।। চুপিসাড়ে ইতিহাসের গল্প বলা মন্দিরটা ।।
( মানকুন্ডুর দশভূজা মন্দির )
একটা ব্যাস্ত শহরের ব্যস্ততা মোড়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মন্দির । আশেপাশের মানুষজন রোজই সেটা দেখে , কিন্তু ওইটুকুই। তার সাথে যে ইতিহাস অনেক কিছু জড়িয়ে আছে তা বোধহয় চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে আপনি হয়তো জানেন না ।আপনার বাড়ির পাশের মন্দিরের সাথে মোঘল আমল এর ইতিহাস জড়িয়ে ।
হ্যাঁ ,ঠিক এমনটাই হয়েছে, আজ সেই গল্প।জেলার ব্যাস্ততম শহর মানকুন্ডু । মানকুন্ডু শহর টা একটু অস্তিত্ব হীনতায় ভোগে ,কারণ চন্দননগর শহর টা এই শহররের নাম টা প্রায় গিলেফেলেছে ।এই শহরের অস্তিত্ব জানান দেয় তার রেল স্টেশন টা । সে যাইহোক , এই মানকুন্ডুর এক মন্দিরের গল্প । সাধারণত তথ্য ভিত্তিক লেখা হয় তবে আজ স্বাদ বদল । কলকাতার দিক থেকে জিটিরোড ধরে আসছেন চন্দননগর গেট পাড় হয়ে বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে কিছুটা গেলেই দশভূজা তলা আর ডান দিকে কিছুটা গেলেই আপাত বৈচিত্র হীন একচালা মন্দির দশভুজা ।আজ এই মন্দিরের গল্প ।একঝলক দেখলে এই মন্দির কে চোখে লাগবে না, আর মন্দিরের সামনের নাট মন্দির ,মন্দির টাকে ঢেকে ফেলেছে ।তবে এই চালা মন্দির এর গায়ে টেরাকোটা র কাজ ছিল ।
কিন্তু গায়ে প্রলেপের লাল রঙ আর রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে সে কাজ নষ্ট হয়ে গেছে ।ত্রিখিলান বিশিষ্ট দরজা চোখ টানে। ভিতরে অষ্টধাতুর এক ফুটের দশভুজা মুর্তি ,আর রাধা কৃষ্ণ মূর্তি ।মন্দিরের পাশে দূর্গা মন্দির সেখানে দূর্গা পুজা হয় ।এটাই সবচেয়ে বড় উৎসব এই মন্দিরের ।এ তো সব মন্দিরের গল্প , কিন্তু এই দশভুজা মন্দিরের একটা ইতিহাস আছে আর আছে একটা গল্প সেটাই মন ছুঁয়ে যায় ।
সেই গল্পে আসার আগে , প্রাসঙ্গিক কিছু কথা -- দশভুজা মন্দির দিনের বেশী সময় বন্ধ থাকে সকালে ও সন্ধ্যে তে মন্দিরের পাশের দিকের দরজা খুলে পুজো হয় ।এই মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা হয় অনু দিদি র সাথে তিনি সব ব্যবস্থা করেন এবং মন্দির যাদের তাদের সাথেও আলাপ করিয়ে দেন । আর এই আলাপ পর্ব ই গল্পের জন্ম দেয় ।
মানকুন্ডুর দশভুজা মন্দির বর্তমানে স্থানীয় মজুমদার বংশ দেখভাল করে । আলাপ হল এই বংশের বর্ষীয়ান সদস্য শ্রী পঞ্চানন মজুমদার এর সাথে। কথায় কথায় তিনি একটা ডায়েরি দেখালেন , ডায়েরি টির বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই ।পঞ্চানন বাবুর বাবার লেখা এই ডায়েরি পড়ে জানা যায় এই মন্দির মোঘল আমালের । রাজা মানসিং বাংলায় এসেছিলেন এবং শিবির করেছিলেন তৎকালীন শ্যামবাটি গ্রামে ।এই শ্যামবাটি পরবর্তী তে মানকুন্ডু । রাজা মানসিং এর ঘোড়া হারিয়ে গেলে স্থানীয় যুবক রাম রাম ঘোষ সেই ঘোড়া খুজেঁ আনেন। মান সিং খুশী হয়ে তাকে মোঘল দরবারের কাজে বহাল করেন । পরবর্তীতে রামরাম এর কাজে খুশি হয়ে তাকে শ্যামবাটি অঞ্চলের জায়গীরদার করা হয় এবং মজুমদার উপাধি দেওয়া হয় ।এই রামরাম মজুমদার এই এই দশভুজা মন্দিরের স্থাপনা করেন ।এই মন্দিরের বয়স আনুমানিক চারশো বছরের বেশী ।এতো গেল ইতিহাস এর কথা এই মন্দিরের একটি লৌকিক গল্প ও রয়েছে ,সেই ডায়েরি পড়ে তাও জানা যায় । আর সেই গল্প আরও আকর্ষণীয় ।
( দশভূজার বিগ্রহ )
এই গল্প এক ডাকাতের গল্প । ডায়েরি অনুযায়ী এক ডাকাত দল এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে অন্ন গ্রহণ করে এত প্রসন্ন হয় যে তারা তাদের ডাকাতির একটা অংশ ব্রাহ্মণ কে দিতে চায় । সেই ডাকাত দলের ডাকাতি সামগ্রীর মধ্যে ছিল এই দশভূজা মূর্তি টিও।। তারা লুঠ করার সময় বাড়ির কূলদেবীকেও লুঠ করে আনে .. তো ব্রাহ্মণ সেই দেবী মূর্তি পরম যত্নে ও ভক্তি ভরে স্থাপন ও পুজা শুরু করে । কিন্তু দেবী তাকে স্বপ্ন দেয় যে তিনি ব্রাহ্মণের ঘরে অন্নভোগ গ্রহণ করবেন না তাকে যেন মজুমদার দের বাড়িতে দিয়ে আসা হয় । ঠিক একরকম স্বপ্নদেশ পান জমিদার রামরাম মজুমদার এবং ব্রাহ্মণ অষ্টধাতুর মাতৃ মূর্তি জমিদার কে দিয়ে আসেন।। তারপর স্থাপিত হয় এই দশভুজা মন্দির ।
( প্রাচীন রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ )
তবে সেই ট্রাডিশান আজও চলছে ,শূদ্রের ঘরে পুজীত দেবীর নিত্যপুজা হলেও অন্নভোগ হয়না ।
তবে ডাকাত দলের কাহিনী গল্প কথা হতে পারে কিন্তু ১৯৬৮ সালে এই মন্দিরের বিগ্রহ সত্যিই চুরি গিয়েছিল , সেই সময়কার সংবাদ পত্রে সে খবর ছাপা ও হয় । চন্দননগর এর লাল দিঘী থেকে সেটি উদ্ধার করা হয় ।
প্রায় চার শতাব্দী ধরে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন দেবী দশভুজা এই মানকুন্ডু অঞ্চলে আপাত বৈচিত্র্য হীন হয়ে । হয়ত বিগ্রহ থেকে যাবে , কিন্তু কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে এই মন্দির আর ইতিহাস ।।
( ছবি ও লেখনি - সুমন্ত বড়াল )
হুগলী দর্শন
No comments:
Post a Comment