Saturday, 31 August 2019













                
                 শতাব্দী প্রাচীন শ্রীধর দামোদর মন্দির 


হুগলী জেলা কে যদি বলা হয় মন্দিরময় জেলা তাহলে ভুল কিছু বলা হয়না .. জেলার প্রত্যেক প্রান্তই মন্দিরে ঘেরা .. একদিকে রাধাবল্লভ , জগন্নাথ তো অন্যদিকে আনন্দময়ী , বৃন্দাবন চন্দ জীউ , আবার অপর দিকে রাধাকান্ত , দূর্গা , ঘণ্টেশ্বর তো আর একদিকে জটেশবর .. চারিদিক জুড়ে মন্দিরের সমারোহ .. আর এই সব মন্দির এই জেলার ইতিহাসের সাক্ষী , পুরোকীর্তির বাহক ..
আজ এমন ই এক প্রাচীন , স্থাপত্য এর কথা বলবো ..
মন্দির এর কথা বলার আগে মন্দির টি যে স্থানে অবস্থিত সেই যায়গার কথা একটু বলে নেওয়া ভালো .. জেলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এক প্রাচীন জনপদ , রাঢ় বাংলার  উল্লেখযোগ্য হিন্দু রাজার রাজ্য  ভুরিশ্রেষ্ট বা ভুরশুট এর রাজধানী রাজবহল হাট ..  রাজবল্লভী মায়ের নামে নামাঙ্কিত এই যায়গায়র ইতিহাস বড়ই গৌরবময় , তবে ইতিহাসের সে গৌরব আজ অস্তাচলেকিন্তু আজ ও এই জনপদের অলিগলি তে শোনা যায় তাত বোনার শব্দ যা এখানকার ঐতিহ্য আর অতীত গৌরবের সাক্ষী এই অঞ্চলের মন্দির গুলি .. রাজবলহাটের রাজবল্লভী মা ভারত বিখ্যাত . সে মন্দিরের কথা বলছিনা .. আজ বলবো রাজবলহাটেরই প্রায় ২০০বছর পুরানো আর এক মন্দিরের কথা ..
এই অঞ্চলের শীলপাড়ায় অবস্থিত শ্রীধর দামোদর মন্দির ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে স্থানীয় শীল বংশের পূর্বপুরুষ শ্রী লম্বোদর শীল এই মন্দির নির্মাণ করেন প্রাচীন এই আটচালা মন্দির নির্মাণ শৈলীর দিক থেকে বিশেষত্বর দাবী না রাখলেও এই মন্দিরের অলংকরণ গুলি বিশেষত্বর দাবী রাখে , নিম্নভিত্তির উপর স্থাপিত এই মন্দির টেরাকোটায় অলঙ্কৃত ।
ফুল , লতা পাতা , দেবদেবীর পোড়ামাটির কাজ এই মন্দির কে সুন্দর করে তুলেছে .. মন্দিরের গায়ে মন্দির নির্মাণের সাল শকাব্দে লেখা রয়েছে , শকাব্দ ১৬৪৬ .. তবে  এই মন্দিরের গর্ভগৃহে কোন বিগ্রহ পুজিত হয়না .. শ্রীধর দামোদর জিউ এই মন্দিরে শীলা রূপে পুজিত হন



তবে আক্ষেপের বিষয় এই যে মন্দির টি প্রাচীনতা এবং নোনা ধরে যাওয়ার কারণে বর্তমানে মানে রঙ করা হয়েছে .. সঠিক রক্ষানাবেক্ষণ এর অভাবে যেভাবে অনেক মন্দির তার কৌলীন্য হারাচ্ছে এটা তার ব্যতিক্রম নয় .. তবে এই রঙের জন্য মন্দিরের শিল্প সুষমা একটু নষ্ট হলেও মন্দির টি রক্ষা পেয়েছে ..
এই মন্দির লাগোয়া শীল বংশের একটি দূর্গা মন্দির ও রয়েছে .. সবমিলিয়ে প্রাচীনতা আর বতর্মান সময়ের মিলমিশে শ্রীধর দামোদর মন্দির মন্দ না ..
হাওড়া তারকেশ্বর রেলপথে হরিপাল স্টেশনে নেমে বাসে রাজবলহাট পৌঁছতে পারেন , আর সড়ক পরে ডানকুনি চাপাডাঙ্গা অহল্যা বাই রোড ধরে শিয়াখালা মোড় থেকে ফুরফুরা জাঙ্গীপাড়া হয়ে নয়ত গজার মোড় থেকে আটপুর হয়ে রাজবলহাট পৌঁছে যেতে পারেন .. এই দুই রাস্তা কিন্তু ইতিহাস সমৃদ্ধ  প্রাচীন স্থাপত্যে ভরা ..


