Tuesday, 16 September 2025

 শিল্পশহরের নিঃশব্দ দেবশিল্পী

(রিষড়ার বিশ্বকর্মা মন্দির)

সুমন্ত বড়াল




রিষড়া—হুগলির এক পরিচিত প্রাচীন   শিল্পনগরী। বিস্তীর্ণ কারখানা, কলকারখানার ধোঁয়া, গমগমে মিলের শব্দ, শ্রমিকদের ভিড়—সব মিলে এ শহরকে এক বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। এ অঞ্চলের প্রতিটি ইট যেন শিল্পের গল্প বলে। অথচ এই শিল্পাঞ্চলের বুকেই লুকিয়ে আছে এক অনন্য মন্দির—দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার মন্দির। জেলার নিরিখে এটাই সম্ভবত একমাত্র বিশ্বকর্মা মন্দির, যা রিষড়াকে অন্য শহরের থেকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।


এই মন্দির আজ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পুরনো। ১৯৭১ সালে স্থানীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই মন্দির আজও রিষড়ার সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ মন্দিরের বিশেষত্ব শুধু বয়সে নয়—বরং তার বিগ্রহের রূপে। এখানে যে বিশ্বকর্মা পূজিত হন, তিনি আধুনিক বাংলার লোককল্পিত দাড়ি-কামানো সুপুরুষ নন, ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফের রেখা টানা নয়, কালো হাতির পিঠে বসা দেবতা নন। বরং তাঁর রূপ ঋগ্বেদে বর্ণিত প্রাচীন ব্রহ্মার অনুরূপ—দীর্ঘ দাড়িওয়ালা, গাম্ভীর্যময় এক দেবশিল্পী।


মন্দিরের সিংহাসনে তিনি আসীন। এক পা অন্য ঊরুর ওপর তোলা, শান্ত অথচ শক্তিশালী ভঙ্গি। তাঁর পায়ের কাছে শুয়ে আছে একটি রাজহাঁস—যেন জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রতীক হয়ে দেবশিল্পীর প্রজ্ঞাকে আরও মহিমান্বিত করে তুলেছে। এই রূপটি বাংলার প্রচলিত বিশ্বকর্মা প্রতিমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।


বাংলায় সাধারণত বিশ্বকর্মাকে আমরা দেখি সুদর্শন পুরুষরূপে—দাড়ি কামানো, গোঁফ রাখা, হাতে হাতিয়ার, আর বাহন কালো হাতি। শিলপোৎসবের দিনে তাঁকে সাজিয়ে বসানো হয় নতুন কাগজের কারখানা থেকে শুরু করে বিশাল কারখানার প্রাঙ্গণে। কর্মকাররা, যন্ত্রচালকরা, মেকানিকেরা, এমনকি কলকারখানার বড় মালিকরাও তাঁকে পূজা করেন। শিল্পের দেবতা তো তিনি! এ এক আধুনিক লোকায়ত কল্পনা, যেখানে দেবতাকে সাজানো হয়েছে শিল্পযুগের প্রতীকে।


কিন্তু রিষড়ার মন্দিরে দেবতা যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ঋগ্বেদের সেই অদ্ভুত কল্পনায়, যেখানে বিশ্বকর্মা ছিলেন মহাবিশ্বের স্রষ্টা। ব্রহ্মার মতোই তিনি মহাশক্তিধর, সমস্ত সৃষ্টির কারিগর। তাঁর হাতে শুধু যন্ত্র নয়, বরং মহাজাগতিক শক্তির আধার। রাজহাঁসের উপস্থিতি যেন ইঙ্গিত করে জ্ঞানের স্বচ্ছতায়, সেই আধ্যাত্মিক শিল্পকলায় যা মহাজগৎ গড়ে তোলে।


