সোনাঝুরির
জঙ্গলে হীরালিনী দুর্গোৎসবের অনন্য কাহিনি
সুমন্ত বড়াল
বোলপুরের
নাম শুনলেই শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি, কোপাই নদীর পাড়ের শান্ত
সবুজ প্রান্তর আর সোনাঝুরির হাটের
ছবিই আগে মনে ভেসে
ওঠে। প্রতি শনিবারের সেই বিখ্যাত হাট
আজ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের
আকর্ষণের কেন্দ্র। ঠিক এই হাটের
লাগোয়া জঙ্গলের এক ধারে রয়েছে
এক অপূর্ব আয়োজন—হীরালিনী দুর্গোৎসব। বনের ভেতর, বুনোফুলের
গন্ধমাখা বাতাসে, মাদলের তালে তালে যে
পুজোর আসর বসে, তাকে
শুধু পুজো বলা চলে
না; এটি যেন এক
মহোৎসব, এক শিল্পমেলা, এক
শান্তির বার্তা।
সময়ের
কাঁটা পিছিয়ে যাই ২০০১ সালের
শরতে। বোলপুরের কাছেই বল্লভপুরের বনেরপুকুর ডাঙা গ্রামে বসবাস
করতেন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র
এবং পরবর্তীকালে শিল্পী হিসেবে পরিচিত বাঁধন দাস। শিল্পের নানা
মাধ্যমে নিজের কল্পনাকে প্রকাশ করতে ভালোবাসতেন তিনি।
একসময় মনে হল, শিল্প
আর প্রকৃতিকে মিলিয়ে এক ভিন্নরকম দুর্গোৎসব
কেন গড়ে তোলা যাবে
না? সেই ভাবনা থেকেই
জন্ম নিল এক অনন্য
পুজোর ধারণা—সোনাঝুরির জঙ্গলে দুর্গাপুজো।
বাধন
দাসের বাড়িতেই শুরু হয়েছিল সেই
আয়োজন। প্রথাগত ঢাকঢোল, মাইকে উচ্চ শব্দের গান
নয়; বরং ছিল শান্ত
পরিবেশ, প্রকৃতির ঘ্রাণ, সাঁওতাল গ্রামবাসীর সঙ্গ। প্রথম বছর তিনি তৈরি
করলেন এক টেরাকোটা মূর্তি।
সেই মূর্তি যেন মাটির শরীর
ছুঁয়ে গেল আকাশের নীল।
পরের বছর কাঠের মূর্তি।
শিল্পী হিসেবে বাঁধনের একটাই উদ্দেশ্য—প্রকৃতি ও শিল্পের মিলন
ঘটিয়ে পুজোকে এক অন্যরকম শিল্প-উৎসবে পরিণত করা।
কিন্তু
নিয়তির লিখন কে আটকায়!
২০০২ সালেই বাঁধন দাসের অকাল মৃত্যু পুজোর
ভবিষ্যৎকে থমকে দিল। মনে
হচ্ছিল, হয়তো এই নবীন
উৎসব সেখানেই শেষ হবে।
ঠিক
তখনই এগিয়ে এলেন তাঁর ছাত্র
শিল্পী আশিস ঘোষ। গুরুদক্ষিণা
হিসেবে তিনি পুজোর দায়িত্ব
নিলেন। শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাঁকে
এক নতুন পথের দিশা
দেখাল। আশিস শুধুমাত্র পুজো
চালিয়ে গেলেন না, প্রতি বছর
নতুন শিল্পরীতি, নতুন উপকরণ দিয়ে
পুজোর ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করলেন। ফাইবার কাস্টিং, বাঁশ, লোহা, কাঠ—বছর বছর নতুন
মাধ্যম ব্যবহার করে গড়ে তুললেন
একের পর এক স্থায়ী
দুর্গামূর্তি। আজ অবধি পাঁচটি
স্থায়ী মূর্তি তৈরি হয়েছে, যেগুলি
বিসর্জন দেওয়া হয় না; প্রতি
বছর নতুন সাজে মণ্ডপে
প্রতিষ্ঠা করা হয়।
হীরালিনী
দুর্গোৎসবের সবচেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য দেবীর হাতে অস্ত্র না
থাকা। ২০০১ সালে প্রথমবার
দেবীর হাতে অস্ত্র তুলে
দিয়েছিলেন বাঁধন দাস। কিন্তু সেই
বছরেই ঘটেছিল আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভয়াবহ সন্ত্রাস, পরে ইরাক যুদ্ধ,
চারদিকে অস্থিরতা। ঠিক সেই সময়
বাঁধন দাস এক অনন্য
সিদ্ধান্ত নেন—পরের বছর থেকে
মা দুর্গার হাতে থাকবেন না
কোনো অস্ত্র, থাকবে শান্তির প্রতীক পদ্মফুল। বিশ্বশান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ যেন
এক শিল্পীসুলভ প্রতিবাদ। বাঁধনের মৃত্যুর পরও এই প্রথা
অটুট রেখেছেন আশিস ঘোষ। আজও
মণ্ডপে প্রতিমার হাতে জ্বলজ্বল করে
শান্তির সেই গোলাপি-সোনালি
পদ্ম।
এই পুজোর আরেক বৈশিষ্ট্য তার