Monday, 26 August 2019


                                       ছবি ঘরে চা এ চুমুক



কিছু শহর , মফস্বল , কিংবা গ্রাম , অজান্তেই বড় প্রিয় হয়ে ওঠে ।যদি কারণ জানতে চাওয়া হয় তাহলে বলতে হয় অকারণেই ভালো লাগে। ভালো লাগে বলেই হয়তো 
এমন এক প্রিয় রাস্তা আছে যে কালো রাস্তা টা কয়েকটা শহর মফস্বল কে ছুঁয়ে চলে গেছে  অনেক দুর । এই রাস্তায় এসে পড়লে মনে হয় যেন আপনজনের কাছে চলে এলাম । তবে আজ এই রাস্তার গল্প নয় ,সেই রাস্তা যেখানে আমার প্রিয় জেলা টাকে ছেড়ে প্রতিবেশী হয়ে গেছে সেই প্রান্তের কাছে ছোট্ট মফস্বল এর এই রাস্তার উপর একটা দোকান কে নিয়ে। আজকের গল্প
একটা চায়ের দোকান ।
হ্যাঁ চায়ের দোকান ,
এস টি কে কে রোড চলতি কথায় আসাম রোড ধরে আপনি চলছেন ত্রিবেণী থেকে কালনার দিকে .. একে একে কুন্তীনদী , জিরাট , শ্রীপুর , সোমড়া পেরিয়ে যাচ্ছেন ডান হাতে রেল লাইন .. আর সবুজ ক্ষেত চেরা কালো রাস্তা কে সাক্ষী রেখে আপনি এগিয়ে চলেছেন ।কোড়লা পেরিয়ে   রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে তারপর মড়া নদী বেহুলা পার করে আপনি বেহুলা স্টেশন যাওয়ার রাস্তা র মোড়ে এসে একটু থামুন ।
অনেক টা রাস্তা এলেন এবার একটু চায়ে চুমুক দিয়ে জিরিয়ে নিন ।
হ্যাঁ আজকের গল্পের গন্তব্য  সেই চায়ের দোকান ।


 (চা খোর মানুষের সাথে বিপদ মন্ডল ডানদিনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টি)

