Wednesday, 10 December 2025

তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি

                          তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি




হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো মাঠ আজ শান্ত-নির্জন গ্রামাঞ্চলের মতোই সাধারণ একটি ভূপ্রদেশ। কিন্তু ইতিহাসের ধুলো সরালে দেখা যায়, এই মাটির নিচে লুকিয়ে আছে ভয়, ভক্তি, মাতৃত্ব আর রূপান্তরের গভীর কাহিনি। একসময় এই তেলোভেলো মাঠ ছিল জলা-জঙ্গলে ঘেরা, পথিকের কাছে ভয়ের প্রতীক। কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বরের দিকে যে হাঁটা পথ ধরে সারদা মা যেতেন, সেই পথের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ ছিল এই তেলোভেলো অঞ্চল। সাপের ভয়, জনমানবহীনতা, ডাকাতদের দল আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে সন্ধ্যার পরে কেউই এই পথে চলতে চাইত না। সেই কারণেই সারদা মায়ের সঙ্গীরা চেষ্টা করতেন আলো থাকতে তেলোভেলোর মাঠ পেরিয়ে যেতে।

সেদিনও তাই হয়েছিল। সারদা মায়ের শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত, হাঁটা ভারী হয়ে আসছিল, তবুও সঙ্গীরা ভয়ের চাপে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। মা তাঁদের থামাতে চাননি। বরং শান্ত গলায় বলেছিলেন, “তোমরা তারকেশ্বরে গিয়ে উঠো, সেখানেই আবার দেখা হবে।” এই সহজ বাক্যেই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর অদম্য আত্মবিশ্বাস—যে বিশ্বাস মৃত্যু বা বিপদের হুমকিকেও পাত্তা দেয় না। সঙ্গীরা তাই এগিয়ে গেল, আর সারদা মা পিছিয়ে পড়লেন একা, এই ভয়াবহ তেলোভেলো মাঠের ঠিক মাঝখানে।

লোককাহিনি, জীবনী ও প্রবীণদের স্মৃতিচারণে মিলে যে ঘটনা উঠে আসে, তা একইসঙ্গে অলৌকিক ও মানবিক। সন্ধ্যার আলো নিভে যাওয়ার পরে মাঠের ওপর এক ধরনের রহস্যময় চাপা আঁধার নেমে আসে। এই তেলোভেলোর নির্জনতা সেই সময় ছিল ডাকাতদের অধিকারভূমি। ডাকাত সর্দারের নাম নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে—কেউ বলেন তাঁর নাম ছিল সাগর সাঁতরা, কেউ বলেন ভীম ডাকাত। স্থানীয় লোকের কাছে ‘ভীম ডাকাত’ নামটাই বেশি পরিচিত, কারণ তাঁর চেহারাই ছিল ভীমের মতো—দৈত্যাকার শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, হাতে-পায়ে লোহার বালা, কপালে রক্ততিলক, আর হাঁটার সময় লাঠির ঠকঠক শব্দ।



সারদা মা যখন ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে আগাচ্ছিলেন, তখনই নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা গেল হাড়হিম করা এক চিৎকার। অন্ধকার থেকে উঠে এলো কালো ছায়া, আর পরক্ষণেই মা চোখে দেখলেন এক বিরাটদেহী মানুষ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ডাকাত সর্দার এগিয়েই কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল—“কে তুই? কোথায় চলেছিস?” মুহূর্তটি ছিল ভয়ের পূর্ণ। যে কেউ এই অবস্থায় থরথর কাঁপত, কিন্তু সারদা মা ছিলেন সম্পূর্ণ স্থির। তিনি মৃদু স্বরে বললেন—“আমি তোমার মেয়ে গো বাবা, সারদা। দক্ষিণেশ্বর যাচ্ছি তোমার জামাইয়ের কাছে।”

মায়ের এই উত্তর আজও গবেষকদের বিস্মিত করে। কেন ‘মেয়ে’ পরিচয়? কেন ‘জামাই’ শব্দ? লোকবিশ্বাসে আছে—যখন একজন নারী অপরিচিত পুরুষের কাছে নিজেকে কন্যা পরিচয়ে উপস্থাপন করেন, তখন তার রক্ষা নিশ্চিত হয়; মাতৃত্ব ও কন্যাস্নেহের ভারেই পুরুষের হৃদয় নরম হয়ে যায়। সারদা মা শুধু পরিস্থিতি সামলাননি, তিনি মানবমনের গোপন চাবিটাকেও ব্যবহার করেছিলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।

ডাকাত সর্দারের আচরণ মুহূর্তে বদলে গেল। তাঁর হৃদয়ের কঠিন আবরণ যেন সরে গেল। সারদা মায়ের শান্ত স্বর, তাঁর আত্মবিশ্বাস আর তাঁর চোখের অটল সাহস ভীম ডাকাতকে স্তব্ধ করে দেয়। জনশ্রুতি বলে—ঠিক তখনই মাঠে অদ্ভুত এক আলো দেখা যায়। মা মনে করেছিলেন, যেন জগতজননী তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভয়ের শূন্যতার জায়গায় আসে দেবত্বের প্রতিরোধশক্তি। এই দৃশ্য ভীমকে অভিভূত করে। সে হঠাৎ মায়ের হাত দু’টি ধরে বলল—“মা, তুমি একা এখানে কীভাবে? এত অন্ধকারে ভয় লাগছিল না?”



মা মৃদু হাসলেন। বললেন—“সঙ্গীরা সবাই এগিয়ে গেছে। শরীরটা আজ ভালো যাচ্ছে না। তুমি এলে বলেই পথ পেলাম।” সেই মুহূর্তে ভীম ডাকাতের ভিতরের মানুষ জেগে উঠল। ডাকাত নয়—সে যেন এক সহজ-সরল গৃহস্থ পুত্র হয়ে গেল। তখনই ডাকাত সর্দারের স্ত্রী এগিয়ে এলেন। তিনিও সারদা মাকে ‘মেয়ে’র চোখে দেখে বাড়িতে নিয়ে যেতে জোর করলেন। ডাকাত দম্পতির ঘর ছিল খুবই সাধারণ—মাটির মেঝে, দাওয়ায় তক্তা রাখা শোবার স্থান, পাশে গাছ-পালায় ঘেরা উঠোন। তারা সেই রাতে মায়ের বিশ্রামের জন্য আলাদা বিছানা করে দিল, খেতে দিল মুড়ি, মুড়কি, চালভাজা—যা ছিল তাদের ঘরে সহজলভ্য। কিন্তু এই খাদ্যই পরে হয়ে উঠল তেলোভেলোর সারদা মায়ের নিত্যভোগ।

রাতটি কেটে গেল সম্পূর্ণ অন্য আবহে। একটি ডাকাত পরিবারে সারদা মা এমন স্নেহে, এমন আদরে থাকলেন, যা পরে পরিণত হয় ঐতিহাসিক রূপান্তরের ভিত্তিতে। ভোর হতেই ভীম ডাকাত নিজে মাকে পথ দেখিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দিকে এগিয়ে দিলেন। কেউ কেউ বলেন—তিনি অনেকদূর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে হেঁটে গিয়েছিলেন। এই হাঁটা পথেই তাঁর জীবনে আসে সেই পরিবর্তন, যার সাক্ষী আজও তেলোভেলো গ্রাম।

এই ঘটনার পর ভীম ডাকাতের জীবনে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, সেই রাতের আলো, সারদা মায়ের মমতা আর তাঁর ‘মেয়ে’ রূপ ভীমের জীবনের গতি বদলে দিয়েছিল। সারদা মা চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজ হাতে মায়ের প্রতিষ্ঠা দেন তাঁর এলাকায়। মেয়ে রূপে দেখা সেই সারদা মাকে পূজা করার জন্য নির্মিত হয় একটি ছোট দেবস্থান। কোনও অলংকার, কোনও জাঁকজমক নয়—খুব সাধারণ কাঠামো, কাঁচা ইট ও মাটি দিয়ে গড়া, কিন্তু বিশ্বাসের ভিত ছিল অকল্পনীয়ভাবে দৃঢ়। এখানেই শুরু হয় ‘সারদা মা’ নামে মায়ের এক অনন্য লোকপূর্ণ প্রতিষ্ঠা।

পরে এই স্থানে কালীমূর্তি স্থাপিত হলেও, স্থানীয় মানুষ এই দেবীকে কালী বলে ডাকে না। তাঁরা বলেন ‘সারদা মা’—মেয়ে, মা, রক্ষাকর্ত্রী, পরিবারসম কৃপাবানী দেবী। মায়ের রূপের সঙ্গে কালীপ্রতিমার মিলনে তৈরি হয় এক অদ্ভুত দ্বৈততা—কালীর শক্তি, সারদার মমতা। এই বিশেষ দ্বৈতধর্মী রূপ আঞ্চলিক লোকধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গবেষকরা বলেন—এটি বাংলার ‘মাতৃভক্তি’ ঐতিহ্যের এক দৃঢ় দৃষ্টান্ত, যেখানে দেবী একইসঙ্গে ভক্তকে ভয় থেকে রক্ষা করেন এবং অপরাধীকে সৎ পথে ফেরান।

তেলোভেলোর এই সারদা মা–কালীপূজা আজও বিশিষ্ট। পূজার দিনে রক্তচন্দনের প্রলেপ দেওয়া হয় প্রতিমার পায়ে। ভক্তরা অর্পণ করেন ধূপ, দীপ, ফুল, ফল, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোগ হলো—মুড়ি, মুড়কি আর চালভাজা। কারণ সেই প্রথম রাতে ভীম ডাকাতের ঘরে সারদা মা এই খাবারই গ্রহণ করেছিলেন। লোকবিশ্বাসে আছে—মা কখনো অস্বীকার করেন না স্নেহের প্রথম দান। তাঁর কাছে এই ভোগ কেবল খাদ্য নয়; এটি স্মৃতি, রক্ষা, এবং রূপান্তরের চিহ্ন।

এই অঞ্চলের বয়স্ক মানুষেরা বলেন—ভীম ডাকাত পরবর্তীকালে আর কোনও অপরাধ করেননি। কেউ কেউ দাবি করেন, তাঁর আত্মা এখনও মন্দির পাহারা দেয়। রাতের বেলা বটগাছের নিচে কখনো ছায়ামূর্তি দেখা যায়, কখনো মৃদু পায়ের শব্দ শোনা যায়। এসব বিশ্বাস গবেষকদের কাছে লোকবিশ্বাসের স্বাভাবিক সম্প্রসারণ হলেও গ্রামের মানুষের কাছে এটি বাস্তব। তাদের মতে, ভীম ডাকাতের অপরাধীসত্তা সারদা মায়ের মমতায় গলে গিয়েছিল। এখন তিনি মায়ের পাহারাদার, মায়ের পথরক্ষক।

