Sunday, 12 October 2025

হুগলীর ডুমুরদহর বুনো কালী, ডাকাতি আর গ্রামীণ গল্প

 

হুগলীর ডুমুরদহর বুনো কালী, ডাকাতি আর গ্রামীণ গল্প

সুমন্ত বড়াল




হুগলীর বলাগড় ব্লকের গ্রামীণ জনপদ ডুমুরদহ বহু শতাব্দী ধরে ইতিহাস, লোককথা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই অঞ্চল কখনো শুধু কৃষিজমি বা মানুষের বসবাসের কেন্দ্র ছিল না; বরং এটি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঞ্চারস্থলও। তবে ডুমুরদহের খ্যাতির অন্যতম কারণ হলো এখানকার প্রাচীন কালী পূজা বুনো কালী মন্দির স্থানীয়রা এই মন্দিরকে শুধুমাত্র দেবীর আরাধনার স্থান হিসেবে নয়, বরং অতীতের এক ভয়ঙ্কর সময়ের সাক্ষী হিসেবেও মনে করেন।

বুনো কালী মন্দির স্থাপত্যের দিক থেকে কোনো চমকপ্রদ নিদর্শন নয়, এটি একতলা চারচালা স্থাপত্যে নির্মিত, আকারে প্রায় পিরামিডাকৃতি। বাইরের অংশ বেশ সাদামাটা হলেও মন্দিরের চেহারায় আধুনিক স্পর্শও পাওয়া যায়। মন্দিরের সামনে রয়েছে প্রশস্ত বাঁধানো চাতাল, যেখানে পূজার সময় ভক্তরা একত্রিত হন। প্রবেশদ্বার হিসেবে একটি তোরণ রয়েছে, যা মন্দিরটিকে এক ধরণের গম্ভীরতা প্রদান করে। সময়ের সঙ্গে মন্দিরে অনেক সংস্কার হয়েছে, কিন্তু গ্রামীণ সরলতার ছাপ এখনও অক্ষুণ্ণ।

এই মন্দিরের পূজা-পদ্ধতিও যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। এককালে এখানে পশুবলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে আধুনিক সময়ে সেই রীতি বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে, বৈষ্ণব মতে নিয়মিত পূজা হয়। তবু একটি প্রাচীন আচার এখনো টিকে আছেভক্তরা ছাগলের কান কেটে তা বেলপাতায় রেখে দেবীর উদ্দেশে নিবেদন করেন। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, এই রীতির মাধ্যমে দেবী তাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ করেন।



বুনো কালী মন্দিরের সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো ডাকাতদের সঙ্গে এর সম্পর্ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বিশে ডাকাত নামে পরিচিত বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই অঞ্চলে আতঙ্কের প্রতীক ছিলেন। তিনি ডুমুরদহেরই বাসিন্দা এবং ডাকাত দলের নেতা। স্থানীয় বয়ানে জানা যায়, বিশে ডাকাত তাঁর সহযোগীরা নৌকায় চড়ে গঙ্গার বিভিন্ন অঞ্চল ধরে যশোহর পর্যন্ত লুণ্ঠন চালাতেন। দুর্গাচরণ রায় তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “প্রায় ষাট বছর আগে বিখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথবাবু এখানে বাস করিতেন। তাহার অধীনে ডাকাইতেরা নৌকাযোগে যশোহর পর্যন্ত ডাকাতি করিয়া বেড়াইত।এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, বিশে ডাকাতের প্রভাব স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না; বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সে দাপট বিস্তার করেছিল। আজ সেই বাড়ি নেই, ডাকাত দলের অস্তিত্বও লোপ পেয়েছে, তবে তাদের নাম কাহিনী গ্রামবাসীর স্মৃতিতে অম্লান।