বিপদ মন্ডলের চায়ের দোকান । মনে হতে পারে সবকিছু ছেড়ে চায়ের দোকান কেন ,  আসলে স্বাদ বদল কিংবা একটু জিরিয়ে নেওয়া আরকি ।
এই আসাম রোডে যাতায়াত করছি বেশ কিছু বছর  তবে এই দোকানের সাথে আলাপ বেশ নাটকীয় ভাবে ।
মাসটা কার্ত্তিক ,আমরা ফিরছি কালনার দিক থেকে । হেমন্তের হালকা হাওয়া আর সদ্য নামা অন্ধকার। সান্ধ্যকালীন চা না হলে চলে ? গাড়িতে আমরা তখন ছয় জন । সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ টি গাড়ি দাঁড় কারাতে বললেন  চায়ের দোকান দেখে । গাড়ি থেকে নেমে প্রথম চমক টা লেগেছিল সেদিন ,
এটা চায়ের দোকান নাকি ছবি ঘর ।
একটা চায়ের দোকান তবে আর পাঁচটা চায়ের দোকানের থেকে এটা কোথায় যেন আলাদা ।সেদিন সদ্য নামা সন্ধ্যে আর এইমাত্র জ্বলে ওঠা টিউব লাইটের আলোয় দোকান টা চমকে দিল । দোকানে ঢুকতেই ডানদিকে চা বানানোর সরঞ্জাম , বয়ামে রাখা বিস্কুট আর চা বানাচ্ছেন বিপদ মণ্ডল ।আর দোকানের বাঁ দিকে ? চমক টা ওখানেই  বাঁদিকের পুরো দেওয়াল জুড়ে কাঁচের শোকেস আর তার মধ্যে সাজানো মনীষী দের ছবি ।
সেদিন তাড়া ছিল চমক টা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম  আবার আসতেই হবে এটা প্রতিজ্ঞা করে।
আসাম রোডে আমার যাতায়াত একটু বেশী কারণ টা ব্যক্তিগত ভালো লাগা ।
তাই কিছু দিনের মধ্যে আবার হাজির হলাম সেই দোকানে । এবার সকালবেলায় দিনের স্পষ্ট আলোয় ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি এই চায়ের দোকানে আমি যখন ই চা খাই দুকাপ খাই ।চায়ের দাম সম্পর্কে বলি যে চা টা আমাদের শহরাঞ্চলে কিংবা বেহুলা গুপ্তিপাড়ার অন্য দোকানে পাঁচ টাকা নেয় , সেটা বিপদ মন্ডলের দোকানে তিন টাকা ।তাই হয়ত এই দোকানে পাতা বেঞ্চ গুলো সর্বদা ভরা ।তবে চা এর গল্প তো না দোকানের গল্প ফেরা যাক সেই কথায় ।
সেদিন সন্ধ্যেতে আমার দেখায় কিছু ভুল ছিল শুধু মনীষী রা স্থান পেয়েছেন এমন না , এদেশের  নানা ক্ষেত্রের বিখ্যাত মানুষ এর স্থান এই দোকানের শোকেসে । সেটা রাজনীতি থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী , খেলা থেকে রাজনীতি কিংবা সিনেমা সব বিখ্যাত মানুষের ছবি হাজির । বাদ জাননি সাহিত্যিকেরা ও ।এই হুগলী জেলার এক প্রান্তিক মফস্বল এর এক ছোট্ট চাওয়ালা যে ঠিক কি বার্তা দিচ্ছেন , অত জটিলতায় কাজ নেই .
তবে তার এই উদ্যোগ সত্যি অভিনবত্বের দাবী রাখে । আপনি হয়ত বহু নামি দামী কফি শপে ঝাঁ চকচকে সাজানো গোছানো পেয়ালা তে চুমুক দিয়েছেন  কিন্তু মফস্বলের এই ছোট্ট চায়ের দোকান টার মতো সাজ গোজ দেখেছেন কি ?




আর ছবি গুলো কিন্তু যাইহোক ভাবে রাখা নেই রীতিমতো ফ্রেমে বাঁধাই করে শোকেস বন্দী ।
বিপদ দা কে প্রশ্ন করে ছিলাম কি ব্যাপার এটা ? সোজা সরল উত্তর
"ভালো লাগে তাই " ..
এই দোকান বোধহয় এমন এক যায়গা যেখানে ডান , বাম সবাই একসাথে বিরাজ করেন ।
বহুবার ওই দোকান টায় গেছি  এমন ও হয়েছে যাওয়ার কথা ছিল অন্য গন্তব্যে চলে গেছি বিপদ দার দোকানে ।
ছবি ঘরে চা এ চুমুক দিতে । বাইরে থেকে আপাত বৈচিত্র্য হীন কিন্তু ভিতরে আপনাকে চমক দেবেই ।
আসাম রোড ধরে বেহুলা নদী পেরলে অবশ্যই থামতে ভুলবেন না ।ট্রেনে আসুন হাওড়া কাটোয়া লাইনে বেহুলা স্টেশন এ নেমে এস টি কে কে রোড (আসাম রোড ) দিকে হাঁটলে রাস্তার সংযোগ স্থলে খেলার মাঠের পাশে এই ছবি ঘর ।
চুপি চুপি বলি ধন্যিমেয়ে ছায়াছবির বৈরাগী কে মনে আছে , এই চায়ের দোকানে চলে আসুন চাওয়ালার সাথে কোথাও একটা মিল পেয়ে যাবেন ।।

Thursday, 15 August 2019


          এই ১৫ ই আগষ্টই বাংলায় প্রথম ছুটেছিল " পাগলা হাতি " 




আগষ্ট ১৫ মানেই ভারতের স্বাধীনতা দিবস। প্রত্যেক ভারতীয় কাছে এ এক আবেগের দিন স্মরণীয় দিন .. আমরা যারা হুগলী জেলার বাসিন্দা তার ব্যতিক্রম নই .. তবে এই ১৫আগস্ট হুগলী জেলার জন্য আরও এক ঘটনার জন্যও চিরস্মরণীয় .. তবে সেই ঘটনা  ১৯৪৭ সালের ১৫আগষ্টের নয় তার থেকে ৯৩ বছর আগের কথা .. অর্থাৎ আজ থেকে ১৬৬ বছর আগের ১৫ই আগষ্ট ..  

