বিদ্যালয়ের
মণ্ডপে মা দুর্গা: বৈঁচি গ্রামের ব্যতিক্রমী ঐতিহ্য
স্কুলের
ভিতরে দুর্গাপুজো। এ এক ব্যাতিক্রম
বিষয়। সারা বাংলায় যার
একমাত্র নিদর্শন মেলে হুগলী জেলার
বৈঁচি গ্রামে। সাধারণত বিদ্যালয় শুধুই শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, কিন্তু বৈঁচির সেই বিদ্যালয় জমিদার
বিহারীলাল মুখোপাধ্যায়ের পৈত্রিক বাড়ির উপর প্রতিষ্ঠিত। শতাধিক
বছরের পুরনো ঐতিহ্য, জমিদারের ভক্তি ও গ্রামের মানুষের
আস্থা মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক
অনন্য মিলনক্ষেত্র।
১৮৭৭
সালের বঙ্গদেশে নবজাগরণের আলো যখন ধীরে
ধীরে গ্রামবাংলার আঙিনায় পৌঁছচ্ছে, তখন হুগলি জেলার
শান্ত বৈঁচি গ্রামে এক জমিদার নিজের
সময়কে অতিক্রম করে এক কাজের
স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি জমিদার বিহারীলাল
মুখোপাধ্যায়। গ্রামজীবনের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে
যে চিন্তা, সেই যুগের অধিকাংশ
জমিদারের ছিল না, কিন্তু
বিহারীলাল ছিলেন ব্যতিক্রম। শিক্ষার প্রসার তখন মূলত শহরকেন্দ্রিক,
গ্রামীণ মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই
প্রেক্ষাপটেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরামর্শ তিনি বড় মনের
সঙ্গে গ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর ততদিনে সমগ্র বাংলায় নারীশিক্ষা, বিধবা পুনর্বিবাহ ও বিদ্যালয় গঠনের
আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর কথায় বিহারীলাল
উপলব্ধি করেন—জমিদারির প্রকৃত মাহাত্ম্য ক্ষমতা প্রদর্শনে নয়, শিক্ষার আলোয়
জনপদকে উজ্জ্বল করে তোলার মধ্যে।
সেই ভাবনা থেকেই তিনি গড়ে তোলেন
“বিহারীলাল উচ্চ অবৈতনিক বিদ্যালয়” ও একটি দাতব্য চিকিৎসালয়।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর নিজের
জমিদার বাড়ির মধ্যেই, যাতে গ্রামবাসীর সন্তানরা
নিখরচায় পড়াশোনা করতে পারে, আর
অসহায় মানুষ পায় বিনা খরচে
চিকিৎসা। এই উদ্যোগে বিদ্যাসাগরের
উৎসাহ ছিল প্রধান অনুপ্রেরণা—তাঁর
ভাষায়, “যে গ্রামে শিক্ষা
নেই, সেই গ্রামের ধন
সম্পদে নয়, অজ্ঞতায় মোড়া
থাকে।”
কিন্তু
শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি বিহারীলালের মনে ছিল পৈতৃক
দুর্গাপুজোকে আগলে রাখার ইচ্ছা।
তাঁর বাবা ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়
বহু বছর আগে এই
পুজোর সূচনা করেছিলেন। পরিবারের নিঃসন্তান উত্তরাধিকারী হিসেবে বিহারীলাল বুঝতেন, পরবর্তী প্রজন্ম না থাকলে এই
প্রাচীন আয়োজন একদিন মিলিয়ে যাবে। তাই ১৮৭০ সালে
তিনি দলিল লিখে যান—নিজের
সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং বার্ষিক দুর্গাপুজোর
দায়িত্ব গ্রামেরই হাতে থাকবে, বিদ্যালয়ের
ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা মিলেই
তা চালিয়ে যাবে। তিনি ঘোষণা করেন,
“আমার মৃত্যু পরেও পুজো চলবে
গ্রামের সন্তানদের হাতে। এ আমার প্রতিশ্রুতি।” এই
দলিল আজও মুখোপাধ্যায় পরিবারের
ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল,
যা শতাধিক বছরের পরও সেই প্রতিজ্ঞার
সাক্ষ্য বহন করছে।
বিহারীলালের
আমলে যে জমিদার বাড়ি
আভিজাত্যে ভরপুর ছিল, তার স্থাপত্য
আজও গ্রামের গর্ব। বিশাল নাটমন্দির, উঁচু খিলান, দোতলা
বাড়ির লাল ইটের গায়ে
সময়ের রঙ—সবই যেন পুরনো
দিনের গল্প বলে। নাটমন্দিরের
কেন্দ্রে হত দেবীর পুজো,
যেখানে একসঙ্গে দুর্গা ও জগদ্ধাত্রীর মূর্তি
বসানো হত। চারপাশে সানাই
ও ঢাকের আওয়াজে কেঁপে উঠত বৈঁচি গ্রাম।
উৎসবের দিনগুলোয় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত
মেলা দেখতে, অঞ্জলি দিতে। সেই ঐশ্বর্যের কথা
গ্রামের প্রবীণরা এখনও চোখ ভিজিয়ে
বলেন—“রাতভর আলো জ্বলে উঠত
নাটমন্দিরে, আর ঢাকের তালে
তালে ঘুম ভাঙত গোটা
