনো স্মৃতি খুঁজে, কেউ সন্তানকে নিয়ে প্রথমবার মায়ের দর্শনে। একসময় যখন শহরে তেমন বিদ্যুতের আলো ছিল না, তখন কাঁচের কুপি আর তালপাতার পাখা হাতে বসে থাকতেন মহিলারা, মন্ত্র শুনতেন, ঢাকের ছন্দে তাল দিতেন। আজ নীয়ন আলোর যুগেও সেই আবেশ ফুরোয়নি।
দশমীর দিন ভোর থেকেই যেন বিষণ্ণতার ছায়া নেমে আসে। কিন্তু একই সঙ্গে রয়েছে
আনন্দের উৎসব—বিসর্জনের আগে দেবী বরণ। চাতরার মহিলারা সাজগোজ করে, মাথায় লাল পাড় সাদা
শাড়ি, কপালে বড় টিপ, হাতে শাঁখা-পলা পরে দেবী বরণে আসেন। একসঙ্গে দেড়শোরও বেশি মহিলা—সবাই
মায়ের পায়ে সিঁদুর দেন, পরস্পরের মুখে সিঁদুর লাগান। চারিদিকে হাসির কলরব, উলুধ্বনি,
শঙ্খধ্বনি, আর তার মধ্যেই রক্তিম আবেশে রাঙা হয়ে ওঠে সমগ্র চাতরা।
সিঁদুরখেলার পর হয় মিষ্টিমুখ। তারপর দীর্ঘ সার বেয়ে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় দেবীকে। গঙ্গার জলে তখন সূর্য ঢলে পড়ছে, আকাশে কমলা রঙ ছড়িয়ে আছে—দেবীর রঙের মতোই। ঢাক বাজছে, কণ্ঠে “জয় মা জগদ্ধাত্রী”—জলতরঙ্গে প্রতিধ্বনি হয়ে উঠছে। সিঁদুরে রাঙা মুখে সবাই তাকিয়ে থাকে সেই মহামুহূর্তে—যখন মা জলে মিশে যান, রেখে যান শুধু আশীর্বাদের ছায়া।
চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজো শুধু ধর্মীয় আচার নয়—এ এক সামাজিক উৎসব, এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। পুজোর সময় পাড়ার তরুণরা দল বেঁধে স্বেচ্ছাসেবার দায়িত্ব নেয়। কেউ ভোগ বিতরণে সাহায্য করে, কেউ শৃঙ্খলা বজায় রাখে, কেউ রাতভর আলো জ্বালিয়ে রাখে। পাড়ার প্রবীণরা বসে গল্প করেন—কখনও বলেন, “তখন তো বিদ্যুৎ ছিল না, হেচাকের আলো জ্বেলেই ভোগের আয়োজন হত ।” আবার কেউ স্মৃতিচারণ করেন সত্যচরণবাবুর নাম—“ওঁর উদ্যোগ না থাকলে পুজোটা হতো না।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর বদলেছে। চাতরার চারপাশে ফ্ল্যাট বাড়ি, ব্যস্ত রাস্তা, রেলস্টেশনে মানুষের ভিড়। কিন্তু পুজোর সময় যেন সময় পিছু হটে যায়। মণ্ডপের সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, সেই ১৯০০ সালের আলো-ছায়া আবার ফিরে এসেছে। দেবীর মুখে সেই চিরন্তন রক্তবর্ণ জ্যোতি—যা সত্ত্বগুণের প্রতীক, যা মঙ্গল ও শক্তির বার্তা দেয়।
আজও যখন সন্ধ্যার পর বাতাসে ধূপের গন্ধ মেশে, তখন মনে হয়—এই শহরের হৃদয়ে এক স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে। চাতরার পাড়ায় পাড়ায় তখন জেগে ওঠে গানের সুর, “জগদ্ধাত্রী মায়া তুই আলোকধারা”—আর সেই সুরের সঙ্গে মিশে যায় শতাধিক বছরের স্মৃতি, বিশ্বাস, আর ভালোবাসা।
চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজো তাই কেবল একটি পুজো নয়—এ যেন সময়ের এক সেতুবন্ধন, যেখানে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক সূত্রে গাঁথা। যে হাত মূর্তি গড়েছিল, সে হয়তো নেই, কিন্তু তার শিল্প আজও টিকে আছে; যে চোখ প্রথম মাকে দেখেছিল, তা হয়তো মুছে গেছে, কিন্তু সেই চোখের আলো আজও দেবীর মুখে প্রতিফলিত।
No comments:
Post a Comment