আজ সেই ঘটনার গল্প বলবো ..

আজ থেকে ১৬৬ বছর আগে ১৮৫৪ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলার মানুষ সাক্ষী ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনার , যে ঘটনা বাংলার মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াতের ভাবনা টাকেই বদলে দিয়েছিল সেদিন বাংলার মানুষ প্রথম দেখল একটি যান। যার গতিবেগ এর জন্য মানুষ তাকে " পাগলা হাতি " আর আদর করে যাকে ডাকত " কলের গাড়ি " হ্যাঁ রেলগাড়ি বাংলার বুকে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে রেল চলাচল শুরু আজকের দিনেই অর্থাৎ ১৫আগষ্ট আর এর সাথে হুগলীর কি সম্পর্কপ্রথম রেল চলেছিল বাংলার হাওড়া থেকে হুগলী স্টেশন এর মধ্যে আরো গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়  বাংলার প্রথম ট্রেনটি যে চারটি স্টেশনে এ    থেমেছিল তার মধ্যে তিনটি হুগলী জেলার অন্তর্গত .. শ্রীরামপুর . চন্দননগর ও হুগলী

 ১৮৫৪ এর ১৫ই আগষ্টের সেই ট্রেন এ সফর করার জন্য প্রায় তিন হাজার মানুষ আবেদন করেন কিন্তু সুযোগ পেয়েছিল মাত্র কয়েকশো জন . ১৫ই আগষ্ট. ১৮৫৪ দিনটি ছিল  মঙ্গলবার প্রথম যে ট্রেন চলবে সেই ট্রেনে চ গার্ডের কামরা ছাড়া ছিল  তিনটি প্রথম শ্রেণী , দুটি দ্বিতীয় শ্রেণী ও তিনটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরা সকাল সাড়ে আটটায় ট্রেনটির শুভ সূচনা হয় । যাত্রা শুরু করে  নয়টা চল্লিশ নাগাদ ট্রেন টি হুগলী স্টেশন পৌঁছায়  ততকালীন সময় হাওড়া থেকে হুগলীর ভাড়া ছিল ,

Add caption

প্রথম শ্রেণী ৩টাকা ,

দ্বিতীয় শ্রেণী ১টাকা ২আনা ,

তৃতীয় শ্রেণী ৭ আনা ..

 তবে এদেশে রেলের সূচনা পর্ব আরও পুরানো ।ইংরেজ ইষ্ট  ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৪৯ থেকে এদেশে রেলওয়ে কোম্পানির সাথে চুক্তি বদ্ধ হয় . তারপর শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ ও রেললাইন পাতার কাজ . কোম্পানীর এই মহৎ উদ্যোগে  প্রিন্স দবারকানাথ ঠাকুরের এক বড় ভুমিকা ছিল , তিনি বাংলায় রেলপথ এর কাজের জন্য মূল ধনের এক তৃতীয়াংশ জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে কাজে গতি  আসে .. তবে লাইন পাতার কাজে বিলম্ব হয় কারণ  রেল লাইন এর কিছুটা অংশ চন্দননগর এর উপর দিয়ে যাচ্ছিল , আর চন্দননগর ছিল সেই সময় ফরাসী উপনিবেশইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও ফারাসী সরকারের মধ্যে এই টালবাহানা না হলে হয়ত ভারতের প্রথম ট্রেন এই  বাংলায় চলত

পরবর্তী তে ফরাসি সরকারের অনুমোদন পেলে হাওড়া থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত রেল লাইন পাতা হয় ১৮৫৪ এর ৬ জুলাই পান্ডুয়া পর্যন্ত পরীক্ষা মূলক ট্রেন চালানো হয়

তৎকালীন “বেঙ্গল হরকরা” কাগজে পরদিন ইংরেজি তে খবর ছাপা হয় যার তর্জমা করলে এইরকম দাঁড়ায় - 

    

গতকাল সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটে হাওড়ায় এক বিশাল সমাবেশ হয়েছিল।  প্রথম পরীক্ষামূলক ট্রিপে যাত্রীবাহী ট্রেনের সাথে এটি লোকোমোটিভ এর চলাচল শুরু দেখতে..”