সামাজিক রূপ। আশেপাশের সাঁওতাল
পরিবারগুলোই আসল আয়োজক। বনেরপুকুর
ডাঙা, ফুলডাঙা, সরকারডাঙা—এই গ্রামগুলির আদিবাসী
সম্প্রদায়ের মানুষজন পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। মণ্ডপ
সাজানো থেকে রান্না, অতিথি
আপ্যায়ন—সব ক্ষেত্রেই তাঁদের নিঃস্বার্থ সহযোগিতা পুজোকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা।
মহাসপ্তমী
থেকে মহানবমী পর্যন্ত মঞ্চে চলে তাঁদের নাচ-গান। ধামসা-মাদলের
গভীর তাল ছড়িয়ে পড়ে
চারিদিকে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ড, এমনকি বিহার থেকেও শিল্পীরা আসেন লোকসংগীত আর
ঐতিহ্যবাহী নৃত্য নিয়ে। প্রকৃতির কোলে বসে এই
নৃত্যগীতের স্রোতে মিশে যায় দেবী
আবাহনের আচার। ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর সাংস্কৃতিক আসর—দুটিই
সমান গুরুত্ব পায় এখানে।
সোনাঝুরির
হাটের জন্য পর্যটক তো
আসেনই, কিন্তু দুর্গোৎসবের সময় ভিড় বেড়ে
যায় কয়েকগুণ। কলকাতা সহ রাজ্যের নানা
প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে
আসেন এই অনন্য পুজো
দেখতে। এখানে আলাদা কোনো প্রচার নেই,
নেই শহুরে কোলাহল, তবু মুখে মুখেই
ছড়িয়ে পড়ে এর নাম।
একবার যারা এসেছেন, পরের
বছর তাঁরাই আবার বন্ধু-পরিবার
নিয়ে ফিরে আসেন।
পুজোর
মণ্ডপ প্রতিবারই শিল্পকর্মের এক নতুন অধ্যায়।
বাঁশ, খড়, মাটি, কাঠ—প্রতিটি
উপকরণেই শিল্পীরা নতুন কিছু সৃষ্টি
করেন। মণ্ডপের চারপাশে সাজানো থাকে স্থানীয় শিল্পীদের
আঁকা ছবি, টেরাকোটা কাজ,
কাঠখোদাই, মাটির পুতুল। এটি যেন এক
ক্ষুদ্র শিল্পমেলা, যেখানে ধর্ম আর শিল্প
হাত ধরাধরি করে পথ চলে।
২০২৫
সালে এই পুজোর এক
বিশেষ আকর্ষণ হলো নতুন সংযোজন—কাঠের
খোদাই করা ষষ্ঠ মূর্তি।
বহুদিনের প্রস্তুতির পর মণ্ডপে বসানো
হয়েছে এই মূর্তি, যা
দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ জাগিয়েছে। সূক্ষ্ম খোদাই, কাঠের স্বাভাবিক রঙ আর দেবীর
শান্ত মুখমণ্ডল এক অপার্থিব আবহ
তৈরি করে। স্থানীয়রা যেমন
গর্বে বুক ভরে দেখেন,
তেমনি পর্যটকরাও বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন।
কেউ
বলেন ‘বাঁধনদার দুর্গাপুজো’,
কেউ বলেন ‘হীরালিনী দুর্গোৎসব’,
আবার অনেকে ডাকেন ‘দুর্গাবাড়ির পুজো’ বা ‘সোনাঝুরির পুজো’। নাম আলাদা হলেও
মনের টান একই—প্রকৃতি আর শান্তির পুজো।
এই পুজোর গন্ধ শহুরে আলো-ঝলমলের থেকে আলাদা। এখানে
মন্দিরের গর্ভগৃহের মতো গম্ভীরতা নেই,
আবার বড় পুজোমণ্ডপের মতো
আড়ম্বরও নেই। আছে প্রকৃতির
নীরবতা, বনফুলের মিষ্টি গন্ধ, মাদলের ধ্বনি আর মানুষের মিলন।
হীরালিনী
দুর্গোৎসব শুধু একটি ধর্মীয়
অনুষ্ঠান নয়, এটি এক
সাংস্কৃতিক আন্দোলন। দেবীর হাতে পদ্ম শান্তির
প্রতীক, যা আজকের অস্থির
পৃথিবীতে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা
দেয়। ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে এই
পুজো মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে শেখায়। স্থানীয়
শিল্পীদের কাজ, আদিবাসী নৃত্য,
লোকসংগীত—সব মিলিয়ে এই উৎসব শিল্প-সংস্কৃতির এক অমূল্য ভান্ডার।
প্রতি
বছর এই পুজো শেষ
হয় না বিসর্জনের গঙ্গায়;
শেষ হয় নতুন আশার
আলো নিয়ে। মূর্তি থাকে, কেবল সাজ পাল্টায়,
বার্তা থেকে যায়—মানবিকতা আর শান্তিই সর্বোচ্চ।
No comments:
Post a Comment