গ্রামজুড়ে এই কাহিনি আজও নতুন প্রজন্মকে শোনানো হয়। মায়াপুর অঞ্চলের চাষিরা, গৃহিণীরা, বয়স্ক মানুষ, এমনকি শিশুরাও জানে—একদিন এই তেলোভেলো মাঠে মা নিজে পা রেখেছিলেন। তাঁর করুণাময় দৃষ্টি এক ডাকাতকে মানুষ বানিয়েছিল, আর তাঁর ভক্তি এই জনপদকে আশ্রয় দিয়েছিল। তাই তেলোভেলোর মানুষ আজও বলে—“সারদা মা রাগ করেন না, তিনি পথ দেখান।” এই পথচলাতেই ভয় মিলিয়ে যায় ভক্তির আলোয়।

এই কাহিনি কেবল লোকবিশ্বাস নয়, এটি বাংলার লোকধর্মের গভীর গঠনপ্রক্রিয়ার অংশ। যেখানে দেবী কেবল অলৌকিক শক্তি নন, তিনি মা—যাঁর কাছে অপরাধীও সন্তানের মতো, আর সন্তানই তাঁর আশ্রয়। তেলোভেলোর সারদা মা সেই বিশ্বাসেরই প্রতীক।

সুমন্ত বড়াল



Wednesday, 19 November 2025

কার্তিকের লড়াই-শহর কাটোয়া : লোকবিশ্বাসের গোপন সরণি

কার্তিকের লড়াই-শহর কাটোয়া : লোকবিশ্বাসের গোপন সরণি

                                                                                                                               



 কাটোয়া শহরটার প্রতি একটা আলগা টান বহুদিনের। তার কারণ অবশ্যই শুভঙ্কর—এই শহরের রাস্তাঘাট নিয়ে যার অসীম গর্ব, আর স্বপন স্যার—যার কথায় ইতিহাস যেন বইয়ের পাতা ছেড়ে মানুষের মুখে নেমে আসে। কাটোয়া মানেই আমার মনে এই দু’জন মানুষ। কতবার যে ওদের মুখে শুনেছি কাটোয়ার কার্তিকের গল্প, হিসেব নেই। চুচড়ায় লড়াই কার্তিকের নিদর্শন মিললেও কার্তিকের লড়াই যে শুধু কাটোয়াতেই, তা তাদের মুখে শোনাই যেন বিশ্বাসের সীলমোহর। এত জায়গায় যাই, এত কিছু দেখি—আর এটা দেখব না! শেষমেশ ইচ্ছে প্রকাশ করলাম সুদেষ্ণার কাছে। সারাদিন আমার মুখে কার্তিক-কার্তিক শুনে তার রাজি না হয়ে উপায় কোথায়!

অগ্রহায়ণের প্রথম দিন। ভোরের কুয়াশা তখনও রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। ঘুমঘুম অন্ধকারে চায়ের দোকানের প্রথম ধোঁয়া উঠছে, দূরে রেলের লাইন ধরে শব্দ কাঁপছে। আমরা বেরিয়ে পড়েছি—আজ লড়াই দেখব। সেই বহু কালের শোনা ‘কার্তিক লড়াই’-এর সঙ্গে দেখা হবে অবশেষে। মনে যেন পুজোর চেয়ে কম উত্তেজনা নেই।

দেবসেনাপতি কার্তিকের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক আশ্চর্য প্রতিমা—সুঠাম শরীর, বাবরি চুল, সরু গোঁফ, দুধে-আলতা মেশানো দীপ্তিময় গাত্রবর্ণ। তাঁর হাতে যুদ্ধাস্ত্র তীর-ধনুক, যেন উন্মুখ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছেন এক বীর যোদ্ধা। অথচ আশ্চর্য—ঋগ্বেদে এই দেবতার নামই নেই! অথর্ববেদে পাওয়া যায় ‘কুমার’ নামে এক অগ্নিদেবতার উল্লেখ, যিনি বৈদিক যুগের শেষ পর্বে ক্রমে শৈবসাধনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওঠেন। আর সেই যোগসূত্রেই কুমার পরিণত হন শিবপুত্র স্কন্দে—বিশাখে—অবশেষে আমাদের পরিচিত কার্তিকে।



মহাভারতে কার্তিকের আরও এক রূপ দেখা যায়। বলা হয়, ছয় ঋষিপত্নীকে তিনি মা বলে গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা কৃত্তিকা নামে পরিচিত। তাই তাঁর নাম হয় কার্তিক। গবেষকদের অনেকেই মনে করেন, কার্তিক মূলত লোকজ স্তর থেকে উঠে আসা দেবতা। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে তাঁকে বলা হয়েছে ‘ভয়ংকর লৌকিক দেবতা’। যুদ্ধদেবতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি বহুল পরিচিত, কিন্তু তাঁর নামের মূলেই আছে কৃষি-সংস্কৃতির আদল—সংস্কৃত ‘স্কন্ন’ শব্দ থেকে আসা স্কন্দ, যার অর্থ বীজ বা বীর্য, অর্থাৎ শক্তি, সাহস, উদ্যম। একসময়ে চোর-ডাকাতদের রক্ষাকর্তা হিসেবেও কার্তিকের পূজা হতো, যা তাঁর বহুবর্ণ চরিত্রকে আরও স্পষ্ট করে।

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে পুন্ড্রবর্ধন—আধুনিক উত্তরবঙ্গ—ঘরে ঘরে কার্তিকপুজোর প্রচলন ছিল বলে কহলনের রাজতরঙ্গিণী থেকে জানা যায়। বাংলার প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি মালদহেও এর গুরুত্ব ছিল প্রবল। সাহাবাড়ির চতুর্ভুজ বাঁকিবিহারিলালের কার্তিকপুজো তারই অন্যতম নিদর্শন। এই পরিবারের এক আকর্ষণীয় প্রথা হলো—পরিবারে প্রথম পুত্রসন্তান জন্মালে দেবপ্রতিমায় একটি অতিরিক্ত কার্তিক সংযোজন। যেন আনন্দের পরিমাণ প্রতিমাতেই লিপিবদ্ধ থাকে।

মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি ও বেলডাঙা, বাঁকুড়ার সোনামুখি, হুগলির বাঁশবেড়িয়া—এ সব অঞ্চলেও কার্তিকপুজো আজও উচ্ছ্বাসমুখর। বাঁশবেড়িয়া-ত্রিবেণীতে বহু গৃহস্থবাড়িতে পূজার দিন শিশু-রূপে কার্তিকের উপাসনা চলে। কার্তিক সেখানে দেবতার চেয়েও বেশি—সে পরিবারের ছেলে, ঘরের সন্তান।



তবে দক্ষিণবঙ্গে কার্তিকপুজোর যে রূপ সবচেয়ে আলাদা, সবচেয়ে নাটকীয়—তা কাটোয়াতেই। ‘কার্তিক লড়াই’ নামে তার পরিচিতি। লোকশ্রুতি বলে, এক সময় বারবিলাসিনীদের পুজো আর শহরের জমিদারদের পুজোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। ন্যাঙটো কার্তিকের উপাসনা থেকেই নাকি এই লড়াইয়ের উৎপত্তি। যদিও কাটোয়ার খ্রিস্টান মিশনারিদের লেখায় কিংবা নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাটোয়ার ইতিহাস-এ এ নিয়ে কোনও প্রাচীন তথ্য নেই। ক্ষেত্রসমীক্ষা ও লোকগবেষণা বরং নির্দেশ করে ভিন্ন উৎসের দিকে—কাটোয়ার ‘থাকা পুজো’র দিকে।

কাটোয়ার প্রাচীনতম জনপদগুলির মধ্যে অন্যতম তাঁতিপাড়া। এখানে আজও ধর্মরাজের থান, বর্গি হাঙ্গামার স্মৃতিবাহী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দির—আর সাতভাই রাজার ‘থাকা’ কার্তিক আছে। কাটোয়ার লোকসংস্কৃতিকে বুঝতে হলে ‘থাকা’ শব্দটির গভীরে ঢুকতেই হয়। কারণ এই ‘থাকা’—বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশাল ত্রিভুজাকৃতি এক কাঠামো—কার্তিকপুজোর প্রাণ।

সাধারণত বহু প্রতিমা এক সঙ্গে স্থাপন করতে হলে ‘চালি’ লাগে। দুর্গার একচালিমূর্তি তার উদাহরণ। কিন্তু যখন প্রতিমার সংখ্যা ত্রিশের কাছাকাছি হয়, তখন ছোট পরিসরে চালিতে ফিট করানো অসম্ভব। তখনই কাজে লাগে এই বিশেষ প্রযুক্তিতে নির্মিত বাঁশের ‘থাকা’—যা দেখতে অনেকটা সিঁড়ির মতো। উচ্চতা পনেরো থেকে কুড়ি ফুট, চওড়া মাত্র ছয়-সাত ফুট, কিন্তু স্তর ধরে ত্রিশেরও বেশি পুতুল এতে সহজেই সাজানো যায়।



আনুমানিক আঠারো শতকের দিকে থাকার উদ্ভব। প্রথম দিকে কাঠামো ছিল ছোট, পরে ধীরে ধীরে রূপান্তর ঘটে। যাত্রাশিল্পের প্রভাবও পড়ে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ মিলিয়ে বিশাল নাট্যবুনন তৈরি হয় এই বাঁশের গ্যালারিতে। বকাসুর বধ, সীতার বিবাহ, রামের বনবাস, কৃষ্ণের জন্ম, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ—সব ফুটে ওঠে মৃৎপুতুলের শরীরে। একজন কাঠামোশিল্পী, একজন পোশাকশিল্পী, একজন নির্দেশক মিলে তৈরি হয় থাকা মঞ্চ। আর সবার উপরে দেবী জগদ্ধাত্রী—কাত্যায়নী—কোলে শিশু কার্তিক। দু’পাশে নৃত্যরত সখীরা। নিচে ধাপে ধাপে সাজানো নাট্যকাহিনি।



এ এক অনন্য লোকপ্রযুক্তি, যা সারাবাংলায় একমাত্র কাটোয়া-দাঁইহাট অঞ্চলে টিকে আছে। তাঁতিপাড়ার সাতভাই কার্তিকের সাত পুতুলের বিন্যাসে তার আদিম রূপও দেখা যায়।

বিশ শতকের গোড়ায় জমিদার ও ব্যবসাদাররা এই থাকা কেন্দ্র করে পুজোয় প্রতিযোগিতা শুরু করেন। কার থাকার পোশাক ভালো, কার কাঠামো চমকপ্রদ, কার নাট্যরূপক বেশি দর্শক টানবে—এই নিয়ে শুরু হয় ‘লড়াই’। এবং ধীরে ধীরে তা শহরের উৎসবে পরিণত হয়। সন্ধ্যা নামলেই চার দিক আলোয় ভরে যেত। পাড়ার ছেলেদের দল দলে থাকা দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা এমন ছিল যে ফাল্গুনের দোলের মতো আলোড়ন শহরের গলিপথে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকা কমে এসেছে। বাঁশের কাঠামো তৈরির শ্রম কমে গেছে, শিল্পীদের অভাব, থিমের ক্রমবর্ধমান প্রভাব—সব মিলিয়ে নতুন যুগ কাটোয়ার কার্তিককে অন্য রূপে সাজিয়েছে। ফাইবার, আলো, সাউন্ড—এসব মিলিয়ে থিম আজ জনপ্রিয়। তবুও যে ক’টি থাকা এখনো টিকে আছে, তারা যেন পুরনো কাটোয়ার স্মৃতিস্তম্ভ—নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের বিজড়িত নিদর্শন।

সেদিন কাটোয়ার পথে যেতে-যেতে মনে হচ্ছিল, কত যুগের লোকবিশ্বাস, কত মানুষের অপেক্ষা, কত শিল্পীর ঘাম, মাটি আর বাঁশের স্পর্শ মিলেমিশে গড়ে উঠেছে এই লড়াই। ট্রেনের কেবিনে কুয়াশার ভেতর ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল শহরের আলো। মনে হচ্ছিল, কার্তিক যেন কোথাও থেকে হাত নেড়ে বলছেন—

“এসো, আজ লড়াই দেখবে তো?”