কিন্তু ১৫ আগস্ট প্রথম যাত্রায় ট্রেন চলল হাওড়া থেকে হুগলী পর্যন্ত

সেই শুরু যা আজও চলছে .. সেই রেলপথ যা আজ সারাভারতের লাইফ লাইন .. হুগলীর মানুষের কাছে তাই ১৫ই আগস্ট এক চিরস্মরণীয় দিন .. এযেমন স্বাধীনতা  দিবস .. তেমন আমাদের আদরের কলের গাড়ির এই বাংলায় পথ চলা শুরুর দিন ও বটে ।

Wednesday, 14 August 2019


                        ঝুলন যাত্রা ও শ্রীরামপুরের তিনমন্দির     



                                                      ( বর্ষা লীলায় সখী মাঝে রাধাবল্লভ )

ক্যালেন্ডারে মাস শ্রাবণ মানে ঘোর বর্ষা কাল .. আর এই ষড়ঋতুর রাজ্যে প্রত্যেক ঋতুতে রয়েছে নিজ নিজ উত্সব .. বর্ষার. শুরু অর্থাৎ আষাঢ়ের উৎসব রথযাত্রা আর শ্রাবণ মানেই ঝুলন আর রাখী পূর্ণিমা ..   
ঝুলন যাত্রা আর রাখী পূর্ণিমা উতসব শ্রীকৃষ্ণ কে কেন্দ্র করেই .. যদি আমরা শ্রীকৃষ্ণের লীলা গুলি নিয়ে চর্চা করি . বছরের বিশেষ তিন ঋতুর তিন পূর্ণিমা তে  তিনটি লীলা বা যাত্রা .. হেমন্তের রাসপূর্নিমায় রাসযাত্রা . বসন্তের পূর্ণিমা দোলপূর্ণিমা অর্থাৎ দোলযাত্রা আর বর্ষার লীলা শ্রাবণী পূর্ণিমার ঝুলন যাত্রা .. যদি  লীলা তত্ত্বের প্রতীক রূপ আলোচনা করা যায় প্রথম স্পন্দন .দ্বিতীয় উল্লাস ও নৃত্য , তৃতীয় হিন্দোল .. ঝুলন যাত্রা অর্থাৎ শ্রী রাধিকার সাথে গাছের ডালে দোল খাওয়া আনন্দ বা লীলা ..
গগণে কৃষ্ণ মেঘ দোলে  
কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে  
থির সৌদামিনী রাধিকা দোলে নবীন
ঘনশ্যাম সনে ..


                      (ঘোড়সাওয়ার বেশে মদনমোহন জিঊ )


শ্রাবনের একাদশী থেকে পুর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচ দিনের এই উৎসব বৈষ্ণব দের কাছে খুবই  জনপ্রিয় সেই সূত্রে নদীয়া জেলার নবদ্বীপ , মায়াপুরে এই উতসবে ধুমধাম করে পালিত হয় . তবে সেতো নদীয়ার কথা ..
হুগলী জেলা এমন এক জেলা যে জেলার বিশেষত্বই হলো উৎসব .. এই জেলায় সব উৎসবেই রমরমা .. ঝুলন যাত্রা তেও এই জেলা পিছিয়ে নেই .. সেই কথাই আজ বলবো ..  
জেলার অক্ষর নগরী , আধুনিকতায় ভরা , ইতিহাস , ঐতিহ্য আর চাকচিক্যে মোড়া মহকুমা শহর শ্রীরামপুর .. এই শ্রীরামপুর শহরের গল্প শুরু করলে থামাই মুশকিল .. এই শহর কে মন্দিরের শহর বললেও ভুল হবেনা .. শহর জুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দির ,যে মন্দির গুলিকে বাদ দিলে হুগলী জেলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায় ..  
এমনই তিন বহু শতাব্দী প্রাচীন মন্দির .. রাধাবল্লভ জিউ , মদনমোহন জিউ আর দ্বারকানাথ জিঊ এর মন্দির ..

                      
                       ( কৃষ্ণকালী সাজে  দ্বারকানাথ জিঊ )

শ্রাবণ মাসের পাঁচদিন এই তিন মন্দির তার আসপাশের অঞ্চল মেতে ওঠে ঝুলন উৎসবের আনন্দে .. আলোর মালায় সেজে ওঠে মন্দির গুলিপাঁচদিনে পাঁচ রকম  সাজ। তবে ঝুলন উৎসবের শেষদিন অর্থাৎ রাখী পূর্ণিমার দিন তিন মন্দিরেই সখী পরিবেষ্টিত হয়ে ভগবানের নৌকা বিলাস . স্থানীয় দের কথায় নৌকা খন্ড ..