এখানেই আসে তুলনামূলক আলোচনা। হাতিবাহনবিশিষ্ট আধুনিক বিশ্বকর্মা বাংলার কারিগর সমাজের কাছে প্রাসঙ্গিক—তিনি যেন যন্ত্রের দেবতা, মেশিনের প্রতীক। কালো হাতি শ্রম ও শক্তির চিহ্ন হয়ে ওঠে। সেখানে রিষড়ার রাজহাঁস-বাহন দেবতা অন্য এক দিককে চিহ্নিত করেন—তাঁর শিল্প আর সৃজনশীলতার মূল উৎস হলো জ্ঞান, চিন্তা ও প্রজ্ঞা। ফলে এই দুটি রূপ একই দেবতার দুই ভিন্ন ব্যাখ্যা—একটি বাস্তব শিল্পের, আরেকটি আধ্যাত্মিক শিল্পের।


রিষড়া শিল্পাঞ্চল মানেই বাংলার শিল্পচিত্রের উজ্জ্বল অধ্যায়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই এ শহরে গড়ে ওঠে নানা কারখানা—জুট মিল, কটন মিল, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। হাজার হাজার শ্রমিকের ঘাম ও পরিশ্রমে শিল্পের চাকা ঘুরতে থাকে। তাই শিল্পের শহরে বিশ্বকর্মা দেবের মন্দির গড়ে ওঠা নিছক কাকতালীয় নয়। এখানে দেবতা যেন শ্রমিকদের হৃদয়ের প্রতীক। মন্দির গড়ে ওঠার সময় (১৯৭১ সালে) রিষড়ায় মিল শ্রমিক আন্দোলনের উত্তাল দিন চলছিল। হয়তো তখনকার শ্রমিক সমাজ অনুভব করেছিল—তাদের শিল্প, শ্রম ও স্বপ্নের দেবতা আলাদা করে পূজিত হোক।




বিশ্বকর্মার পূজা বাংলার ঘরে ঘরে হলেও মন্দিরে তাঁর পূজা বিরল। কারণ তিনি মূলত আঞ্চলিকভাবে শিল্পসংস্কৃতির দেবতা হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রিষড়ার এই মন্দির অন্য কথা বলে। এখানে তিনি মূর্তি রূপে পূজিত—স্থায়ী আসনে বসা। তাঁর দাড়িওয়ালা, প্রাচীন রূপ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, তিনি শুধু মেশিনের কারিগর নন, বরং মহাবিশ্বের শিল্পী।


পুরাণে বিশ্বকর্মা সম্পর্কে নানা কাহিনি আছে। একদিকে তিনি দেবতাদের জন্য অগ্নিমণ্ডপ, রথ, অস্ত্র তৈরি করেছেন। আবার তিনি ইন্দ্রপ্রস্থের মতো মহারাজপ্রাসাদ গড়ে তুলেছেন। বলা হয়, স্বয়ং বিশ্বকর্মার হাতেই নির্মিত হয়েছিল লঙ্কার স্বর্ণনগরী। তিনি দেবতাদের স্থপতি, যন্ত্রবিদ, কারিগর। আর এ দিক থেকে রিষড়ার মতো শিল্পাঞ্চলে তাঁর পূজা যেন আরও তাৎপর্যপূর্ণ।


শিল্প আর দেবতার সম্পর্ক এভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠে। মানুষ যখন নিজের হাতে যন্ত্র বানায়, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, তখনও সে আসলে বিশ্বকর্মারই উত্তরসূরি। শ্রমিক যখন ঘামে ভিজে যন্ত্র চালায়, তখনও সে সেই মহাশিল্পীর ছায়াতলে দাঁড়িয়ে। রিষড়ার মন্দিরে দাঁড়িয়ে তাই মনে হয়—শিল্প কেবল অর্থনৈতিক নয়, আধ্যাত্মিকও।