সু.ব ... 

Sunday, 16 November 2025

বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক ইতিহাস, লোকবিশ্বাস ও রূপবৈচিত্র্যের এক অনন্ত উৎসব

 

বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক ইতিহাস, লোকবিশ্বাস ও রূপবৈচিত্র্যের এক অনন্ত উৎসব




'কুন্ডু কাঁসারি উদেরে
তিন নিয়ে বাঁশেবেড়ে।'

হুগলি জেলার প্রাচীন জনপদ বাঁশবেড়িয়াকে ঘিরে এই লোকপ্রবাদটি আজও শোনা যায়। বিস্ময়ের বিষয়, প্রবাদে উল্লিখিত শঙ্খবণিক, কংসবণিক বা কাঁসারি, গন্ধবণিক, তিলি—এই সব বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ আজও এই মফস্বল শহরেই বসবাস করেন। ইতিহাসখ্যাত সপ্তগ্রাম বন্দরের সাত গ্রামের মধ্যে অন্যতম ছিল এই বাঁশবেড়িয়া—যাকে অতীতে বলা হত বংশবাটি। হুগলি নদীর ধার ঘেঁষে থাকা এই জনপদ শুধু ইতিহাস নয়, ধর্মীয় ও লোকবিশ্বাসের দিক থেকেও সমৃদ্ধ। এখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত হংসেশ্বরী মন্দির; আর এখানকার কার্তিক পুজো তো বহু শতাব্দীর গর্ব।

বাঁশবেড়িয়ার ধর্মজীবনে দেবসেনাপতি কার্তিকের আরাধনা প্রায় পাঁচ শতক পুরনো। শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত—যেখানে তাকানো যায়, দেখা মেলে নানা রঙের, নানা বেশের, নানা নামের কার্তিক। কোথাও তিনি রাজা, কোথাও জামাই; কোথাও ধুমো বাবা, কোথাও জ্যাংড়া। কার্তিক সংক্রান্তির দিন এই জনপদ উৎসবের আলোয় গুঞ্জরিত হয়। কার্তিকের রূপবৈচিত্র্যই যেন এখানে এক প্রাচীন লোকনাট্যের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস, পুরাণ, লোককথা, ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা—সব মিলিয়ে বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক পুজো সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে আজও অটুট।

সপ্তগ্রাম—যেখানে শুরু হয়েছিল গল্প

কার্তিক পুজোর ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় মধ্যযুগের বঙ্গদেশে। তখন বাংলার সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও ছিল দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রধান বন্দর। শুধু বন্দরই নয়—সেই যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরীও ছিল এটি। সাতটি জনপদ—বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বচোরা ও বলদঘাটি—এই সাত গ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সপ্তগ্রামের ঐশ্বর্য। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ষোড়শ বণিকের যে উল্লেখ পাওয়া যায়—জয়পতি, সোমশ্রীধর, শূলপাণি, মেঘ, রাজারাম, শ্রীপতি, কমলাকান্ত, গুণাকর, গণেশ্বর, বাণেশ্বর, হরিহর, হিরণ্য, দিবাকর, পুরন্দর, মহানন্দ—তাঁরা সকলেই সপ্তগ্রামের বণিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি।

এ থেকেই সহজেই অনুমান করা যায়, মধ্যযুগে সপ্তগ্রাম তথা বাঁশবেড়িয়ায় এক অভিজাত বণিকশ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল। বণিক সম্প্রদায়ের সেই ঐতিহাসিক প্রভাবেই বাঁশবেড়িয়ায় কার্তিক পুজোর সূচনা। "সুবর্ণ বণিক" পত্রিকায় উল্লেখ রয়েছে—প্রায় ১৬০০ সন থেকে ব্যবসায়ী ও মহাজনবর্গের উদ্যোগে এখানে কার্তিক পুজোর প্রচলন শুরু হয়।

বণিকেরা কেন পূজলেন কার্তিক দেবসেনাপতি?

এই প্রশ্ন বহুদিন ধরেই গবেষকদের ভাবিয়েছে। সুধীর কুমার মিত্র লিখেছেন—কার্তিক পূজার দুটি মূল দিক রয়েছে। প্রথমত, দেবসেনাপতি সাহসের প্রতীক—তাঁর উপাসনায় সাহস, বল ও রক্ষার আকাঙ্ক্ষা নিহিত। দ্বিতীয়ত, ‘ফার্টিলিটি’ বা প্রজননের আশীর্বাদলাভের উদ্দেশ্যে এই পূজা বাংলায় প্রচলিত হয়। চুঁচুড়ায় ওলন্দাজদের কার্তিকপূজা-প্রীতি এই প্রেক্ষাপটকে আরও সমর্থন করে। চুঁচুড়ার প্রতিবেশী বাঁশবেড়িয়ায় ব্যবসায়ী ও মহাজনদের মধ্যে বহু নিঃসন্তান পরিবার ছিল—অতএব উত্তরসূরীর আশায় তাঁরা দেবসেনাপতির আরাধনায় ব্রতী হন।

সপ্তগ্রাম বন্দর আজ ডুবে গেছে সময়ের নদীতে, কিন্তু বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক পুজো টিকে আছে। বরং আজ তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন, আড়ম্বরময় এবং লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রদর্শনী।

বাংলায় কার্তিক—লৌকিক দেবতার পথচলা

কার্তিক দক্ষিণ ভারতের মুরুগান; তাঁর স্ত্রী দেবসেনা—যিনি দেবী ষষ্ঠীর রূপ। ষষ্ঠী প্রজনন ও শিশু রক্ষার দেবী; তাই কার্তিকও প্রজনন ও সুরক্ষার দেবতা। পুরাণে কার্তিকেয়, স্কন্দ, শাখনৈগমেয়, মহাসেন—অসংখ্য নামে পরিচিত তিনি। শত্রুজয়ের দেবতা, যোদ্ধাদের ইষ্ট, শস্যদেবতা, আবার কোথাও কামুক, কোথাও যোগী। বৌধায়ন ধর্মসূত্র, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, নারায়ণ উপনিষদ, পতঞ্জলির মহাভাষ্যে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। বিষ্ণুধর্মোত্তরে তিনি ষড়ানন, লাল বস্ত্রে সজ্জিত, ময়ূরবাহনে উপবিষ্ট। কোথাও কোথাও কুক্কুট বা মোরগও তাঁর বাহন।

এই অনন্ত রূপই বাঁশবেড়িয়ার কার্তিকে নানা নামে, নানা ভঙ্গিমায় ধরা পড়ে।

 


আদি বাবা ধুমো কার্তিক—বাঁশবেড়িয়ার প্রাচীন দেব

সাহাগঞ্জ অঞ্চলের আদি বাবা বা ধুমো কার্তিক—এই জনপদের সবচেয়ে প্রাচীন ও ব্যতিক্রমী দেবরূপ।
প্রায় ১৮–২০ ফুট উচ্চতার এই মূর্তি কালীঘাটের পটচিত্রের কার্তিকের মতোই রূপায়িত। গায়ের রং হলুদ, মুখে বয়স্ক পুরুষের মতো গোফ, কাঁধে চাদর, লুঙ্গি বা ধুতি—রূপটি যেন পরিবারের প্রবীণ কর্তার। ‘ধুমো’ শব্দটি অভিধানে না থাকলেও ‘ধুম্ব মিনসে’—বড়দেহী, বয়স্ক পুরুষ—এই আঞ্চলিক উচ্চারণ মূর্তির রূপকেই স্মরণ করায়।

আদিবাবার দুই পাশে থাকেন দুই ‘সিপাহী’—মাটির দুই প্রহরী। পুলিশের মতো পোশাক, হাতে লাঠি—যেন দেবতার নিরাপত্তারক্ষী। প্রচলিত মতে, সাহাগঞ্জের নন্দীবাড়ি এই পুজোর প্রথম উদ্যোক্তা। আজ তা বারোয়ারি পুজোয় পরিণত হয়েছে, কিন্তু প্রাচীনতার গাম্ভীর্য এখনও অটুট।

 

জ্যাংড়া কার্তিক—যোদ্ধা দেবতার রণরূপ

বাঁশবেড়িয়ার সাহাগঞ্জ অঞ্চলের জ্যাংড়া কার্তিক আরও এক অনন্য অধ্যায়। ‘যৌধেয়’ জনজাতির সঙ্গে এই নাম ও রূপের যোগ রয়েছে—উত্তর ভারতের এই জনজাতি যুদ্ধশক্তির জন্য বিখ্যাত ছিল এবং তাঁদের আরাধ্য দেবতা ছিলেন রণসজ্জিত দেবসেনাপতি।

জ্যাংড়া কার্তিকের মূর্তি সত্যিই সেই রণগৌরবকে বহন করে—রাজকীয় পোশাক, বিশাল তীর-ধনুক, বিস্ফোরিত নয়ন, মোটা গোফ, ক্ষত্রিয়ের ঔজ্জ্বল্য। গায়ের রঙ হলুদ, বাহনে ময়ূর—কিন্তু তাঁর পদক্ষেপ অশ্বারোহীর ভঙ্গিমায়। অভিধান বলে—‘জাঙ্গড়া’ মানে অশ্বারোহী; তাই নামকরণ একেবারেই স্বাভাবিক।

দুই পাশে দাঁড়ানো থাকে খয়েরি রঙের দুটি দেহাতি আকৃতির মূর্তি—যেন জনজাতির প্রতিনিধি যোদ্ধারা।

প্রায় ২৯১ বছর ধরে সাহাগঞ্জের ধর্মরাজতলায় এই পুজো হয়ে আসছে। প্রসাদ হিসেবে থাকে জিলিপি; এমনকি ময়ূরের মুখেও থাকে বিশাল জিলিপি! তাই স্থানীয়দের কাছে তিনি ‘জিলিপি কার্তিক’ নামেও খ্যাত।



রাজা কার্তিক—ওলন্দাজ পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা রাজসিক দেবরূপ

বাঁশবেড়িয়া-সাহাগঞ্জ অঞ্চলে বহু রাজা কার্তিক থাকলেও সবচেয়ে ঐতিহাসিক হলো নতুন পোস্ট অফিস এলাকার কার্তিক। প্রায় ৩৭৮ বছরের ঐতিহ্য। একসময় এই অঞ্চল ছিল ওলন্দাজ উপনিবেশ; তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬৪৬ সালে এই পুজোর সূচনা।