                    
                    (নানা বেশে নানা সাজে রাধাবল্লভ জিঊ )


এবড় মজার উৎসব । রাধাবল্লভ মন্দিরে যখন রাধাবল্লভ জিঊ রাজবেশে সেজেছেন , মদনমোহন জিউ তখন রাখাল বেশে , দ্বারকানাথ  তখন হয়ত কৃষ্ণকালীর সাজে।এই তিন মন্দিরে প্রাচীনকাল থেকে এই একই নিয়েমে রীতি মেনে পালিত হচ্ছে ঝুলন উৎসব । তবে বর্তমানে উৎসবের বহর এবং চাকচিক্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে   
ভক্তি , ভক্ত , মেলা , আলো সবকিছু মিলে শ্রীকৃষ্ণের বর্ষা লীলা সত্যিই এই শ্রীরামপুর শহরে লীলাময় .. তত্ত্বের কথায় ঝুলন অর্থাৎ হিন্দোল আক্ষরিক অর্থেই সার্থক .. এই তিনমন্দিরের ঝুলন উৎসব শহর টাকে আন্দোলিত করে বটে ..
                   
                        ( নৌকা বলাসে মদনমোহন জিঊ )

হাওড়া বর্ধমান মেন শাখার জনপ্রিয় স্টেশন শ্রীরামপুর .. ট্রেনে এসে সহজে অটো বা টোটো তে করে চলে আসতে পারেন এই তিন মন্দিরে .. রাখী পূর্ণিমার দিন রাধাবল্লভ মন্দির এ ভীড় চোখে পড়ার মতো .. ঝুলন কে কেন্দ্র করে এই মন্দির চত্বরে জমজমাট মেলাও বসে .


Monday, 12 August 2019

                           ইনচুড়ার বিষহরির গল্পকথা 





ইতিহাস , মধ্যযুগীয় কাব্য এবং লৌকিক দেবদেবী এই জেলার প্রান্তে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে .. পান্ডুয়া ব্লকের ছোট্ট গ্রাম ইনচুড়া .. পান্ডুয়া থেকে যে রাস্তা পূর্ব বর্ধমান এর কালনা পর্যন্ত চলে গেছে সেই রাস্তায় ছোট্ট গ্রাম ইনচুড়া .. বেহুলা নদীর ধারের এই গ্রাম বহু প্রাচীন ..অতীতে রেনেলের মানচিত্রে এই গ্রামের কথা উল্লেখ আছে .. হাওড়া কাটোয়া শাখার সোমড়া বাজার স্টেশন থেকে এই ইনচুড়া গ্রামে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় ..


জেলার সদর মহকুমার উত্তর পূর্বে অবস্থিত এই গ্রাম বিখ্যাত তার মা মনসার ঝাপানের জন্য .. মধ্যযুগের মনসা  মঙ্গলকাব্য এর আদলে এখানে পূজা অর্চনা হয় .. এই লৌকিক দেব অর্চনার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস ও .. মুঘল আমলে নবাবা কর্মচারীরা জরিপের সময় এই বিষহরি মন্দির প্রাঙ্গণে তাবু খাটিয়েছিলেন .. রাতে এক কর্মচারী মা  মনসার সবপ্নাদেশ পান , এবং শুরু হয় ইনচুড়ার বিষহরি পুজো .. সেই সময় এই স্থান ছিল জলা ও জঙ্গলে ঢাকা .. পরবর্তীতে বাকুলিয়ার বিখ্যাত জমিদার প্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় এর প্রপিতামহ এই স্থানে ঘটা করে বিষহরি মায়ের পুজো শুরু করেন .. ইনচুড়ার এই পুজো প্রায় ৫০০বছরের পুরানো ..

                                                              ( বিষহরি মাতার মন্দির )


শ্রাবণ মাসের শুক্লপঞ্চমী তে প্রধান পুজো হয় .. পুজোর দিন .. স্থানীয় ১২টি গ্রাম থেকে মানুষ জন মাথায় করে মা মনসার মুর্তি নিয়ে আসেন .. যে মূর্তি গুলি মূল মূর্তির সাথে পুজিত হয় .. একদিনের এই পুজোর পর মূল বিগ্রহ বিসর্জন হয়ে গেলেও এই মূর্তি গুলি একবছর ধরে পুজো হয় .. এই পুজো কে কেন্দ্র করে বহু মানুষ মানত করে পাঠা বলি দেন .. যার সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায় ..
এই বিষহরি তলার পুজোর আরো এক আকর্ষণ তার মেলা .. স্থানীয় দের কাছে ঝাপানের মেলা হিসাবে পরিচিত এই মেলা সত্যি আকর্ষণীয় . কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই মেলা সুসংগঠিত .. এত বড় সুসংগঠিত গ্রামীণ মেলা সত্যি দেখা যায়না .. হরেক কিসমের জিনিষের সাথে চলে কাঠের জিনিষের বেচাকেনা ..