গ্রাম।”
কালের
স্রোতে জমিদারির চাকচিক্য হারালেও এই পুজো বন্ধ
হয়নি। বাড়িটি পরিণত হয়েছে বিদ্যালয়ে, কিন্তু দুর্গাপুজোর আবহ রয়ে গেছে
অবিকল। আজ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী
এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা একসঙ্গে এই উৎসবের আয়োজন
করেন। আশ্বিন মাসের শারদীয়া সকাল থেকে স্কুলের
আঙিনা ভরে ওঠে সাজসজ্জায়।
নিজেরাই আঁকে আলপনা, গড়ে
তোলে অস্থায়ী মণ্ডপ, কাগজের ফুলে সাজায় প্রাচীন
নাটমন্দির। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত
চার দিন যেন গ্রামের
প্রতিটি মানুষের কাছে আনন্দের বার্তা
নিয়ে আসে। ষষ্ঠীতে বোধনের
ধ্বনি, সপ্তমীতে অঞ্জলির ভিড়, অষ্টমীতে সন্ধিপুজোর মহিমা—সবই আজও চলে
সেই পুরনো নিয়মে।
প্রাচীন
নাটদালান বহুবার সময়ের ক্ষয়ে জীর্ণ হয়েছে। একসময় প্রবল বর্ষায় ছাদ চুঁইয়ে জল
পড়ত, তখন ত্রিপল খাটিয়ে
দেবীর মূর্তি রক্ষা করে পুজো করা
হত। পরবর্তীকালে মুখোপাধ্যায় পরিবার ও গ্রামবাসীর উদ্যোগে
নাটমন্দিরের সংস্কার হয়। বর্তমান পরিবারের
সদস্য সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় জানালেন, “আমাদের পূর্বপুরুষের অঙ্গীকার আজও আমরা পালন
করি। বাড়ির দায়িত্ব গ্রামের সঙ্গে ভাগ করে নিলেও,
এই পুজো আমাদের গর্ব।
স্কুলপড়ুয়ারা যে নিষ্ঠার সঙ্গে
দেবীকে বরণ করে, তাতে
মনে হয় বিহারীলাল ঠাকুরের
আশীর্বাদ আজও রয়েছে।” সিদ্ধার্থবাবুর কথায় মিশে আছে একরাশ
আবেগ—কারণ তিনি নিজেও
ছোটবেলায় এই পুজোয় অংশ
নিয়েছেন, নাটমন্দিরের মাটিতে খেলেছেন, আর আজও বিজয়ার
দিন শঙ্খ বাজিয়ে বিসর্জনে
যোগ দেন।
দুর্গাপুজোর
ভোগের রীতি এখনও সেই
পুরনো। সেদিন গ্রামের গৃহিণিরা একসঙ্গে রান্না করেন খিচুড়ি, লাবড়া,
পায়েস, নানা তরকারি। বিশেষ
ভোগের দিনে আখ ও
চালকুমড়োর বলি দেওয়ার প্রথা
আজও রক্ষিত। বয়স্করা বলেন, “এটা কেবল আচার
নয়, মা অন্নপূর্ণার প্রতি
কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।”
দশমীর
দিন যখন সিঁদুরখেলা শেষ
হয়, তখন শুরু হয়
বিসর্জনের শোভাযাত্রা। স্কুল থেকে বেরিয়ে গ্রামপথ
ধরে মিছিল নামে বামনা পুকুরের
দিকে। সানাই বাজে, ঢাকের তালে তালে উঁচু
হয় উলুধ্বনি। নদীর জলে প্রতিফলিত
হয় সন্ধ্যার লাল আভা, আর
তার সঙ্গে মিশে থাকে মানুষের
চোখের জল। ছোট বড়
সবাই মিলে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে
থাকে, কেউ ফুল ছিটিয়ে
দেয়, কেউ হাতজোড় করে
প্রার্থনা করে—“মা, আবার এসো।” বিসর্জনের
মুহূর্তে গ্রামের আকাশ ভরে ওঠে
শঙ্খধ্বনিতে, যেন বিদায় নয়,
আগামী বছরের আমন্ত্রণ।
আজকের
দিনে এই পুজো শুধু
ধর্মীয় আচার নয়, শিক্ষার
ইতিহাসের অংশও বটে। বিদ্যাসাগরের
পরামর্শে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়,
বিহারীলালের উদার দলিল, আর
মুখোপাধ্যায় পরিবারের আজও অবিচল অংশগ্রহণ—সব মিলে এটি এক
অনন্য ঐতিহ্য। গ্রামের মানুষ বলেন, “এ পুজো আমাদের পরিচয়,
আমাদের গর্ব। এখানে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা শুধু
বিদ্যা নয়, ঐতিহ্যের মূল্যও
শেখে।”
বছর
ঘুরে আসে দুর্গোৎসব, নতুন
প্রজন্ম যোগ দেয় পুরনো
স্রোতে। বিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীরা যখন
ঢাক বাজায়, আলপনা আঁকে, তখন মনে হয়
বিহারীলাল ও বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন
পূর্ণতা পাচ্ছে। জমিদার বাড়ি আজ স্কুল হলেও
তার ইটপাথরের ভেতর লুকিয়ে আছে
শতাব্দীর গৌরব, মানবসেবার চেতনা আর শারদীয়ার আনন্দ।
সময়ের সঙ্গে গ্রাম বদলেছে, চারপাশের দালানকোঠা আধুনিক হয়েছে, কিন্তু বৈঁচি গ্রামের এই দুর্গাপুজো আজও
এক চিরন্তন প্রতিশ্রুতির মতো বেঁচে আছে—শিক্ষা,
ঐতিহ্য আর সম্প্রদায়ের অকৃত্রিম
বন্ধনের নিখুঁত উদাহরণ হিসেবে।
No comments:
Post a Comment