এই মূর্তি রাজসিকতার প্রতিমূর্তি—সিংহাসনে উপবিষ্ট, মাথায় স্বর্ণমুকুট, কণ্ঠে অলংকার, সামনে একজোড়া ময়ূর যাদের ডানা দেবতার প্রভামণ্ডল গঠন করেছে। পাশে দণ্ডায়মান সখীরা চামর দোলাচ্ছেন। মুখের সুদৃশ্য গোফ বাংলার জমিদারদের স্মরণ করায়। কেউ কেউ তাঁকে মহারাজ নন্দকুমার বা রাজা রামমোহনের প্রতিমূর্তি বলেও ভাবেন।

স্থানীয়দের চেষ্টায় তাঁর জৌলুস বছরে বছরে বেড়েছে—এমনকি তাঁর নামে দেবোত্তর জমিও রয়েছে।

 


জামাই কার্তিক—বাঁশবেড়িয়ার নিজস্ব লোককল্পনা

রাজা কার্তিকের পাশাপাশি বাঁশবেড়িয়ার বিখ্যাত আরেক রূপ—জামাই কার্তিক। বিশেষত রথতলা ও জামাইগলির পুজো উল্লেখযোগ্য। প্রায় পঞ্চাশ বছরের নবীন পুজো হলেও সাজসজ্জার অভিনবত্বে এর জনপ্রিয়তা বিপুল।

এখানে কার্তিক সিংহাসনে বা ময়ূরবাহনে নন—ফুলসজ্জার খাটে বসে। হাতে গোলাপ। খাট সাজানো রজনীগন্ধার শয্যার মতো। ময়ূর কখনও খাটে, কখনও নীচে। রূপের এই ঘরোয়া কোমলতা তাঁকে বাকিদের থেকে আলাদা করে।

 

সিপাহী কার্তিক—হংসেশ্বরী মোড়ের প্রাচীন প্রতিচ্ছবি

হংসেশ্বরী মোড়ের সিপাহী কার্তিক প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো। আদিবাবার সঙ্গে রূপগত মিল থাকলেও এখানে উচ্চতা কিছু কম। ময়ূরের মুখে বিশাল জিলিপি—এটাই এই পুজোর বিশেষত্ব।

ষড়ানন, অর্জুন ও অন্যান্য রূপ—বাঁশবেড়িয়ার অনন্ত বৈচিত্র্য

ধোপাঘাট, সাহাগঞ্জের কেওটা অঞ্চলে অর্জুন কার্তিক, খামারপাড়ার কুণ্ডুগলর ষড়ানন কার্তিক—সব মিলে বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক উৎসব এক বিশাল লোকশিল্পের মাঠ।

কার্তিক সংক্রান্তি থেকে চার দিন ধরে শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে দেবসেনাপতির ভিন্ন ভিন্ন রূপে আরাধনা চলে। প্যান্ডেল, আলোকসজ্জা, প্রতিমা—সবই অসাধারণ। শুধু কার্তিক নন—এই সময়ে বহু বারোয়ারিতে শিব, পার্বতী, নারায়ণ, তারা, সন্তোষী মা, কমলা মাতা, অর্ধনারীশ্বর, সতীর দেহদান, এমনকি ভারত মাতা বা দশানন—বহু ব্যতিক্রমী প্রতিমার উপাসনা হয়।

বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক উৎসব তাই শুধু পুজো নয়—এক বিশাল সামষ্টিক লোকজ-ঐতিহ্যের নাট্যমঞ্চ।

শেষ কথা

বিসর্জনের শোভাযাত্রা যেমন চোখ ধাঁধায়, তেমনি মনও ভরে ওঠে এই ভাবনায়—দেবসেনাপতি হিসেবে যিনি মূলত দক্ষিণ ভারতের দেবতা, তিনি বাঙালির ঘরে এমন কত রূপে পূজিত! হয়তো বাঙালি যোদ্ধা নয়—‘দুধে-ভাতে’ থাকা তার সহজ স্বভাব। তাই কার্তিক এখানে কখনও রাজা, কখনও বাবু, কখনও জামাই—লোকজ কল্পনা, ইতিহাস আর বণিকদের স্মৃতি মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য দেবজগৎ।

হুগলির এই প্রাচীন জনপদ বাঁশবেড়িয়া তাই শুধু ইতিহাস নয়—লোকধর্ম, উৎসব, রূপকল্প আর মানুষের চিরন্তন আশা-অভিলাষের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। কার্তিকের নানা রূপ সেই গল্পই যেন বারবার ফিরে ফিরে শোনায়।

 

Thursday, 30 October 2025

“মাছের ভোগেই তুষ্ট নরসিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী”

 

“মাছের ভোগেই তুষ্ট নরসিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী”

সুমন্ত বড়াল



 

সেন যুগে এই এলাকার নাম ছিল ধার্য গ্রাম। পরে বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথি ও দলিলপত্রে এই জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায় ধাঁইগ্রাম নামে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই নামেরও পরিবর্তন ঘটে। স্থানীয় জনশ্রুতি বলে, প্রাচীন কালের এক জাগ্রত জগদ্ধাত্রী দেবীর নাম থেকেই গ্রামটির বর্তমান নাম ধাত্রীগ্রাম।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার অন্তর্গত এই ধাত্রীগ্রাম একটি ছোট হলেও ঐতিহ্যবাহী জনপদ। এই গ্রামেই তিন শতাব্দী ধরে পালিত হয়ে আসছে এক বিশেষ জগদ্ধাত্রী পুজো, যা আজও ভক্তদের কাছে এক গভীর আস্থার প্রতীক। একসময় এই পুজো ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক, পরে সময়ের প্রবাহে তা সর্বজনীন রূপ নেয়। আজ এটি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, ধাত্রীগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবেই পরিচিত।

জনশ্রুতি আছে, স্বয়ং ধাত্রীমাতা জগদ্ধাত্রীর নাম থেকেই এই জনপদের নাম “ধাত্রীগ্রাম”। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন—দেবীর পূজা এখানকার চন্দ্রপতি গোষ্ঠীর এক বংশধর পণ্ডিত রামচন্দ্র তর্কসিদ্ধান্তের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল। প্রায় তিনশো বছর আগে চন্দ্রপতি পরিবার নদীয়া জেলার ব্রহ্মশাসন থেকে এসে ধাত্রীগ্রামে বসতি স্থাপন করে। তাঁদেরই মধ্যে পণ্ডিত রামচন্দ্র ছিলেন অগাধ সংস্কৃতজ্ঞ, যিনি এখানে একাধিক টোল প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃত শিক্ষার প্রসার ঘটান। নদিয়ার নবদ্বীপ, মেদিনীপুর কিংবা হুগলি থেকে ছাত্ররা তাঁর কাছে বিদ্যা অর্জনের জন্য আসতেন।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, এক রাতে রামচন্দ্র তর্কসিদ্ধান্ত স্বপ্নাদেশ পান—মায়ের নির্দেশ, “আমার আরাধনা শুরু করো।” সেই স্বপ্নাদেশ থেকেই ধাত্রীগ্রামে জগদ্ধাত্রীর পুজো শুরু হয়। পুজোটি প্রথমে ছিল পারিবারিক পরিসরে, তবে ক্রমে ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র অঞ্চলে। আজ এই পুজোই ধাত্রীগ্রামের প্রধান উৎসব।

এই জগদ্ধাত্রী দেবীর রূপ অন্যান্য অঞ্চলের দেবীমূর্তির থেকে একেবারে আলাদা। সাধারণত জগদ্ধাত্রী সিংহবাহিনী রূপে পূজিতা হন, কিন্তু ধাত্রীগ্রামে দেবী নরসিংহবাহিনী। প্রতিমার মুখশ্রী শান্ত, অথচ দৃষ্টিতে দৃঢ়তা। হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও তীর। স্থানীয় প্রবীণরা মনে করেন, এই বিশেষ রূপের পেছনে কোনও পৌরাণিক তাৎপর্য রয়েছে—এখানে দেবী জগদ্ধাত্রী কেবল জগৎধাত্রী নন, তিনি শক্তির রূপে নরসিংহের উপর অধিষ্ঠিত, অর্থাৎ পুরুষতত্ত্বের উপর মাতৃশক্তির আধিপত্যের প্রতীক।



এই পুজো চলে দু দিন —নবমী ও দশমী। নবমীর দিনটিই ধাত্রীগ্রামের মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন সকালে শুরু হয় দেবীর ভোগরান্না। এখানকার জগদ্ধাত্রী পুজোর অন্যতম আকর্ষণ এই ভোগই। স্থানীয় বিশ্বাস, দেবী জগদ্ধাত্রী মাছে-ভাতে সন্তুষ্ট হন। তাই তাঁর ভোগে থাকে বাঙালির পরম ঐতিহ্য—বাসমতি চালের খিচুড়ি, তেরো রকমের ভাজা, নানা সবজি, পায়েস, আর নানা রকম মাছের প্রস্তুতি। এই ভোগেই যেন প্রতিফলিত হয় বাংলার গ্রামীণ জীবনের রসনা ও ভক্তির মেলবন্ধন।

 

ভোগ রান্না শেষে মালসা করে দেবীর প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সকাল থেকেই ভক্তদের লম্বা লাইন পড়ে। কেউ ফুল হাতে, কেউ কলাপাতায় ভোগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন দেবীর আশীর্বাদের আশায়। গ্রামজুড়ে তখন এক শান্ত অথচ উচ্ছ্বাসময় পরিবেশ।

 

নবমীর দিনই এখানে সপ্তমী ও অষ্টমীর পুজো সম্পন্ন করার রীতি রয়েছে। পুজোর যাবতীয় আচার এখনো চলে পুরোনো নিয়ম মেনে। এখনো মন্ত্রোচ্চারণ হয় সংস্কৃত ভাষায়, বাজে ঢাক, কাঁসা, শঙ্খ। সন্ধ্যায় হয় সন্ধি পূজা, যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভক্তরা অংশ নেন।

 

এই পুজোয় ছাগবলি প্রথা আজও চালু আছে, যদিও সংখ্যায় অনেক কমে এসেছে। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, “এটি কোনও হিংসা নয়, বরং তামসিক শক্তিকে প্রতীকীভাবে দূর করার আচার।” দেবীর মন্দিরের পাশে বর্তমানে একটি আটচালা নির্মিত হয়েছে—সেখানেই স্থায়ীভাবে দেবীর আসন স্থাপিত।

 


পুজোর সময় গোটা গ্রামজুড়ে এক উৎসবের আবহ তৈরি হয়। পুজো চলে দু’দিন ধরে, কিন্তু মেলা চলে প্রায় সাত দিন। শহর কালনা , সমুদ্রগড় সহ আশেপাশের প্রায় ২২ টি গ্রাম থেকে মানুষ অংশ নেন এই পুজো তে । নবমীর আগের দিন মহিলারা অংশ নেন দেবীবরণ ও সিঁদুরখেলায়। ঢাকের তালে, উলুধ্বনি আর শাঁখের শব্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে ধাত্রীগ্রাম।

 

মেলার সময় দোকান বসে মাঠজুড়ে—মিষ্টি, খেলনা, হস্তশিল্প, পুতুল, শোলার কাজ থেকে শুরু করে স্থানীয় মাটির প্রদীপ সবই পাওয়া যায়। রাতে পুরো এলাকা সাজানো হয় আলোর রোশনাইয়ে। বাতাসে বাজে মাইকের কীর্তন, কখনো ভজন, কখনো নাট্যদলের নাটক।