ডুমুরদহের জমিদার পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন রত্নেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। নবাব মুর্শিদ কুলি খানের আমলে তিনি নবাবকে ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফলস্বরূপ, নবাব তাঁকেরায়উপাধি দেন এবং সাতটি অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর এই পরিবারের উত্তরপুরুষরাও কিছু সময়ে ডাকাতি কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। তারা যখন ডাকাতিতে যেতেন, বুনো কালী মন্দিরে পূজা দিয়ে যেতেন। দেবীর আশীর্বাদ ছাড়া কোনো অভিযান শুরু হতো না। ফলে মন্দিরটি তাদের আধ্যাত্মিক আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।



মন্দিরের পাশেই একটি ভৈরব মন্দির রয়েছে। চারচালা রীতিতে নির্মিত এই মন্দিরের অনেকাংশ এখন জীর্ণ, তবে টেরাকোটার কারুকাজ এখনও চোখে পড়ে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ভৈরব কালী একসাথে গ্রামকে রক্ষা করছেন।

সমাজ-সংস্কৃতির দিক থেকেও বুনো কালী মন্দির গুরুত্বপূর্ণ। পূজার দিনগুলোয় মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তরা জড়ো হন। বাজে ঢাক-ঢোল, প্রদীপের আলো, গ্রামীণ হাট মেলাসব মিলিয়ে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এটি কেবল ধর্মীয় আবেগের কেন্দ্র নয়, সামাজিক মিলনমেলার ক্ষেত্রও। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী কালী গ্রামবাসীকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। প্রবীণরা বলেন, পূর্বপুরুষেরা রাতের আঁধারে বাইরে বের হতে সাহস করতেন না, কিন্তু মন্দিরে মানত করতেন, যাতে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ডুমুরদহের গ্রামীণ জীবন এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায়। কৃষিকাজ, বাজার, মেলাসবকিছু মন্দিরের সময়সূচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় মন্দির একটি অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী প্রভাব রাখে। কেবল আধ্যাত্মিক নয়, সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে এই মন্দির গ্রামের জন্য অপরিহার্য।



ডুমুরদহের বুনো কালী মন্দির কেবল আধ্যাত্মিক স্থান নয়; এটি বাংলার গ্রামীণ সমাজের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। ডাকাতি, জমিদারি, সামাজিক অনুষ্ঠান—all সবকিছু এখানে ফুটে উঠেছে। ডাকাত বিশে, রত্নেশ্বর রায়বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ইতিহাস, ভৈরব মন্দিরের শিল্পকলার ছোঁয়াসব মিলিয়ে এটি গবেষক ইতিহাসপিপাসু মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র।

মন্দিরের পাশে ছায়াযুক্ত গঙ্গার পাড়, হালকা বনানী, গ্রামের সরল মানুষসব মিলিয়ে একটি সময়-প্রবাহ তৈরি করে। ডাকাতদের দাপট, গ্রামীণ ভয়, দেবীর আশীর্বাদসব মিলিয়ে বুনো কালী মন্দির একটি রহস্যময়, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

আজ ডুমুরদহ শান্ত গ্রামীণ জনপদ। ডাকাতদের আর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু তাদের নাম, দেবীর গল্প এবং মন্দিরের ইতিহাস এখনো গ্রামবাসীর মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। বুনো কালী মন্দির তাই শুধু পূজাস্থল নয়; এটি গ্রামীণ বাংলার অতীত জীবনধারা, লোকবিশ্বাস এবং ইতিহাসের এক অমূল্য সাক্ষ্য।

ডুমুরদহের বুনো কালী মন্দির আমাদের শেখায়, ইতিহাসের কুৎসিত ভয়ঙ্কর দিকও কিভাবে স্থানীয় সংস্কৃতি আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে মিশে যায়। ডাকাতদের গল্প থেকে শুরু করে গ্রামের ভক্তি, সামাজিক মিলনমেলা এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসসব মিলিয়ে এটি একটি সময় স্থানকে সংরক্ষণ করে। ভক্তি, ইতিহাস, ভয়, আশীর্বাদ—all সবকিছু এখানে মিলিত হয়, এবং এটি হুগলীর বলাগড় ব্লকের গ্রামীণ জীবনের এক অমূল্য প্রতীক।

 

No comments:

Post a Comment

তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি

                            তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো...