তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি
হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো মাঠ আজ শান্ত-নির্জন গ্রামাঞ্চলের মতোই সাধারণ একটি ভূপ্রদেশ। কিন্তু ইতিহাসের ধুলো সরালে দেখা যায়, এই মাটির নিচে লুকিয়ে আছে ভয়, ভক্তি, মাতৃত্ব আর রূপান্তরের গভীর কাহিনি। একসময় এই তেলোভেলো মাঠ ছিল জলা-জঙ্গলে ঘেরা, পথিকের কাছে ভয়ের প্রতীক। কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বরের দিকে যে হাঁটা পথ ধরে সারদা মা যেতেন, সেই পথের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ ছিল এই তেলোভেলো অঞ্চল। সাপের ভয়, জনমানবহীনতা, ডাকাতদের দল আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে সন্ধ্যার পরে কেউই এই পথে চলতে চাইত না। সেই কারণেই সারদা মায়ের সঙ্গীরা চেষ্টা করতেন আলো থাকতে তেলোভেলোর মাঠ পেরিয়ে যেতে।
সেদিনও তাই হয়েছিল। সারদা মায়ের শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত, হাঁটা ভারী হয়ে আসছিল, তবুও সঙ্গীরা ভয়ের চাপে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। মা তাঁদের থামাতে চাননি। বরং শান্ত গলায় বলেছিলেন, “তোমরা তারকেশ্বরে গিয়ে উঠো, সেখানেই আবার দেখা হবে।” এই সহজ বাক্যেই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর অদম্য আত্মবিশ্বাস—যে বিশ্বাস মৃত্যু বা বিপদের হুমকিকেও পাত্তা দেয় না। সঙ্গীরা তাই এগিয়ে গেল, আর সারদা মা পিছিয়ে পড়লেন একা, এই ভয়াবহ তেলোভেলো মাঠের ঠিক মাঝখানে।
লোককাহিনি, জীবনী ও প্রবীণদের স্মৃতিচারণে মিলে যে ঘটনা উঠে আসে, তা একইসঙ্গে অলৌকিক ও মানবিক। সন্ধ্যার আলো নিভে যাওয়ার পরে মাঠের ওপর এক ধরনের রহস্যময় চাপা আঁধার নেমে আসে। এই তেলোভেলোর নির্জনতা সেই সময় ছিল ডাকাতদের অধিকারভূমি। ডাকাত সর্দারের নাম নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে—কেউ বলেন তাঁর নাম ছিল সাগর সাঁতরা, কেউ বলেন ভীম ডাকাত। স্থানীয় লোকের কাছে ‘ভীম ডাকাত’ নামটাই বেশি পরিচিত, কারণ তাঁর চেহারাই ছিল ভীমের মতো—দৈত্যাকার শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, হাতে-পায়ে লোহার বালা, কপালে রক্ততিলক, আর হাঁটার সময় লাঠির ঠকঠক শব্দ।
সারদা মা যখন ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে আগাচ্ছিলেন, তখনই নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা গেল হাড়হিম করা এক চিৎকার। অন্ধকার থেকে উঠে এলো কালো ছায়া, আর পরক্ষণেই মা চোখে দেখলেন এক বিরাটদেহী মানুষ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ডাকাত সর্দার এগিয়েই কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল—“কে তুই? কোথায় চলেছিস?” মুহূর্তটি ছিল ভয়ের পূর্ণ। যে কেউ এই অবস্থায় থরথর কাঁপত, কিন্তু সারদা মা ছিলেন সম্পূর্ণ স্থির। তিনি মৃদু স্বরে বললেন—“আমি তোমার মেয়ে গো বাবা, সারদা। দক্ষিণেশ্বর যাচ্ছি তোমার জামাইয়ের কাছে।”