এই রূপবৈচিত্র্যের গল্প এখানেই শেষ নয়। হুগলি জেলার বেগমপুরে প্রতি বছর পৌষ মাসে হয় আর এক বিশেষ বিশ্বকর্মা পূজা—তাতিদের বিশ্বকর্মা। তাঁরা তাঁকে দেখেন এক ভিন্ন রূপে—সেখানে তাঁর বাহন রাজহাঁস বা হাতি নয়, বরং ঘোড়া। এ এক আশ্চর্য লোকায়ত বিশ্বাস। বেগমপুরের তাঁতিদের জীবনে ঘোড়া হয়তো শক্তি, গতি ও টানটান ছন্দের প্রতীক। তাঁত বোনার করঘাটার ছন্দ যেমন নিরন্তর শব্দ তোলে, তেমনি ঘোড়ার দৌড়ের ছন্দও নিরবচ্ছিন্ন। হয়তো এই কারণেই তাতি সমাজ বিশ্বকর্মাকে ঘোড়াবাহন দেবতা হিসেবে কল্পনা করেছে।

তাঁতি বিশ্বকর্মা ঘোড়া বাহন



এই দিক থেকে দেখলে আমরা পাই বিশ্বকর্মার রূপ আসলে বহুরূপী। শিল্পভেদে, সমাজভেদে, কালের প্রেক্ষিতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন। রিষড়ার রাজহাঁস-বাহন বিশ্বকর্মা, বাংলার লোকায়ত হাতিবাহন বিশ্বকর্মা, আর বেগমপুরের ঘোড়াবাহন বিশ্বকর্মা—সবাই মিলে এক বৃহৎ শিল্প-স্রষ্টার চিত্র রচনা করে। কোথাও তিনি প্রজ্ঞার প্রতীক, কোথাও শ্রমের, কোথাও আবার গতি ও ছন্দের।


বিশ্বকর্মা মূর্তির এই বহুরূপ আমাদের শেখায়, শিল্প কেবল যন্ত্রে আবদ্ধ নয়। শিল্প মানে সৃজনশীলতা, জ্ঞান, শক্তি, শ্রম, আর ছন্দ—সবকিছু মিলেই। বেগমপুরের তাতি সমাজ যেমন তাঁকে দেখে নিজের কাজের প্রতিচ্ছবিতে, তেমনি রিষড়ার শ্রমিকও তাঁকে দেখে কারখানার ইঞ্জিনের শব্দে।


আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি কেটে গেছে। হয়তো রিষড়ার মন্দিরের চুনসুরকি পুরনো হয়েছে, রঙচঙে দেয়াল একটু বিবর্ণ হয়েছে। বেগমপুরের তাতি পল্লিতেও হয়তো আগের মতো চেনা ভিড় নেই। তবু যে মূর্তিগুলি বসে আছেন, তাঁরা এখনও মানুষের মনে একইভাবে বেঁচে আছেন। প্রতিটি মিল শ্রমিকের হাতের ঘাম, প্রতিটি তাঁতির করঘাটার শব্দ, প্রতিটি যন্ত্রের গর্জন, প্রতিটি ঘোড়ার ছুট—সবই যেন তাঁর প্রতি এক নীরব অঞ্জলি।



এ মন্দিরে ঢুকলেই এক অদ্ভুত শান্তি নেমে আসে। বাইরের মিলের গমগমে শব্দ যেন দূরে সরে যায়, শুধু শোনা যায় রাজহাঁসের ডানার মৃদু ঝাপট। আর পৌষ মাসে বেগমপুরের রাতভর বাজতে থাকা মানুষের কোলাহল মনে করায়—শিল্পের দেবতা আজও মানুষের ঘরে ঘরে বেঁচে আছেন। মনে হয়, এখানে শিল্প কেবল কারখানার নয়, শিল্প কেবল তাঁতের নয়, শিল্প মানে সৃষ্টির মহা রহস্য।

No comments:

Post a Comment

তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি

                            তেলোভেলোর সারদা: ভীম ডাকাতের রূপান্তরের লোককাহিনি হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত মায়াপুর অঞ্চলের তেলোভেলো...