 

এই সময় ধাত্রীগ্রামের আরেকটি পরিচিত আচার হলো নাচ পুকুরে স্নান। বহু ভক্ত বিশ্বাস করেন, মায়ের আশীর্বাদ লাভের আগে এই পুকুরে স্নান করা আবশ্যক। কেউ কেউ দণ্ডি কেটে পুকুরে নামেন, আবার কেউ নীরবে ফুল ও ধূপ জ্বেলে প্রার্থনা করেন। অনেকেই বলেন, মনস্কামনা পূর্ণ হলে তারা পরের বছর নতুন শাড়ি বা অলংকার উৎসর্গ করেন দেবীকে।

 

পুজোর ভোরে গ্রামের নারীরা পুজোর ডালায় রাখেন স্থলপদ্ম। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, স্থলপদ্ম দেবীর প্রিয় ফুল। প্রতিটি ভক্তের ডালায় অন্তত একটি করে থাকে—যেন সেই ফুলের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাঁদের মনের বাসনা।


এই গ্রাম একসময় ছিল ভাগীরথী নদীকেন্দ্রিক জনপদ। পুরনো নদীপথ এখন অনেকটা শুকিয়ে গেলেও তার ধারেই রয়েছে দেবীদেবতার বহু প্রাচীন মন্দির—কালী, শিব, মনসা, ধনন্তরী। এগুলিই প্রমাণ দেয় এই অঞ্চলের প্রাচীন সংস্কৃতির।

ধাত্রীগ্রামের পুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি এক সামাজিক মিলনক্ষেত্র। বাইরে কাজের সূত্রে থাকা মানুষ এই সময়েই ফিরে আসেন। পুজোর দিনগুলোতে প্রতিটি বাড়িতে অতিথি সমাগম, আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, গল্প, আড্ডা—সব মিলিয়ে এক গ্রামীণ উৎসবের আবহ।

 

যদিও আধুনিকতার ছোঁয়া এসেছে—বৈদ্যুতিক আলোর মালা, মাইকের শব্দ, ভিডিও ক্যামেরায় রেকর্ডিং—তবু মূল রীতিগুলি আজও অটুট। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, “আমরা কেবল রীতি পালন করি না, ইতিহাসটাকেও বাঁচিয়ে রাখি।”

আজও পুজোর আয়োজনের দায়িত্ব নেয় একটি কমিটি, যেখানে গ্রামের সব বয়সের মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন। কেউ সংগ্রহ করেন চাঁদা, কেউ সাজসজ্জার দায়িত্ব নেন, কেউ আবার রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকেন।

ধাত্রীগ্রামের এই জগদ্ধাত্রী পুজো তাই কেবল ধর্ম নয়, এটি এক সমষ্টিগত ঐতিহ্যের প্রকাশ। এখানে দেবী যেমন মাতৃশক্তির প্রতীক, তেমনি গ্রামের ঐক্যেরও প্রতিচ্ছবি।

যে সময় বছরে একবার ধাত্রীগ্রাম আলোয় ভরে ওঠে, সেই সময় যেন তিনশো বছরের ইতিহাসও জেগে ওঠে। ঢাকের শব্দে, ধুনোর গন্ধে, পদ্মফুলের পাপড়িতে ও প্রসাদের ভোগে মিশে থাকে এই গ্রামের দীর্ঘ অতীতের গর্ব।


তাই একথা বলা যায়, ধাত্রীগ্রামের জগদ্ধাত্রী শুধু এক দেবী নন—তিনি এখানকার মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও স্মৃতির কেন্দ্রবিন্দু। তাঁরই আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে গ্রামটির পরিচয়, যার শিকড় গভীরে প্রোথিত—সেই প্রাচীন ধার্য গ্রাম থেকে আজকের ধাত্রীগ্রাম পর্যন্ত।

Sunday, 26 October 2025

শ্রীরামপুর চাতরার তপ্তকাঞ্চন বর্ণ জগদ্ধাত্রীর শত বছরের ঐতিহ্য

 

শ্রীরামপুর চাতরার তপ্তকাঞ্চন বর্ণ জগদ্ধাত্রীর শত বছরের ঐতিহ্য

 সুমন্ত বড়াল



শ্রীরামপুর শহরটাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন এই শহর শুধু ড্যানিশ ইতিহাসের জন্য বিখ্যাত নয়—এ শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি পাড়ার মধ্যে যেন গড়ে উঠেছে একেকটা জীবন্ত লোককথা। গঙ্গার ধারে, পুরনো লাল ইটের ঘরগুলোর আড়ালে, অজস্র স্মৃতির মতো টিকে আছে এক শতাধিক বছরের ঐতিহ্য—চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজো।

 সেই ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ, অর্থাৎ ১৩০৭ বঙ্গাব্দে—শ্রীরামপুর তখনও আধুনিক আলোয় আলোকিত হয়নি। ট্রেন চলে বটে, কিন্তু রাত্রির শেষে শহর ঘুমিয়ে যায় কেরোসিনের আলোয়। সেই সময়েই কয়েকজন তরুণ-উৎসাহী মানুষ, সত্যচরণ মজুমদার, নীলমণি বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁদের কয়েকজন সঙ্গী, ভাবলেন—এই পাড়ারও তো একটা নিজস্ব পূজা থাকা চাই! দেবী জগদ্ধাত্রী—যিনি শক্তির প্রতীক, যিনি শাস্ত্রে সত্ত্বগুণের মূর্তি—তাঁকেই আহ্বান করা হবে চাতরার মাটিতে।

 সেই থেকেই এই পুজোর নামেই পরিচিত হয় গোটা অঞ্চল—‘জগদ্ধাত্রী পাড়া’। দেবীর নামেই যেন গড়ে ওঠে এই পাড়ার সত্তা, তার পরিচয়, তার ঐতিহ্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই নাম আজও উচ্চারিত হয় ভক্তি আর গর্বের সঙ্গে।

 প্রথম বছরটা ছিল নিঃশব্দ, সাদামাটা, অথচ মনের দিক থেকে দীপ্ত। একখণ্ড খড়ের চালার নীচে, মাটির মণ্ডপে বসেছিলেন দেবী। গায়ের রঙ ছিল শাস্ত্রোচিত তপ্তকাঞ্চন—উদিত সূর্যের মতো রক্তবর্ণ। গ্রামের কারিগর শোলার কাজ করেছিলেন নিজের মনের আনন্দে। সেই সময়ের মানুষ হয়তো জানতেন না, তাঁদের হাতেই এক ঐতিহ্যের জন্ম হচ্ছে, যা এক শতাব্দীরও বেশি পরে শ্রীরামপুরের মানচিত্রে এক অমোঘ চিহ্ন রেখে যাবে।

আজ এই পুজো এগিয়ে চলেছে স্থানীয় বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহযোগিতায়। আশীষ ভট্টাচার্য, তাপস ব্যানার্জি, সলিল ব্যানার্জি, শ্রীকুমার ব্যানার্জি প্রমুখের নিষ্ঠা ও ভালোবাসা, এবং আশেপাশের অসংখ্য ভক্তের আত্মনিবেদন মিলেই এই দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাঁদের একাগ্রতা ছাড়া হয়তো এই শতাব্দীপ্রাচীন আয়োজন এত দীপ্ত হয়ে জ্বলত না।

আজ যখন পুজোটা একশো ছাব্বিশ বছরে পা দিয়েছে, তখনও বিস্ময় লাগে—সময় অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে, কিন্তু চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজোর রীতিতে এক বিন্দু পরিবর্তন হয়নি। এ যেন শ্রদ্ধার ভিতর দিয়ে ঐতিহ্যের প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা।

 প্রতি বছর যখন আশ্বিন মাসের শেষ দিকে হাওয়ায়  ধূপের গন্ধ মেশে, যখন শহরের গলি গলিতে কাঁসার ঘণ্টা বাজতে শুরু করে, তখন বোঝা যায়—দেবী আসছেন। চাতরার রাস্তায় তখন সাজসজ্জার তোড়জোড়।পাশের চাতরার কুমোর পাড়া তে চলে কাটামো বাধার কাজ ধীরে ধীরে মৃৎ শিল্পীর হাতে রূপ পায় দেবী বিগ্রহ  । দেবীর উচ্চতা প্রায় বিশ ফুট, কিন্তু তাঁর মুখে মায়ের মমতা, চোখে শক্তির দীপ্তি। শোলার শুভ্রতায় যেন মিশে আছে এক অপরূপ শান্তির আভা।



চাতরার জগদ্ধাত্রী মূর্তি কখনও চকচকে আধুনিক সাজে সজ্জিত হয় না। রঙে, আকারে, সাজে—সবেতেই অনুসৃত হয় শাস্ত্রীয় নিয়ম। এই ধারাবাহিকতা নিয়েই গর্ব করে চাতরা জগদ্ধাত্রী পাড়া। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন—“আমাদের দেবী যেমন ছিলেন দাদুর সময়, তেমনই আছেন আজও। শুধু আমরা বুড়ো হয়েছি, মা হননি।”

এই পুজোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার ভোগ নিবেদনে। অন্যত্র যেখানে একটি বড় ভোগ থালা দেবীর সামনে নিবেদন করা হয়, চাতরার নিয়ম সেখানে ভিন্ন। যাঁরা পুজো দেন, প্রত্যেক পরিবারের নাম ও গোত্র উল্লেখ করে আলাদা আলাদা ডালা সাজানো হয়। প্রত্যেকের ভোগ যেন তাঁদের নিজস্ব আহ্বান। কারও ডালায় খিচুড়ি, ভাজা, দু রকম তরকারি; কারও পোলাও-পনির; কারও ছানার পদ, মিষ্টি, পরমান্ন। যতজন ভক্ত, তত রকম ভোগ। এই বহুবিধতার মধ্যে যেন এক সামষ্টিক ঐক্য—যেন মা সবার আহার গ্রহণ করছেন নিজ হাতে।

 

চাতরার মানুষ বলেন, “এই ভোগেই আছে আমাদের প্রাণ। মা সবার ডালা আলাদা চেনেন, আলাদা আশীর্বাদ দেন।” ভোগ নিবেদনের সময়ের দৃশ্য দেখার মতো—ধূপে ধোঁয়ায় ভরা পরিবেশ, ঘণ্টা-শঙ্খের ধ্বনি, ঢাকের মৃদু তাল, আর পূজারীদের চোখে অপার ভক্তি।

নবমী তিথির সকাল থেকেই পাড়ার হাওয়ায় গাম্ভীর্য। এই দিনই চার প্রহরের পূজা হয়। প্রথম প্রহরে মন্ত্রপাঠ ও দেবীর অর্ঘ্য, দ্বিতীয় প্রহরে অন্ন নিবেদন, তৃতীয় প্রহরে সন্ধিপূজা, আর চতুর্থ প্রহরে আরতি ও প্রার্থনা। প্রতিটি প্রহরে আলাদা গন্ধ, আলাদা অনুভব—যেন সময় থমকে যায়।