মায়ের এই উত্তর আজও গবেষকদের বিস্মিত করে। কেন ‘মেয়ে’ পরিচয়? কেন ‘জামাই’ শব্দ? লোকবিশ্বাসে আছে—যখন একজন নারী অপরিচিত পুরুষের কাছে নিজেকে কন্যা পরিচয়ে উপস্থাপন করেন, তখন তার রক্ষা নিশ্চিত হয়; মাতৃত্ব ও কন্যাস্নেহের ভারেই পুরুষের হৃদয় নরম হয়ে যায়। সারদা মা শুধু পরিস্থিতি সামলাননি, তিনি মানবমনের গোপন চাবিটাকেও ব্যবহার করেছিলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।
ডাকাত সর্দারের আচরণ মুহূর্তে বদলে গেল। তাঁর হৃদয়ের কঠিন আবরণ যেন সরে গেল। সারদা মায়ের শান্ত স্বর, তাঁর আত্মবিশ্বাস আর তাঁর চোখের অটল সাহস ভীম ডাকাতকে স্তব্ধ করে দেয়। জনশ্রুতি বলে—ঠিক তখনই মাঠে অদ্ভুত এক আলো দেখা যায়। মা মনে করেছিলেন, যেন জগতজননী তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভয়ের শূন্যতার জায়গায় আসে দেবত্বের প্রতিরোধশক্তি। এই দৃশ্য ভীমকে অভিভূত করে। সে হঠাৎ মায়ের হাত দু’টি ধরে বলল—“মা, তুমি একা এখানে কীভাবে? এত অন্ধকারে ভয় লাগছিল না?”
মা মৃদু হাসলেন। বললেন—“সঙ্গীরা সবাই এগিয়ে গেছে। শরীরটা আজ ভালো যাচ্ছে না। তুমি এলে বলেই পথ পেলাম।” সেই মুহূর্তে ভীম ডাকাতের ভিতরের মানুষ জেগে উঠল। ডাকাত নয়—সে যেন এক সহজ-সরল গৃহস্থ পুত্র হয়ে গেল। তখনই ডাকাত সর্দারের স্ত্রী এগিয়ে এলেন। তিনিও সারদা মাকে ‘মেয়ে’র চোখে দেখে বাড়িতে নিয়ে যেতে জোর করলেন। ডাকাত দম্পতির ঘর ছিল খুবই সাধারণ—মাটির মেঝে, দাওয়ায় তক্তা রাখা শোবার স্থান, পাশে গাছ-পালায় ঘেরা উঠোন। তারা সেই রাতে মায়ের বিশ্রামের জন্য আলাদা বিছানা করে দিল, খেতে দিল মুড়ি, মুড়কি, চালভাজা—যা ছিল তাদের ঘরে সহজলভ্য। কিন্তু এই খাদ্যই পরে হয়ে উঠল তেলোভেলোর সারদা মায়ের নিত্যভোগ।
রাতটি কেটে গেল সম্পূর্ণ অন্য আবহে। একটি ডাকাত পরিবারে সারদা মা এমন স্নেহে, এমন আদরে থাকলেন, যা পরে পরিণত হয় ঐতিহাসিক রূপান্তরের ভিত্তিতে। ভোর হতেই ভীম ডাকাত নিজে মাকে পথ দেখিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দিকে এগিয়ে দিলেন। কেউ কেউ বলেন—তিনি অনেকদূর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে হেঁটে গিয়েছিলেন। এই হাঁটা পথেই তাঁর জীবনে আসে সেই পরিবর্তন, যার সাক্ষী আজও তেলোভেলো গ্রাম।