                                                                     ( ঝাপানের মেলা )

মুল পুজো একদিনের হলেও এই মেলা থাকে আরও একসপ্তাহ .. আর মেলা কে কেন্দ্র করে জমজমাট হয় ইনচুড়া গ্রাম ..
বতর্মান এ বিষহরি তলায় একটি নতুন ভাবে গড়ে ওঠা মন্দির রয়েছে .. মন্দিরের গেটে দাতা হিসাবে শ্রী অতুল চট্টোপাধ্যায়ের নাম লেখা ..
প্রাচীনতা ও আধুনিকতার মিলমিশে জেলার দূরপ্রান্তের অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রামের লৌকিক দেবী আরাধনা আর গ্রামীণ মেলা বেশ জমজমাট ..

হুগলী দর্শন

Friday, 9 August 2019

               ।। চুপিসাড়ে ইতিহাসের গল্প বলা মন্দিরটা ।।

                                           ( মানকুন্ডুর দশভূজা মন্দির )




একটা ব্যাস্ত শহরের ব্যস্ততা মোড়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মন্দির । আশেপাশের মানুষজন রোজই সেটা দেখে , কিন্তু ওইটুকুই। তার সাথে যে ইতিহাস অনেক কিছু জড়িয়ে আছে তা বোধহয় চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে আপনি হয়তো জানেন না ।আপনার বাড়ির পাশের মন্দিরের সাথে মোঘল আমল এর ইতিহাস জড়িয়ে ।
হ্যাঁ ,ঠিক এমনটাই হয়েছে, আজ সেই গল্প।জেলার ব্যাস্ততম শহর মানকুন্ডু । মানকুন্ডু শহর টা একটু অস্তিত্ব হীনতায় ভোগে ,কারণ চন্দননগর শহর টা এই শহররের নাম টা প্রায় গিলেফেলেছে ।এই শহরের অস্তিত্ব জানান দেয় তার রেল স্টেশন টা । সে যাইহোক , এই মানকুন্ডুর এক মন্দিরের গল্প । সাধারণত তথ্য ভিত্তিক লেখা হয় তবে আজ স্বাদ বদল । কলকাতার দিক থেকে জিটিরোড ধরে আসছেন চন্দননগর গেট পাড় হয়ে বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে কিছুটা গেলেই দশভূজা তলা আর ডান দিকে কিছুটা গেলেই আপাত বৈচিত্র হীন একচালা মন্দির দশভুজা ।আজ এই মন্দিরের গল্প ।একঝলক দেখলে এই মন্দির কে চোখে লাগবে না, আর মন্দিরের সামনের নাট মন্দির ,মন্দির টাকে ঢেকে ফেলেছে ।তবে এই চালা মন্দির এর গায়ে টেরাকোটা র কাজ ছিল ।