রাত্রি নামলে মণ্ডপভর্তি আলোয় দেবীর মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে—কেউ পুরনো স্মৃতি খুঁজে, কেউ সন্তানকে নিয়ে প্রথমবার মায়ের দর্শনে। একসময় যখন শহরে তেমন বিদ্যুতের আলো ছিল না, তখন কাঁচের কুপি আর তালপাতার পাখা হাতে বসে থাকতেন মহিলারা, মন্ত্র শুনতেন, ঢাকের ছন্দে তাল দিতেন। আজ নীয়ন আলোর যুগেও সেই আবেশ ফুরোয়নি।

 

দশমীর দিন ভোর থেকেই যেন বিষণ্ণতার ছায়া নেমে আসে। কিন্তু একই সঙ্গে রয়েছে আনন্দের উৎসব—বিসর্জনের আগে দেবী বরণ। চাতরার মহিলারা সাজগোজ করে, মাথায় লাল পাড় সাদা শাড়ি, কপালে বড় টিপ, হাতে শাঁখা-পলা পরে দেবী বরণে আসেন। একসঙ্গে দেড়শোরও বেশি মহিলা—সবাই মায়ের পায়ে সিঁদুর দেন, পরস্পরের মুখে সিঁদুর লাগান। চারিদিকে হাসির কলরব, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, আর তার মধ্যেই রক্তিম আবেশে রাঙা হয়ে ওঠে সমগ্র চাতরা।



সিঁদুরখেলার পর হয় মিষ্টিমুখ। তারপর দীর্ঘ সার বেয়ে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় দেবীকে। গঙ্গার জলে তখন সূর্য ঢলে পড়ছে, আকাশে কমলা রঙ ছড়িয়ে আছে—দেবীর রঙের মতোই। ঢাক বাজছে, কণ্ঠে “জয় মা জগদ্ধাত্রী”—জলতরঙ্গে প্রতিধ্বনি হয়ে উঠছে। সিঁদুরে রাঙা মুখে সবাই তাকিয়ে থাকে সেই মহামুহূর্তে—যখন মা জলে মিশে যান, রেখে যান শুধু আশীর্বাদের ছায়া।

চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজো শুধু ধর্মীয় আচার নয়—এ এক সামাজিক উৎসব, এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। পুজোর সময় পাড়ার তরুণরা দল বেঁধে স্বেচ্ছাসেবার দায়িত্ব নেয়। কেউ ভোগ বিতরণে সাহায্য করে, কেউ শৃঙ্খলা বজায় রাখে, কেউ রাতভর আলো জ্বালিয়ে রাখে। পাড়ার প্রবীণরা বসে গল্প করেন—কখনও বলেন, “তখন তো বিদ্যুৎ ছিল না, হেচাকের  আলো জ্বেলেই  ভোগের আয়োজন হত ।” আবার কেউ স্মৃতিচারণ করেন সত্যচরণবাবুর নাম—“ওঁর উদ্যোগ না থাকলে পুজোটা হতো না।”

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর বদলেছে। চাতরার চারপাশে ফ্ল্যাট বাড়ি, ব্যস্ত রাস্তা, রেলস্টেশনে মানুষের ভিড়। কিন্তু পুজোর সময় যেন সময় পিছু হটে যায়। মণ্ডপের সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, সেই ১৯০০ সালের আলো-ছায়া আবার ফিরে এসেছে। দেবীর মুখে সেই চিরন্তন রক্তবর্ণ জ্যোতি—যা সত্ত্বগুণের প্রতীক, যা মঙ্গল ও শক্তির বার্তা দেয়।

আজও যখন সন্ধ্যার পর বাতাসে ধূপের গন্ধ মেশে, তখন মনে হয়—এই শহরের হৃদয়ে এক স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে। চাতরার পাড়ায় পাড়ায় তখন জেগে ওঠে গানের সুর, “জগদ্ধাত্রী মায়া তুই আলোকধারা”—আর সেই সুরের সঙ্গে মিশে যায় শতাধিক বছরের স্মৃতি, বিশ্বাস, আর ভালোবাসা।

চাতরার জগদ্ধাত্রী পুজো তাই কেবল একটি পুজো নয়—এ যেন সময়ের এক সেতুবন্ধন, যেখানে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক সূত্রে গাঁথা। যে হাত মূর্তি  গড়েছিল, সে হয়তো নেই, কিন্তু তার শিল্প আজও টিকে আছে; যে চোখ প্রথম মাকে দেখেছিল, তা হয়তো মুছে গেছে, কিন্তু সেই চোখের আলো আজও দেবীর মুখে প্রতিফলিত।

 শ্রীরামপুরের এই পুজো তাই এক নীরব কিংবদন্তি—যেখানে ইতিহাস মিশেছে আবেগে, সংস্কার মিশেছে সংস্কৃতিতে, আর এক পাড়ার মানুষ একসঙ্গে বেঁধেছে শত বছরের পূজার পরম্পরা।

Monday, 20 October 2025

নিম্নবর্গীয় সাধকের অমলিন ভক্তি ভাণ্ডারহাটির বামেশ্বরী মন্দির

 

 

        নিম্নবর্গীয় সাধকের অমলিন ভক্তি ভাণ্ডারহাটির বামেশ্বরী মন্দির

সুমন্ত বড়াল

 


বাংলার ধর্মচর্চার ইতিহাস আসলে মানুষের আত্মার ইতিহাস। এখানে দেবী বা দেবতার উপাসনা মানে কেবল কোনো আচার নয়, বরং সমাজের অন্তস্তলে নিহিত বিশ্বাস, প্রতিবাদ, প্রেম ও সমতার সন্ধান। গ্রামীণ বাংলার সেই বিশ্বাসের অঙ্গনে যেমন গড়ে উঠেছে সহস্র মন্দির ও আখড়া, তেমনি জন্ম নিয়েছে অসংখ্য সাধক—যাঁরা জাতি, ধর্ম, আচার ও নিয়মের সীমা অতিক্রম করে নিজের সাধনায় সৃষ্টি করেছেন নতুন এক মানবিক ধর্মচেতনা। হুগলী জেলার ধনেখালির ভাণ্ডারহাটি গ্রামের জাগ্রত বামেশ্বরী মন্দির সেই ধারারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত—যেখানে এক নিম্নবর্ণীয় মানুষের নিষ্ঠা, সংগীত ও আধ্যাত্মিক অন্বেষা একত্র হয়ে সৃষ্টি করেছে এক জীবন্ত বিশ্বাসের ঐতিহ্য।

 

ভাণ্ডারহাটীর বামেশ্বরী দেবী কেবল পূজার প্রতিমা নন, তিনি বাংলার এক সামাজিক বিপ্লবের প্রতীক। সমাজের তথাকথিত উঁচু-নিচু বিভাজনের ভেতর দাঁড়িয়ে রতন বারুই নামের এক সাধারণ মানুষ তাঁর ভক্তি ও সাধনার মাধ্যমে ভেঙে ফেলেছিলেন প্রথার প্রাচীর। মাটির দেবীমূর্তি গড়ে, নিজের সংগীতকে আরাধনার মন্ত্রে রূপান্তরিত করে, তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন এক ধর্মচেতনা, যেখানে ভক্তি জাতিভেদ জানে না। একদিকে এই মন্দির তাই আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র, অন্যদিকে এটি বাংলার সমাজচরিত্রে ‘নিম্নবর্গীয় আত্মপ্রকাশ’-এর এক ঐতিহাসিক দলিল।

 

এই প্রবন্ধে বামেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস কেবল দেবী প্রতিষ্ঠার নয়; এটি রতন মহারাজের জীবনযাত্রার অনুবাদ—যেখানে সংগীত হয়ে উঠেছে সাধনা, আর ভক্তি হয়ে উঠেছে নীরব প্রতিবাদ। তালপাতার ছাউনির নিচে শুরু হওয়া সেই ছোট্ট পূজামঞ্চ আজ রূপ নিয়েছে এক বৃহৎ তীর্থকেন্দ্রে; তবু তার অন্তরস্থ স্পন্দন আজও সেই একই—মানবিকতার, আধ্যাত্মিক সমতার, আর দেবীপ্রেমের।

 


ভাণ্ডারহাটীর এই কাহিনি তাই এক সাধকের নয়, এক সমাজের; এক মন্দিরের নয়, এক যুগের প্রতিফলন—যেখানে অলৌকিকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে বাংলার চিরন্তন মানবিক ধর্মবোধ।ধনেখালির বিস্তীর্ণ গ্রামীণ পরিসর জুড়ে যে নিস্তব্ধতার মধ্যে ভোরের আলো ফুটে ওঠে, সেই নির্জনতার বুকেই যেন একদিন জেগে উঠেছিল ভাণ্ডারহাটির জাগ্রত বামেশ্বরী মন্দির। শস্যশ্যামলা জনপদ, নদী, পুকুর আর তালবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই মন্দিরের ইতিহাস শুধুই এক দেবীর প্রতিষ্ঠার কাহিনি নয়—এ এক নিম্নবর্গীয় এক সাধারণ মানুষের আত্মনিবেদন, এক অন্তর্গত বিপ্লবের যাত্রা। সেই মানুষের নাম রতন বারুই। সমাজের তথাকথিত উঁচু-নিচুর সীমারেখা পেরিয়ে তাঁর ভক্তি, সাধনা আর সংগীতমগ্নতা এই দেবালয়ে সঞ্চার করেছিল নতুন এক আধ্যাত্মিক সুর।

 

১৯৪৯ সালে ভাণ্ডারহাটির মাটিতে জন্মেছিলেন রতন বারুই। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত নিরাসক্তি। বিদ্যালয়ের পাঠে মন টিকত না, সমাজের নিয়মে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারতেন না। গ্রামের লোকের চোখে তিনি ছিলেন ‘অমনোযোগী’ বা ‘ভিন্ন প্রকৃতির ছেলে’। অথচ সেই ‘ভিন্নতা’ই ছিল এক আধ্যাত্মিক আহ্বান। পার্শ্ববর্তী কেশবপুরের কালীমন্দিরের দিকে তাঁর এক অদ্ভুত টান ছিল। রাতের নিঃস্তব্ধ অন্ধকারে, যখন সবাই নিদ্রামগ্ন, তখন কিশোর রতন নিঃশব্দে চলে যেতেন মন্দিরের দিকে—কখনও প্রণাম, কখনও নিঃশব্দ আরতি, কখনও শুধু বসে থাকা। গ্রামের মানুষ জানত না, এক ‘অব্রাহ্মণ’ ছেলে কালীমন্দিরে প্রবেশ করছে; যদি জানত, তবে সমাজের প্রাচীন প্রথা তাকে থামিয়ে দিত। তবুও সেই নিষেধাজ্ঞার ভেতরেই রতনের সাধনা শুরু হয়—লুকিয়ে, নিঃশব্দে, তবু গভীর বিশ্বাস নিয়ে।

 