এই ঘটনার পর ভীম ডাকাতের জীবনে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, সেই রাতের আলো, সারদা মায়ের মমতা আর তাঁর ‘মেয়ে’ রূপ ভীমের জীবনের গতি বদলে দিয়েছিল। সারদা মা চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজ হাতে মায়ের প্রতিষ্ঠা দেন তাঁর এলাকায়। মেয়ে রূপে দেখা সেই সারদা মাকে পূজা করার জন্য নির্মিত হয় একটি ছোট দেবস্থান। কোনও অলংকার, কোনও জাঁকজমক নয়—খুব সাধারণ কাঠামো, কাঁচা ইট ও মাটি দিয়ে গড়া, কিন্তু বিশ্বাসের ভিত ছিল অকল্পনীয়ভাবে দৃঢ়। এখানেই শুরু হয় ‘সারদা মা’ নামে মায়ের এক অনন্য লোকপূর্ণ প্রতিষ্ঠা।
পরে এই স্থানে কালীমূর্তি স্থাপিত হলেও, স্থানীয় মানুষ এই দেবীকে কালী বলে ডাকে না। তাঁরা বলেন ‘সারদা মা’—মেয়ে, মা, রক্ষাকর্ত্রী, পরিবারসম কৃপাবানী দেবী। মায়ের রূপের সঙ্গে কালীপ্রতিমার মিলনে তৈরি হয় এক অদ্ভুত দ্বৈততা—কালীর শক্তি, সারদার মমতা। এই বিশেষ দ্বৈতধর্মী রূপ আঞ্চলিক লোকধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গবেষকরা বলেন—এটি বাংলার ‘মাতৃভক্তি’ ঐতিহ্যের এক দৃঢ় দৃষ্টান্ত, যেখানে দেবী একইসঙ্গে ভক্তকে ভয় থেকে রক্ষা করেন এবং অপরাধীকে সৎ পথে ফেরান।
তেলোভেলোর এই সারদা মা–কালীপূজা আজও বিশিষ্ট। পূজার দিনে রক্তচন্দনের প্রলেপ দেওয়া হয় প্রতিমার পায়ে। ভক্তরা অর্পণ করেন ধূপ, দীপ, ফুল, ফল, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোগ হলো—মুড়ি, মুড়কি আর চালভাজা। কারণ সেই প্রথম রাতে ভীম ডাকাতের ঘরে সারদা মা এই খাবারই গ্রহণ করেছিলেন। লোকবিশ্বাসে আছে—মা কখনো অস্বীকার করেন না স্নেহের প্রথম দান। তাঁর কাছে এই ভোগ কেবল খাদ্য নয়; এটি স্মৃতি, রক্ষা, এবং রূপান্তরের চিহ্ন।
এই অঞ্চলের বয়স্ক মানুষেরা বলেন—ভীম ডাকাত পরবর্তীকালে আর কোনও অপরাধ করেননি। কেউ কেউ দাবি করেন, তাঁর আত্মা এখনও মন্দির পাহারা দেয়। রাতের বেলা বটগাছের নিচে কখনো ছায়ামূর্তি দেখা যায়, কখনো মৃদু পায়ের শব্দ শোনা যায়। এসব বিশ্বাস গবেষকদের কাছে লোকবিশ্বাসের স্বাভাবিক সম্প্রসারণ হলেও গ্রামের মানুষের কাছে এটি বাস্তব। তাদের মতে, ভীম ডাকাতের অপরাধীসত্তা সারদা মায়ের মমতায় গলে গিয়েছিল। এখন তিনি মায়ের পাহারাদার, মায়ের পথরক্ষক।
গ্রামজুড়ে এই কাহিনি আজও নতুন প্রজন্মকে শোনানো হয়। মায়াপুর অঞ্চলের চাষিরা, গৃহিণীরা, বয়স্ক মানুষ, এমনকি শিশুরাও জানে—একদিন এই তেলোভেলো মাঠে মা নিজে পা রেখেছিলেন। তাঁর করুণাময় দৃষ্টি এক ডাকাতকে মানুষ বানিয়েছিল, আর তাঁর ভক্তি এই জনপদকে আশ্রয় দিয়েছিল। তাই তেলোভেলোর মানুষ আজও বলে—“সারদা মা রাগ করেন না, তিনি পথ দেখান।” এই পথচলাতেই ভয় মিলিয়ে যায় ভক্তির আলোয়।
এই কাহিনি কেবল লোকবিশ্বাস নয়, এটি বাংলার লোকধর্মের গভীর গঠনপ্রক্রিয়ার অংশ। যেখানে দেবী কেবল অলৌকিক শক্তি নন, তিনি মা—যাঁর কাছে অপরাধীও সন্তানের মতো, আর সন্তানই তাঁর আশ্রয়। তেলোভেলোর সারদা মা সেই বিশ্বাসেরই প্রতীক।
সুমন্ত বড়াল