কিন্তু গায়ে প্রলেপের লাল রঙ আর রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে সে কাজ নষ্ট হয়ে গেছে ।ত্রিখিলান বিশিষ্ট দরজা চোখ টানে। ভিতরে অষ্টধাতুর এক ফুটের দশভুজা মুর্তি ,আর রাধা কৃষ্ণ  মূর্তি ।মন্দিরের পাশে দূর্গা মন্দির সেখানে দূর্গা পুজা হয় ।এটাই সবচেয়ে বড় উৎসব এই মন্দিরের ।এ তো সব মন্দিরের গল্প , কিন্তু এই দশভুজা মন্দিরের একটা ইতিহাস আছে আর আছে একটা গল্প সেটাই মন ছুঁয়ে যায় ।
সেই গল্পে আসার আগে , প্রাসঙ্গিক কিছু কথা -- দশভুজা মন্দির দিনের বেশী সময় বন্ধ থাকে সকালে ও সন্ধ্যে তে মন্দিরের পাশের দিকের দরজা খুলে পুজো হয় ।এই মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা হয় অনু দিদি র সাথে তিনি সব ব্যবস্থা করেন এবং মন্দির যাদের তাদের সাথেও আলাপ করিয়ে দেন । আর এই আলাপ পর্ব ই গল্পের জন্ম দেয় ।
মানকুন্ডুর দশভুজা মন্দির বর্তমানে স্থানীয় মজুমদার বংশ দেখভাল করে । আলাপ হল এই বংশের বর্ষীয়ান সদস্য শ্রী পঞ্চানন মজুমদার এর সাথে। কথায় কথায় তিনি একটা ডায়েরি দেখালেন , ডায়েরি টির বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই ।পঞ্চানন বাবুর বাবার লেখা এই ডায়েরি পড়ে জানা যায় এই মন্দির মোঘল আমালের । রাজা মানসিং বাংলায় এসেছিলেন এবং শিবির করেছিলেন তৎকালীন শ্যামবাটি গ্রামে ।এই শ্যামবাটি পরবর্তী তে মানকুন্ডু । রাজা মানসিং এর ঘোড়া হারিয়ে গেলে স্থানীয় যুবক রাম রাম ঘোষ সেই ঘোড়া খুজেঁ আনেন। মান সিং খুশী হয়ে তাকে মোঘল দরবারের কাজে বহাল করেন । পরবর্তীতে রামরাম এর কাজে খুশি হয়ে তাকে শ্যামবাটি অঞ্চলের জায়গীরদার করা হয় এবং মজুমদার উপাধি দেওয়া হয় ।এই রামরাম মজুমদার এই এই দশভুজা মন্দিরের স্থাপনা করেন ।এই মন্দিরের বয়স আনুমানিক চারশো বছরের বেশী ।এতো গেল ইতিহাস এর কথা এই মন্দিরের একটি লৌকিক গল্প ও রয়েছে ,সেই ডায়েরি পড়ে তাও জানা যায় । আর সেই গল্প আরও আকর্ষণীয় ।


                                                                  ( দশভূজার বিগ্রহ )

এই গল্প এক ডাকাতের গল্প । ডায়েরি অনুযায়ী এক ডাকাত দল এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে অন্ন গ্রহণ করে এত প্রসন্ন হয় যে তারা তাদের ডাকাতির একটা অংশ ব্রাহ্মণ কে দিতে চায় । সেই ডাকাত দলের ডাকাতি সামগ্রীর মধ্যে ছিল এই দশভূজা মূর্তি টিও।। তারা লুঠ করার সময় বাড়ির কূলদেবীকেও লুঠ করে আনে .. তো ব্রাহ্মণ সেই দেবী মূর্তি পরম যত্নে ও ভক্তি ভরে স্থাপন ও পুজা শুরু করে । কিন্তু দেবী তাকে স্বপ্ন দেয় যে তিনি ব্রাহ্মণের ঘরে অন্নভোগ গ্রহণ করবেন না তাকে যেন মজুমদার দের বাড়িতে দিয়ে আসা হয় । ঠিক একরকম স্বপ্নদেশ পান জমিদার রামরাম মজুমদার এবং ব্রাহ্মণ অষ্টধাতুর মাতৃ মূর্তি জমিদার কে দিয়ে আসেন।। তারপর স্থাপিত হয় এই দশভুজা মন্দির ।


                                                               ( প্রাচীন রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ )



তবে সেই ট্রাডিশান আজও চলছে ,শূদ্রের ঘরে পুজীত দেবীর নিত্যপুজা হলেও অন্নভোগ হয়না ।
তবে ডাকাত দলের কাহিনী গল্প কথা হতে পারে কিন্তু ১৯৬৮ সালে এই মন্দিরের বিগ্রহ সত্যিই চুরি গিয়েছিল , সেই সময়কার সংবাদ পত্রে সে খবর ছাপা ও হয় । চন্দননগর এর লাল দিঘী থেকে সেটি উদ্ধার করা হয় ।
প্রায় চার শতাব্দী ধরে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন দেবী দশভুজা এই মানকুন্ডু অঞ্চলে আপাত বৈচিত্র্য হীন হয়ে । হয়ত বিগ্রহ থেকে যাবে , কিন্তু কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে এই মন্দির আর ইতিহাস ।।

( ছবি ও লেখনি - সুমন্ত বড়াল )

হুগলী দর্শন

ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা "

             ভক্তের সাথে পথেই বিরাজ করেন " পথের মা " গুগুল ম্যাপ পিচ রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির উঠান দিয়ে যে মোড়ে নিয়ে ...