একসময় তাঁর উপস্থিতি গোপন থাকল না। খবর ছড়িয়ে পড়ল—রতন বারুই রাতে মন্দিরে যায়, পূজা করে। সমাজের রক্ষণশীল চোখে এটি ছিল অপরাধ। মন্দিরে তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো। কিন্তু ভক্তি কি দেয়ালে থামে? রতন মহারাজ সেই সময় শ্মশান প্রান্তে গিয়ে সাধনা শুরু করলেন। মৃতদেহের ধোঁয়া, মোমবাতির ক্ষীণ আলো আর গোধূলি-অন্ধকারের মধ্যে তাঁর আরাধনা যেন হয়ে উঠল এক প্রকৃত ‘তন্ত্রসাধনা’। শ্মশানের মাটিতে তিনি খুঁজে পেলেন নিজের দেবীকে, খুঁজে পেলেন মাতৃস্বরূপ এক শক্তিকে, যিনি সমাজের বাঁধন ভেঙে তাঁকে নিজের ভক্তিতে টেনে নিলেন।

 


এক রাতে স্বপ্নে তিনি দেবীকে দেখলেন। দেবী বললেন, তাঁর নিজের গৃহেই তিনি আসন গ্রহণ করবেন। এই স্বপ্নাদেশই হয়ে উঠল ভবিষ্যতের বামেশ্বরী প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত। রতন নিজের বাড়ির উঠোনেই মাটি কেটে তৈরি করলেন দেবীর মূর্তি। সেই মূর্তি বানানোর সময় তাঁর ইচ্ছে ছিল কেশবপুরের দেবীর মতো মায়ের ডান পা আগে থাকবে। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে মূর্তির বাঁ পা আগে পড়ে গেল। ভুল? না, রতনের মতে এটি ছিল দেবীরই ইচ্ছা। সেই থেকেই নাম হয় ‘বামেশ্বরী’—অর্থাৎ যাঁর বাঁ পা আগে। তালপাতার ছাউনিতে শুরু হয় পূজা, চারপাশে কিছু প্রদীপ, কিছু ধূপকাঠি, আর এক নিরলস আরাধক।

 

এই সাধারণ সূচনা থেকেই গড়ে ওঠে ভাণ্ডারহাটির জাগ্রত বামেশ্বরী মন্দির। দেবীর অলৌকিক মাহাত্ম্য ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের গ্রামে। রতনের ভক্তি আর সংগীতের মেলবন্ধন মন্দিরের আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলকে এক অনন্য মাত্রা দেয়। তিনি বলতেন, “সংগীতই আমার সাধনা।” আরতি শুরু হওয়ার আগে ঘণ্টাখানেক ধরে ভক্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করতেন তিনি। তাঁর সেই কণ্ঠ, সেই ভক্তিস্বর, একসময় দূরদর্শন ও বেতারে প্রতিধ্বনিত হয়। মানুষের বিশ্বাস ছিল—দেবীর আরতি চলাকালীন রতনের সংগীত শুনলে মনের দুঃখ দূর হয়, রোগমুক্তি মেলে।

 

এই মন্দিরে একসময় আরেকটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটত—আরতির সময় ঘুরে উঠত জলশঙ্খ। কেউ বিশ্বাস করতে পারত না, কিন্তু বহু মানুষের চোখের সামনে সেই অলৌকিক দৃশ্য নিত্য ঘটত। শনিবার ও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিশেষ পূজা হতো; গ্রীষ্মে সন্ধ্যা সাতটা, শীতে ছয়টায়। রতন মহারাজের নিজের হাতে পরিচালিত এই পূজায় সংগীতই ছিল দেবী আরাধনার প্রধান মাধ্যম। প্রতিটি সুর যেন ছিল মায়ের চরণে নিবেদিত মন্ত্রের সমান পবিত্র।

 

১৯৭৫ সালে, যখন মন্দির কমিটি গঠিত হয়, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মাটির প্রতিমার পরিবর্তে পাথরের প্রতিমা আনা হবে। রতনের হৃদয় ভেঙে যায়। তিনি নিজের হাতে যেই মূর্তি গড়েছিলেন, সেই মূর্তি বিসর্জন হবে—এই ভাবনাই তাঁকে নিদ্রাহীন করে তোলে। শিল্পী যখন নতুন মূর্তি তৈরি করতে যান, দুর্ঘটনাবশত তাঁর হাত ভেঙে যায়। অনেকে বলেন, দেবীরই ইচ্ছায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। পরে নতুন মূর্তি তৈরি হয় বটে, কিন্তু তা আগের মূর্তির মতো নয়; সেখানে ডান পা আগে, বাঁ পা নয়। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়—মাটির মূর্তিই থাকবে মন্দিরে, দেবীর মূল রূপ হিসেবে।

 


বর্তমানে বামেশ্বরী মন্দির এক বিশাল স্থাপত্যে রূপ নিয়েছে। এখানে রয়েছে গণেশ, রাধাকৃষ্ণ, বামেশ্বর (শিব) মন্দির ও দুর্গাদালান। প্রতিদিন সকাল পাঁচটা ত্রিশ মিনিটে মন্দিরের দরজা খোলে; গ্রীষ্মে দুপুর বারোটা ত্রিশে, রাতে সাড়ে নয়টায় মন্দির বন্ধ হয়; শীতে সকাল ছয়টা থেকে রাত আটটা ত্রিশ পর্যন্ত। দেবীর নিত্য অন্নভোগ হয় দুপুর বারোটায়, কিন্তু অন্নভোগ গ্রহণে লাগে অনুমতিপত্র—ভক্তদের জন্য নিয়ম শৃঙ্খলার এই ধারা রতন মহারাজের আমল থেকেই চলে আসছে। প্রতি মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে হয় চণ্ডীমাতার পূজা ও চণ্ডীপাঠ। এছাড়া প্রতিটি বাংলা মাসের শেষ মঙ্গলবার অথবা শনিবার রাত্রে হয় ভোগবিতরণ—যা স্থানীয় মানুষের কাছে এক পবিত্র সমারোহ।

 

মন্দিরের সাং বৎসরিক পূজার তালিকাই যেন এই এলাকার আধ্যাত্মিক জীবনের ক্যালেন্ডার। বৈশাখে প্রতিদিন বৈকালিক পূজা ও প্রসাদ বিতরণ হয়। আষাঢ়ে অম্বুবাচী পূজা, জ্যৈষ্ঠে রাধাগোবিন্দ জিউর প্রতিষ্ঠা দিবস; আষাঢ়-আশ্বিনে ঝুলন পূর্ণিমা ও গুরুপূর্ণিমা; ভাদ্রে জন্মাষ্টমী, গণেশচতুর্থী; আশ্বিনে দুর্গোৎসব, মধ্যাহ্নে ভোগ বিতরণ, লক্ষ্মীপূজা; কার্ত্তিকে কালীপূজা, রাসপূর্ণিমা; অগ্রহায়ণে অন্নকূট উৎসব; পৌষে কল্পতরু উৎসব ও মধ্যাহ্নে ভোগ বিতরণ; ফাল্গুনে শিবরাত্রি; চৈত্রে অমাবস্যা তিথিতে মন্দির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী—এইভাবে বারো মাসই পূর্ণ ধর্মীয় অনুশীলনে। এই প্রতিটি উৎসব, প্রতিটি ভোগ, প্রতিটি আরতি যেন রতন মহারাজের সেই ভক্তিসূত্রে গাঁথা থেকে গেছে।

 

রতন মহারাজের সাধনা কেবল ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেবী পূজা মানে কেবল প্রতিমার আরাধনা নয়—এ এক সঙ্গীত ও মানবিকতার সাধনা। তাঁর গানে দেবী কালী একদিকে মাতৃরূপে, অন্যদিকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য শক্তিরূপে প্রকাশ পেতেন। তিনি কখনও বলতেন, “মা আমার সঙ্গীতের রাগে থাকেন, আমি যখন গাই, তখন মা শোনেন।” তাই সংগীতের মাধ্যমে যে ভক্তি তিনি জাগিয়েছিলেন, তা ছিল এক জীবন্ত আধ্যাত্মিক আন্দোলন।

 

বামেশ্বরী মন্দিরে রতনের উপস্থিতি আজও অনুভূত হয়। অমিয় সাহা, দীপঙ্কর ঘোষ, বিশ্বজিৎ দত্ত প্রমুখ কমিটি সদস্যরা আজও বলেন—রতন মহারাজের সংগীত ও নিষ্ঠাই এই মন্দিরের প্রাণ। প্রতি মাসের শেষ শনিবার বা মঙ্গলবার ভোগবিতরণে আজও বহু মানুষ সমবেত হন। কেউ বলে ‘অলৌকিক শক্তি’, কেউ বলে ‘আধ্যাত্মিক স্পর্শ’, কিন্তু সকলেই বিশ্বাস করে—এই মন্দির জাগ্রত।

 

এই বিশ্বাসের ভিতরেই আছে রতন মহারাজের জীবনের মৌলিক প্রতীকধর্মিতা। তিনি ছিলেন তথাকথিত ‘নিচুজাত’—যে সমাজে ব্রাহ্মণ ছাড়া পূজার অধিকার মানা হতো না, সেখানে এক বারুই সন্ত নিজ হাতে দেবী প্রতিষ্ঠা করলেন, মাটির মূর্তি গড়লেন, এবং তার মাধ্যমে ভক্তির সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর এই কর্মকাণ্ড এক অর্থে লোকধর্মের পুনর্জাগরণ। দেবী তাঁর কাছে কোনো জাতি বা ধর্মের সীমায় আবদ্ধ ছিলেন না—তিনি ছিলেন মাতৃশক্তি, তিনি ছিলেন মানুষের মনের আশ্রয়।

 

বামেশ্বরী দেবীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই লোকবিশ্বাস আজ ধর্মসমাজের এক ঐতিহাসিক দলিল। এখানে দেবীর বাঁ পা আগে থাকা যেন প্রতীক হয়ে উঠেছে বিপরীত পথের—যে পথ সমাজের স্রোতের বিপরীতে, কিন্তু অন্তরের সত্যের পথে। রতন মহারাজের জীবনে সেই বাঁ পায়ের মতোই সবকিছু ছিল বিপরীত, কিন্তু তবু সঠিক।

 

মন্দিরের প্রতিটি ইট, প্রতিটি প্রদীপ যেন রতনের ভক্তির কথা বলে। তাঁর মৃত্যুর পর—২২ জুলাই ২০২০—মন্দিরে যেন এক গভীর নীরবতা নেমেছিল। কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেও প্রতিদিন সন্ধ্যার আরতিতে ভেসে আসে সংগীতের সুর, যা রতনেরই তৈরি ধারা। এখনো সন্ধ্যা নামলে আরতির আগে এক ঘণ্টা ভক্তরা একত্রে সংগীত পরিবেশন করেন, যেন সেই সুরের মধ্য দিয়েই মহারাজ উপস্থিত।

 

ভাণ্ডারহাটির এই বামেশ্বরী মন্দির আজ শুধু এক পূজাস্থল নয়, এটি এক লোক-ঐতিহ্য, এক আঞ্চলিক ইতিহাস, যেখানে সমাজ, সংগীত, ভক্তি, ও অলৌকিকতার সংমিশ্রণ ঘটে গেছে এক দেবীচেতনায়। প্রতি চৈত্র অমাবস্যায় যখন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হয়, তখন হাজার হাজার মানুষ ভোগগ্রহণে আসেন, মায়ের নাম জপ করেন, আর মনে মনে উচ্চারণ করেন সেই সাধকের নাম—রতন বারুই—যিনি একসময় সমাজের প্রান্ত থেকে শুরু করেছিলেন তাঁর তপস্যা, আর আজ হয়ে উঠেছেন এক আঞ্চলিক দেবলোকের প্রতীক।

ভাণ্ডারহাটীর বামেশ্বরী মন্দির কেবল এক পূজাস্থল নয়—এ এক সমাজ, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের জীবন্ত দলিল। এখানে দেবী আর ভক্তের সম্পর্ক কোনো পুরাণনির্ভর ভয়ের নয়, বরং এক নিবিড় মানবিক আস্থার। রতন মহারাজের সাধনা এই মন্দিরকে দিয়েছে ভক্তির এক নতুন অভিধান, যেখানে আচার নয়, অন্তরের অনুরণনই প্রধান। তাই এই মন্দিরের প্রতিটি ইট, প্রতিটি ঘণ্টাধ্বনি যেন বলে—ভক্তি কারও একাধিকার নয়, তা মানুষের মনের, প্রাণের, পরিশ্রমের, ও সত্য অনুসন্ধানের।

 

একসময় যে সমাজে জাতিভেদ ছিল অটল, সেখানে এক নিম্নবর্গীয় মানুষের হাতে দেবীর প্রতিষ্ঠা আসলে প্রথার বিরুদ্ধে এক নীরব বিপ্লব। রতন বারুইয়ের উপাসনা ও সংগীত সেই বিপ্লবের কাব্যরূপ। তিনি শিখিয়েছেন—ভক্তি মানে আত্মসমর্পণ নয়, আত্মজাগরণ। বামেশ্বরী দেবী যেন সেই জাগরণের প্রতীক—যিনি কেবল দেবতা নন, বরং বাংলার সাধারণ মানুষের অন্তর্গত শক্তির প্রতিমূর্তি।

 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরটি যেমন আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বিস্তার পেয়েছে এর বিশ্বাসের পরিধি। আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ আসে শুধু পূজার জন্য নয়, আসে আত্মিক শান্তির সন্ধানে। গ্রামের উৎসব, মেলার দিনগুলোয় এই বিশ্বাসের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দূর দূরান্তে—যেন মাটি, মানুষ ও দেবতার মিলনে এক হয়ে যায় বাংলার লোকধর্মের সুর।

 

আজ যখন সমাজ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে নিজের শিকড় থেকে, তখন ভাণ্ডারহাটীর বামেশ্বরী মন্দির আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই চিরন্তন সত্য—বাংলার ধর্ম মানে মানবধর্ম। প্রার্থনার মূলে আছে প্রেম, দয়ার মূলে আছে সংহতি, আর ভক্তির মূলে আছে মানুষ।

 

রতন মহারাজের এই সাধনালব্ধ ঐতিহ্য তাই কেবল স্থানীয় নয়, এটি সমগ্র বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার—যেখানে দেবী বামেশ্বরী একদিকে মা, অন্যদিকে মুক্তির প্রতীক।

তাঁর মন্দিরে বাজে যে ঘণ্টাধ্বনি, তা আজও যেন আহ্বান জানায়—

“এসো, প্রথা নয়, প্রেমে বিশ্বাস রাখো; ভয়ে নয়, ভক্তিতে জাগো।”

Sunday, 12 October 2025

হুগলীর ডুমুরদহর বুনো কালী, ডাকাতি আর গ্রামীণ গল্প

 

হুগলীর ডুমুরদহর বুনো কালী, ডাকাতি আর গ্রামীণ গল্প

সুমন্ত বড়াল




হুগলীর বলাগড় ব্লকের গ্রামীণ জনপদ ডুমুরদহ বহু শতাব্দী ধরে ইতিহাস, লোককথা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই অঞ্চল কখনো শুধু কৃষিজমি বা মানুষের বসবাসের কেন্দ্র ছিল না; বরং এটি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঞ্চারস্থলও। তবে ডুমুরদহের খ্যাতির অন্যতম কারণ হলো এখানকার প্রাচীন কালী পূজা বুনো কালী মন্দির স্থানীয়রা এই মন্দিরকে শুধুমাত্র দেবীর আরাধনার স্থান হিসেবে নয়, বরং অতীতের এক ভয়ঙ্কর সময়ের সাক্ষী হিসেবেও মনে করেন।

বুনো কালী মন্দির স্থাপত্যের দিক থেকে কোনো চমকপ্রদ নিদর্শন নয়, এটি একতলা চারচালা স্থাপত্যে নির্মিত, আকারে প্রায় পিরামিডাকৃতি। বাইরের অংশ বেশ সাদামাটা হলেও মন্দিরের চেহারায় আধুনিক স্পর্শও পাওয়া যায়। মন্দিরের সামনে রয়েছে প্রশস্ত বাঁধানো চাতাল, যেখানে পূজার সময় ভক্তরা একত্রিত হন। প্রবেশদ্বার হিসেবে একটি তোরণ রয়েছে, যা মন্দিরটিকে এক ধরণের গম্ভীরতা প্রদান করে। সময়ের সঙ্গে মন্দিরে অনেক সংস্কার হয়েছে, কিন্তু গ্রামীণ সরলতার ছাপ এখনও অক্ষুণ্ণ।

এই মন্দিরের পূজা-পদ্ধতিও যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। এককালে এখানে পশুবলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে আধুনিক সময়ে সেই রীতি বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে, বৈষ্ণব মতে নিয়মিত পূজা হয়। তবু একটি প্রাচীন আচার এখনো টিকে আছেভক্তরা ছাগলের কান কেটে তা বেলপাতায় রেখে দেবীর উদ্দেশে নিবেদন করেন। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, এই রীতির মাধ্যমে দেবী তাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ করেন।



বুনো কালী মন্দিরের সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো ডাকাতদের সঙ্গে এর সম্পর্ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বিশে ডাকাত নামে পরিচিত বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই অঞ্চলে আতঙ্কের প্রতীক ছিলেন। তিনি ডুমুরদহেরই বাসিন্দা এবং ডাকাত দলের নেতা। স্থানীয় বয়ানে জানা যায়, বিশে ডাকাত তাঁর সহযোগীরা নৌকায় চড়ে গঙ্গার বিভিন্ন অঞ্চল ধরে যশোহর পর্যন্ত লুণ্ঠন চালাতেন। দুর্গাচরণ রায় তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “প্রায় ষাট বছর আগে বিখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথবাবু এখানে বাস করিতেন। তাহার অধীনে ডাকাইতেরা নৌকাযোগে যশোহর পর্যন্ত ডাকাতি করিয়া বেড়াইত।এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, বিশে ডাকাতের প্রভাব স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না; বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সে দাপট বিস্তার করেছিল। আজ সেই বাড়ি নেই, ডাকাত দলের অস্তিত্বও লোপ পেয়েছে, তবে তাদের নাম কাহিনী গ্রামবাসীর স্মৃতিতে অম্লান।

ডুমুরদহের জমিদার পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন রত্নেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। নবাব মুর্শিদ কুলি খানের আমলে তিনি নবাবকে ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফলস্বরূপ, নবাব তাঁকেরায়উপাধি দেন এবং সাতটি অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর এই পরিবারের উত্তরপুরুষরাও কিছু সময়ে ডাকাতি কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। তারা যখন ডাকাতিতে যেতেন, বুনো কালী মন্দিরে পূজা দিয়ে যেতেন। দেবীর আশীর্বাদ ছাড়া কোনো অভিযান শুরু হতো না। ফলে মন্দিরটি তাদের আধ্যাত্মিক আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।



মন্দিরের পাশেই একটি ভৈরব মন্দির রয়েছে। চারচালা রীতিতে নির্মিত এই মন্দিরের অনেকাংশ এখন জীর্ণ, তবে টেরাকোটার কারুকাজ এখনও চোখে পড়ে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ভৈরব কালী একসাথে গ্রামকে রক্ষা করছেন।

সমাজ-সংস্কৃতির দিক থেকেও বুনো কালী মন্দির গুরুত্বপূর্ণ। পূজার দিনগুলোয় মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তরা জড়ো হন। বাজে ঢাক-ঢোল, প্রদীপের আলো, গ্রামীণ হাট মেলাসব মিলিয়ে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এটি কেবল ধর্মীয় আবেগের কেন্দ্র নয়, সামাজিক মিলনমেলার ক্ষেত্রও। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী কালী গ্রামবাসীকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। প্রবীণরা বলেন, পূর্বপুরুষেরা রাতের আঁধারে বাইরে বের হতে সাহস করতেন না, কিন্তু মন্দিরে মানত করতেন, যাতে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ডুমুরদহের গ্রামীণ জীবন এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায়। কৃষিকাজ, বাজার, মেলাসবকিছু মন্দিরের সময়সূচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় মন্দির একটি অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী প্রভাব রাখে। কেবল আধ্যাত্মিক নয়, সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে এই মন্দির গ্রামের জন্য অপরিহার্য।



ডুমুরদহের বুনো কালী মন্দির কেবল আধ্যাত্মিক স্থান নয়; এটি বাংলার গ্রামীণ সমাজের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। ডাকাতি, জমিদারি, সামাজিক অনুষ্ঠান—all সবকিছু এখানে ফুটে উঠেছে। ডাকাত বিশে, রত্নেশ্বর রায়বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ইতিহাস, ভৈরব মন্দিরের শিল্পকলার ছোঁয়াসব মিলিয়ে এটি গবেষক ইতিহাসপিপাসু মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র।

মন্দিরের পাশে ছায়াযুক্ত গঙ্গার পাড়, হালকা বনানী, গ্রামের সরল মানুষসব মিলিয়ে একটি সময়-প্রবাহ তৈরি করে। ডাকাতদের দাপট, গ্রামীণ ভয়, দেবীর আশীর্বাদসব মিলিয়ে বুনো কালী মন্দির একটি রহস্যময়, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

আজ ডুমুরদহ শান্ত গ্রামীণ জনপদ। ডাকাতদের আর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু তাদের নাম, দেবীর গল্প এবং মন্দিরের ইতিহাস এখনো গ্রামবাসীর মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। বুনো কালী মন্দির তাই শুধু পূজাস্থল নয়; এটি গ্রামীণ বাংলার অতীত জীবনধারা, লোকবিশ্বাস এবং ইতিহাসের এক অমূল্য সাক্ষ্য।

ডুমুরদহের বুনো কালী মন্দির আমাদের শেখায়, ইতিহাসের কুৎসিত ভয়ঙ্কর দিকও কিভাবে স্থানীয় সংস্কৃতি আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে মিশে যায়। ডাকাতদের গল্প থেকে শুরু করে গ্রামের ভক্তি, সামাজিক মিলনমেলা এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসসব মিলিয়ে এটি একটি সময় স্থানকে সংরক্ষণ করে। ভক্তি, ইতিহাস, ভয়, আশীর্বাদ—all সবকিছু এখানে মিলিত হয়, এবং এটি হুগলীর বলাগড় ব্লকের গ্রামীণ জীবনের এক অমূল্য প্রতীক।

 

তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি

                            তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো...